Advertisement
E-Paper

বসন্তোৎসব ও ক্যামেরার খুনসুটি

সামনে দোল, শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব। টেলিভিশনে দর্শকদের বসন্তোৎসব দেখাতে পেরে খুব আনন্দ পেয়েছি। নব্বইয়ের দশকে, এক বার ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ হচ্ছে, তখন বহু দূর থেকে যে-দর্শকরা কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না, তাঁদের সুবিধের জন্য আমরা দূরদর্শন থেকে বড় বড় স্ক্রিন লাগিয়ে দিলাম চারিদিকে। ওবি ভ্যান নিয়ে আমরা তিনটে ক্যামেরায় রেকর্ডিং করছিলাম, তাঁরা সেই রেকর্ডিং-এর ছবি দেখেই তুষ্ট থাকলেন।

পঙ্কজ সাহা

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব। নাচে, গানে, আবিরে, জনসমাগমে জমজমাট।

শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব। নাচে, গানে, আবিরে, জনসমাগমে জমজমাট।

সামনে দোল, শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব। টেলিভিশনে দর্শকদের বসন্তোৎসব দেখাতে পেরে খুব আনন্দ পেয়েছি। নব্বইয়ের দশকে, এক বার ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ হচ্ছে, তখন বহু দূর থেকে যে-দর্শকরা কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না, তাঁদের সুবিধের জন্য আমরা দূরদর্শন থেকে বড় বড় স্ক্রিন লাগিয়ে দিলাম চারিদিকে। ওবি ভ্যান নিয়ে আমরা তিনটে ক্যামেরায় রেকর্ডিং করছিলাম, তাঁরা সেই রেকর্ডিং-এর ছবি দেখেই তুষ্ট থাকলেন। তখন আমরা বিশ্বভারতীর সঙ্গে একদম মিলেমিশে কাজ করতাম। সুপ্রিয় ঠাকুর, গোরা সর্বাধিকারী, বিশ্বভারতীর সব কর্মী, স্বয়ং উপাচার্য, সবাই আপনজনের মতো সাহায্য করতেন।

১৯৭৬ সাল থেকে আমরা ফিল্ম ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে সাদা-কালো ছবি তুলে এনে দেখাতাম। আশির দশকে ইএনজি ক্যামেরা আসার পর, বসন্তোৎসবের ছবিও রঙিন হল। কিন্তু প্রথম যখন বসন্তোৎসব শান্তিনিকেতন থেকে ‘সরাসরি’ প্রচারের ভাবনা মাথায় এল, বিশ্বভারতীকে রাজি করাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কথা উঠল, যাঁরা বসন্তোৎসব দেখতে চান, তাঁরা তো শান্তিনিকেতনেই আসেন। শান্তিনিকেতনের ট্র্যাডিশনের সঙ্গে দূরদর্শনের লাইভ টেলিকাস্ট খাপ খায় না। দূর-দূরান্তের দর্শকদের প্রসঙ্গ এনে অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে শুরু করা গেল। দেখতে দেখতে সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেলেন।

আশ্রমে ‘ফাগুন বউ’ নামে একটা বড় গাছ বসন্তের ফুলে ভরে যেত। আমরা ঠিক করলাম, শুরুর শট হবে: সেই বসন্তের ফুলে ভরা গাছটি থেকে ক্যামেরা টিল্ট ডাউন করছে আর ‘খোল দ্বার খোল’ গাইতে গাইতে ছেলেমেয়েদের শোভাযাত্রা শুরু হচ্ছে। ওই গাছের নীচে থেকে শোভাযাত্রা শুরু করাটা শান্তিনিকেতনের ট্র্যাডিশন নয় বলে অনেকে আপত্তি করলেন। শেষ পর্যন্ত রাজি করানো গেল। কয়েক বছর পর দেখা গেল, ওই গাছে অমন ফুলের সমারোহ দেখা যাচ্ছে না। আমরা ঠিক করলাম, ছাতিমতলার সামনে থেকে শোভাযাত্রা শুরু হোক, ছাতিমতলা থেকে প্যান করে এসে দৃশ্যটা ধরব। তখন আবার অনেকে আপত্তি করলেন: আমরা ট্র্যাডিশন ভাঙতে বলছি! তত দিনে ফাগুন বউয়ের তলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু হওয়াটা ট্র্যাডিশন হয়ে গেছে!

সকালের অনুষ্ঠানের শেষ গান ‘যা ছিল কালো ধলো’র সঙ্গে আবির ছোড়া শুরু হয়, আর ঠিক তার পরেই পাঠভবন, সংগীতভবন, কলাভবনের সামনে বসে যায় স্বতঃস্ফূর্ত নাচগানের আসর, আমরা সেখানেও ক্যামেরা কাঁধে হাজির হতাম। আমাদের কেউ কেউ সেই নাচগানে অংশও নিত। বিশ্বভারতীর বন্ধু জনক ঝংকার, সৌরীন বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম ভট্টাচার্যদের সঙ্গে আমরা শান্তিদেব ঘোষ, অমিতা সেন, মোহরদিদের বাড়ি গিয়ে তাঁদের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করে মিষ্টিমুখ করে আসতাম, আর বসন্তোৎসব নিয়ে তাঁদের স্মৃতিকথাও ক্যামেরাবন্দি করে আনতাম।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, দোলের দিন দেখে নয়, আমরা বসন্তের এক পূর্ণিমা রাতে আম্রকুঞ্জে সমবেত হয়ে, গুরুদেবের উপস্থিতিতে, গান নাচ সাহিত্যপাঠ করতাম, বাড়ি বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসা হত। পরে কলকাতার অতিথিদের অনুরোধে দোলের দিন এই উৎসব উদ্যাপনের প্রথা চালু হল। অমিতাদি বলতেন, আমাদের সময় আবির দিয়ে এ রকম ভূত সাজানো হত না, বড়দের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করতাম, বন্ধুদের কপালে আবিরের টিপ পরিয়ে দিতাম, আর হাওয়ায় ছড়িয়ে দিতাম আবির, যাতে চারপাশের প্রকৃতিও রঙিন হয়ে ওঠে। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের ছেলে কংকরদা বলেছিলেন, আমার সহপাঠিনী ইন্দিরা গাঁধী বসন্তোৎসব উপলক্ষে এক বার ‘বসন্ত পালা’য় ‘তোমার বাস কোথা হে পথিক’ গানটির সঙ্গে নেচেছিলেন।

দেখতাম, সুন্দর তালপাতার ডোঙায় আবির নিয়ে এসেছে ছাত্রছাত্রীরা। পলাশ ফুলের মালায় সেজেছে মেয়েরা। কিন্তু শিল্পী সুধীর খাস্তগীরের কন্যা প্রাক্তনী শ্যামলী খাস্তগীরের নেতৃত্বে একটা প্রতিবাদ হল, পলাশের ডাল ভাঙার বিরুদ্ধে। পরে পলাশের ডাল ভাঙা বন্ধ হয়।

আমাদের কত রঙিন স্মৃতি! দু’দিন আগে থেকেই প্রিয়দর্শী সেন অথবা প্রভাস শিকদারের নেতৃত্বে প্রযুক্তি বিভাগের কর্মীরা তৎপর, বসন্তোৎসবের সকালে বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি পরে আমি কবিপুত্র শমীন্দ্রনাথের প্রথম বসন্তোৎসব করার কথা বলে ভাষ্য শুরু করছি, ওবি ভ্যানে প্রযোজনার কাজে ব্যস্ত শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত, চম্পা ভৌমিক, পরে শিলচর থেকে এসে যোগ দিল জয়গোপাল দত্ত। থাকতেন আরও অনেক সহকর্মী। যখন শুনতাম শান্তিনিকেতনের অনেক পুরনো মানুষও ভিড়ের ভয়ে অনুষ্ঠানে না এসে দূরদর্শনের পরদাতেই চোখ রেখেছেন আর খুশি হয়েছেন, তৃপ্তিতে মন ভরে যেত।

pankajsaha.kolkata@gmail.com

pankaj saha magic box anandabazar rabibasariya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy