Advertisement
০২ মে ২০২৪

ভূতের শহর

একটা শহরের কথা বলি। সেখানে ১৩০০০-এর বেশি অ্যাপার্টমেন্ট, ১৫টা প্রাইমারি স্কুল, একটা হাসপাতাল, ১০টা জিম, ৩৫টা খেলার মাঠ, একটা রেলওয়ে স্টেশন, ১৬৭টা বাস। হয়তো ভাবছেন, এতে নতুন কী! ‘বিশেষ’ এটাই, যে, সেই শহরে একটিও মানুষ নেই! সব পরিত্যক্ত। আর মানুষ সব ছেড়ে চলে গিয়েছিল মাত্র দু’দিনে। গেরস্থালির জিনিসপত্র, শিশুদের খেলনা, পড়ে আছে সব। শহরটির নাম ‘প্রিপায়াত’, চেরনোবিল আণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মীদের থাকার জন্য মূলত তৈরি হয়েছিল।

সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

একটা শহরের কথা বলি। সেখানে ১৩০০০-এর বেশি অ্যাপার্টমেন্ট, ১৫টা প্রাইমারি স্কুল, একটা হাসপাতাল, ১০টা জিম, ৩৫টা খেলার মাঠ, একটা রেলওয়ে স্টেশন, ১৬৭টা বাস। হয়তো ভাবছেন, এতে নতুন কী! ‘বিশেষ’ এটাই, যে, সেই শহরে একটিও মানুষ নেই! সব পরিত্যক্ত। আর মানুষ সব ছেড়ে চলে গিয়েছিল মাত্র দু’দিনে। গেরস্থালির জিনিসপত্র, শিশুদের খেলনা, পড়ে আছে সব। শহরটির নাম ‘প্রিপায়াত’, চেরনোবিল আণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মীদের থাকার জন্য মূলত তৈরি হয়েছিল। এ রকম শহর পৃথিবীতে আরও আছে। ‘প্রিপায়াত’-এর নাম প্রথমে করলাম, কারণ সম্ভবত সব থেকে কম আয়ু পেয়েছিল এই শহর। সরকারি ভাবে এটিকে শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৭৯ সালে, আর ২৬ এপ্রিল ১৯৮৬-তে চেরনোবিল দুর্ঘটনার দু’দিনের মধ্যে এ শহর ভূতের শহর হয়ে যায়।

পৃথিবীতে যতগুলো ভূতের শহর বা ‘গোস্ট টাউন’ দাঁড়িয়ে আছে, তার মধ্যে প্রাচীনতম হল, আমাদের ছেলেবেলায় পড়া ‘লাস্ট ডেজ অফ পম্পেই’-এর সেই পম্পেই। পম্পেই ছিল রোমানদের প্রমোদনগর। ৭৯ খ্রিস্টাব্দে মাউন্ট ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের ফলে শেষ হয়ে যায় এই শহর ও তার কুড়ি হাজার বাসিন্দা। অদ্ভুত ব্যাপার হল, যে দিন এই মহাপ্রলয় ঘটেছিল, তার আগের দিনই পম্পেই পালন করেছে রোমান অগ্নিদেবতার পুজোর উৎসব ‘ভালকানালিয়া’। বহু শতাব্দী কয়েক হাজার টন ছাইয়ের তলায় চাপা থাকার পর এই শহর ‘আবিষ্কার’ হয় ১৫৯৯ সালে। এত বছর ছাইয়ের তলায় থাকার ফলে এ শহরের ওপর প্রকৃতির আর কোনও আক্রমণ হতে পারেনি। অবিকৃত রয়ে গিয়েছে অনেক রাস্তাঘাট, পোশাক-আশাক, সুরাপাত্র, এমনকী শুকিয়ে বিক্রি করা ফল। আজ সেখানে বছরে প্রায় পঁচিশ লক্ষ টুরিস্ট যান। পম্পেই পেয়েছে ইউনেস্কোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর সম্মান।

যে দুটি ঘটনা বললাম, তাতে ভূতের শহর তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক বা মনুষ্যকৃত দুর্ঘটনায়। সব সময় তা হয় না। নামিবিয়া তখন জার্মান কলোনি। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে রেললাইন পাতছে জার্মানরা। ১৯০৮ সালে কাজ করতে করতে সেখানে হঠাৎ এক কর্মী পেয়ে গেল একটি হিরে। সে অবশ্য সেটিকে হিরে বলে চিনতে পারেনি। সে সেটা দেখায় জার্মান রেল ইন্সপেক্টরকে। ব্যস, জার্মানরা বুঝে গেল, ওখানে অনেক হিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। রাতারাতি গজিয়ে উঠল শহর। তার নাম হল কোলম্যানস্কোপ, আফ্রিকান ভাষায় যার মানে কোলম্যানের পাহাড়। ওইখানে জনি কোলম্যান নামে এক গাড়োয়ান বালির ঝড় উঠেছে দেখে যাত্রীসহ গাড়ি ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল দিনকয়েক আগে, কপালজোরে তার নাম রয়ে গেল ইতিহাসে। এ কিন্তু যেমন-তেমন শহর হয়নি। স্কুল, থিয়েটার, ক্যাসিনো, হাসপাতাল, বলরুম তো ছিলই, তা ছাড়া ছিল এক্স-রে কেন্দ্র, যা দক্ষিণ গোলার্ধে প্রথম হল ওখানেই, আর আফ্রিকার প্রথম ট্রাম চলেছিল এই শহরেই। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই এর দুর্দিন শুরু হয়। কারণ, এলাকার হিরে ফুরিয়ে আসছিল। ১৯৫৪ সালে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে যায় কোলম্যানস্কোপ। আজ এটি পর্যটকদের বেড়াবার জায়গা। মানুষ চলে আসার পর দখল নিয়েছে মরুভূমি। জার্মান কায়দায় তৈরি সব বাড়ির একতলার মেঝে এখন এক-হাঁটু বালির তলায়।

চ্যাপলিনের ছবি ‘গোল্ড রাশ’-এর কথা নিশ্চয় মনে আছে। বাস্তবে সেই গোল্ড রাশের ফলে তৈরি হয়েছিল বারকারভিল। সান ফ্রান্সিসকোর উত্তরে আর শিকাগোর পশ্চিমে কারিবু পর্বতমালার পশ্চিম ধার ঘেঁষে ছিল এই শহর। ১৮৬১ সালে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজশায়ারের বাসিন্দা বিলি বারকার এখানে পেয়ে গেল প্রায় ৩৭ হাজার আউন্স, মানে এক হাজার কেজি সোনা। খবর ছড়াতেই রাতারাতি গড়ে উঠল শহর। সব থেকে বেশি ব্যবসা করল চিনেরা। মুদিখানা থেকে শুরু করে গাঁইতি-শাবল সবেরই চিনে দোকান বসে গেল। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ হবার আগেই সোনা ফুরিয়ে এল, আর ফুরিয়ে এল বারকারভিলের সুদিন। আস্তে আস্তে আর এক ঘর বাসিন্দাও থাকল না সেখানে। ১৯৫৮ সালে বারকারভিল’কে ঐতিহাসিক শহর আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সারানো হয়েছে সব বাড়িঘর। আজ মানুষজন যান সেই শহর দেখতে, থাকেন না কেউই।

১৯৮৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙল। যে-সব ছোট ছোট প্রজাতন্ত্র নিয়ে সোভিয়েত তৈরি হয়েছিল, তারা অনেকেই এ-ওর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করল। ১৯৯৩ সালে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধের পর আর্মেনিয়ানরা দখল করে নিল আজারবাইজানের আগদাম শহর। যুদ্ধের কোনও নিয়ম মানা হয়নি। গোটা শহরের সমস্ত মানুষ প্রাণ বাঁচাতে পুবের দিকে পালায়। আর্মেনিয়ান সেনারা সিদ্ধান্ত নেয়, শহরটা ধ্বংস করে দেবে। তা করেও সাধ্যমত। তারা চলে যাওয়ার পর যেটুকু যা পড়ে ছিল, তা লুট করতে থাকে আজারবাইজানেরই মানুষ। এক সময় চল্লিশ হাজার মানুষের বসতি সেই আগদাম আজ তার ভাঙা বাড়ির সারি নিয়ে ভূতের শহর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ট্যুরিস্ট যাওয়া নিষিদ্ধ। এখনও আর্মেনিয়ানরা এটিকে ‘বাফার’ জোন হিসেবে ব্যবহার করে।

যুদ্ধ অনেক শহরকেই ‘ভূত’ করেছে। পশ্চিম-মধ্য ফ্রান্সের লিমুজিন অঞ্চলের ‘ওরদার-স্যু-গ্লেন’ শহরের কথা বলি। জার্মান ওয়েফেন এস এস-এর এক কোম্পানি ফৌজের হাতে শেষ হয়ে যান এখানকার ৬৪২ জন বাসিন্দা। তাদের মধ্যে ছিলেন ২৪৭ জন মহিলা ও ২০৫ জন শিশু। তারিখটা ছিল ১৯৪৪ সালের ১০ জুন। নর্মান্ডি সমুদ্রতটে মার্কিন সেনারা নেমে পড়ার পর জার্মান সেনাদের নির্দেশ দেওয়া হয়, মিত্র বাহিনীকে ঠেকাতে তারা যেন গ্রামের মধ্যে দিয়ে গিয়ে ব্যারিকেড গড়ে তোলে। সে রকম এক রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন অ্যাডল্ফ ডিকম্যান। সকালে তার কাছে খবর এল, এক এস এস অফিসারকে আটকে রেখেছে ‘ওরদার-স্যু-ভেরে’র বাসিন্দারা। যায় কোথায়? ডিকম্যানের নির্দেশে ‘ওরদার-স্যু-গ্লেনে’কে ঘিরে ফেলল সেনারা। নাম গুলিয়ে ‘ওরদার-স্যু-গ্লেনে’কে ‘ওরদার-স্যু-ভেরে’ ভেবে নিল তারা। সব পুরুষকে বলা হল গ্রামের মাঝখানে জড়ো হতে, তাদের কাগজপত্র পরীক্ষা করা হবে। ছ’জন লোক সেই সময়ে বাইক নিয়ে সেই গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছিল, তারাও রেহাই পেল না। মহিলা ও শিশুদের আটকে রাখা হল একটি চার্চে। সারা গ্রামের সব বাড়ি লুঠপাট করা হল, তারপর সবাইকে নিয়ে যাওয়া হল ফসল রাখার শেডে, যেখানে মেশিনগান তৈরিই ছিল। সবাইকে গুলি করা হল পায়ে, যাতে মৃত্যু আসতে সময় লাগে। তারপর দেহগুলির ওপর পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। তার পর আগুন লাগানো হল চার্চে। মার্গারেট রুফাঞ্চ নামে এক ৪৭ বছরের মহিলা শুধু বাঁচতে পেরেছিলেন। যুদ্ধের পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দ্য গ্যলের নির্দেশে গ্রামটিকে আর নতুন করে তৈরি করা হয়নি। সেটি এখন যুদ্ধের স্মারক ও মিউজিয়ম।

তামিলনাড়ুর দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় আছে এক পরিত্যক্ত জনপদ, ধনুষ্কোটি। শ্রীলঙ্কার তাইলামানারের থেকে মাত্র আঠারো মাইল দূরে এই ধনুষ্কোটি পর্যন্ত ট্রেন চলত এক সময়। চেন্নাই এগমোর (তখন মাড্রাস এগমোর) থেকে যে-ট্রেন যেত ধনুষ্কোটিতে, সেই সার্ভিসের নাম ছিল ‘বোট মেল’। কারণ, এখান থেকে নৌকো নিয়ে লোকে যেত শ্রীলঙ্কা। ১৯৬৪-র ২২ ডিসেম্বর, রাত ১১.৫৫। ৬৫৩ ডাউন পাম্বান-ধনুষ্কোটি প্যাসেঞ্জার যখন ধনুষ্কোটি স্টেশনের মাত্র কয়েকশো গজের মধ্যে, এক বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ল সেই ট্রেনের উপর। ঝড়-ঝঞ্ঝা চলছিল কয়েক দিন ধরেই। এর পরেই আর এক বিশাল ঢেউয়ের ধাক্কায় সমুদ্রে ভেসে গেল গোটা ট্রেন। ১১০ জন যাত্রী ও পাঁচ জন রেলকর্মীর সলিল সমাধি হল। সেই সাইক্লোনে সব মিলিয়ে প্রায় ১৮০০ মানুষ মারা গিয়েছিলেন। রামেশ্বরমের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সংযোগরক্ষাকারী সেতুটিরও আর অস্তিত্ব ছিল না। ধনুষ্কোটির অনেকটাই চিরতরে সমুদ্রগর্ভে চলে গিয়েছিল। তখন রাজ্যের নাম ছিল মাদ্রাজ স্টেট। মাদ্রাজ রাজ্যের সরকার ঘোষণা করে দিলেন, সবাইকে এই জায়গা ছেড়ে যেতে হবে। আজ সেই ভূতুড়ে শহরে শুধু কয়েক ঘর জেলের বাস। তবে তারাও সারা বছর সেখানে থাকে না।

যদি কোথাও গিয়ে পড়েন, যেখানে চারপাশে গাছ-গাছালি, থেকে থেকে চোখে পড়ছে ছোট-বড় ভাঙা বাড়ি, ভাঙা বয়লার, আর কিছু কিছু দিক-নির্দেশক বোর্ড, তাতে লেখা ‘স্কুল’, ‘পোস্ট অফিস’, ‘ইউরোপিয়ান ক্লাব’? এ রকমটাই আছে আন্দামানের ‘রস আইল্যান্ড’-এ। বোর্ডে লেখা ‘টেনিস কোর্ট’ বা ‘ফারজান্দ আলি স্টোর’। এই ফারজান্দ আলি স্টোর ছিল সব থেকে বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর। এই রস আইল্যান্ড আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে প্রথম ব্রিটিশ বসতি। একে ডাকা হত ‘লিট্ল ইংল্যান্ড’। এখানে যা ঘর-বাড়ি বানানো হয়েছিল, তার মজুরেরা ছিলেন সবাই স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ রস দ্বীপ ছিল জাপানিদের দখলে। তবে, তার আগেই ১৯৪১-এ এক ভূমিকম্পের কারণে এখানকার লোকরা প্রায় সবাই দ্বীপ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ১৯৪৩-এর ডিসেম্বরে একটি দিন এখানে এসেছিলেন নেতাজি। এখানকার গভর্নমেন্ট হাউসের মাথাতে তেরঙ্গা পতাকাও তোলেন তিনি।

২০০৩ সালে আমরা যখন ওখানে গেলাম, তখন গাইড হিসেবে যাকে পেয়েছিলাম, তার নাম হানিফ। বয়স অন্তত ৭৫। চোখে পুরু কাচের চশমা। মাঝে মাঝেই খেয়াল করছিলাম সে কেমন হারিয়ে যাচ্ছে নিজের মধ্যে। হানিফ বলল, ও জন্মেছে, বড় হয়েছে এই আইল্যান্ডে। ১৯৪৩ অবধি সে এখানেই থাকত। একটা লতাগুল্মে ঢাকা বাঁধানো পথ দেখিয়ে বলল, ‘এটা ছিল আমাদের স্কুল যাবার রাস্তা।’ আর একটা জায়গা দেখিয়ে বলল, ‘ওইটা ছিল সাহেবদের সুইমিং পুল। আমরা মাঝে মাঝে লুকিয়ে নামতাম।’ একটা বাড়ির দিকে তাকিয়ে ওর চোখ জলে ভরে এল। বুঝলাম, ওইটা ছিল ওর বাড়ি। কী রকম ‘সোনার কেল্লা’র কথা মনে হচ্ছিল। ভাবলাম, পরজন্ম আছে কি না, এ সব তর্কের কী দরকার? কত মানুষ এক জীবনেই অনেক জীবন বাঁচে। ঠিক যেমন এই মুহূর্তে নিজের বাড়ির ভেঙে পড়া পাঁচিলে ঠেসান দিয়ে নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে হানিফ আলি, সে চলে গেছে তার ‘গতজন্মে’।

sumantrachat@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabibasariya anandabazar sumantra chattopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE