জীবনের শেষ দিনগুলোয় রোমে নিজের ছোট্ট ঘরে শুয়ে, পাশের ঝরনার জলের নিরন্তর শব্দ শুনতে শুনতে একটি নাটকের লাইন বার বার মনে পড়ত জন কিট্স-এর— ‘all your better deeds/ shall be in water writ.’ তার পর নিজের মৃত্যুর সামান্য আগে বন্ধু জোসেফ সেভার্নকে কিট্স বলেছিলেন, তাঁর কবরের ওপর যেন শুধু লেখা হয়— ‘Here lies one whose name was writ in water.’
কিট্সের সঙ্গে আমার আলাপ ’৯৫-এর ডিসেম্বরে। তখন সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে বাড়িতে বেকার হয়ে বসে আছি। সবার থেকে নিজেকে লুকিয়ে নেওয়ার জন্য আরও বেশি করে বইপত্তর পড়ছি। এক দাদার বাড়িতে প্রথম দেখেছিলাম বইটা। না, কবিতার নয়। চিঠির বই। হালকা নীল মলাটের ওপর হাতে-আঁকা ছবি। কিট্সের ছবি। বইটা ছিল তাঁর চিঠির সংকলন।
কিট্সের নাম আমি আগেই জানতাম। ইলেভেন ক্লাসে তাঁর একটা কবিতা আমাদের পাঠ্য ছিল। বেশ বড় নামের সেই কবিতাটাকে আমরা ছোট করে বলতাম, ‘সিটি পেন্ট’। ভাল লাগেনি কবিতাটা। তবে আমাদের ইংরেজি স্যরের কাছ থেকে কিট্সের সম্বন্ধে শুনেছিলাম। কোন দেশের মানুষ তিনি, কী করতেন, কত দিন বেঁচে ছিলেন, এমনকী তাঁর প্রেমিকার নাম কী— সবই বলেছিলেন স্যর। তাই লোকটার সম্বন্ধে একটা কষ্টমিশ্রিত ভাললাগা ছিল। অত অল্প বয়সে মারা গিয়েছেন মানুষটা। বেঁচে থাকতে খুব একটা সমাদরও পাননি। এমনকী প্রেমটাও ঠিকঠাক হয়নি। সেই বয়সে আমাদেরও তো প্রেম হয়নি। তাই কিট্সের সেই ব্যর্থ প্রেমিক আর দুঃখী ব্যাপারটা যেন আরও বেশি করে টেনেছিল সেই সময়।
কিন্তু প্রকৃত পরিচয় হল সেই দাদার বাড়িতে। চিঠির বইটা পড়ে। তাঁর গদ্য পড়ে। কী শান্ত আর মন ভাল করে দেওয়া গদ্য! কী সহজ! যেন পাশে বসে কেউ কথা বলছে! এমন করে চিঠি লেখা যায়? গদ্য লেখা যায়? আমি সেই কিট্সের লেখার প্রেমে পড়লাম।
ছোট থেকেই স্বভাবগত ভাবে আমি একা। ভিড়ের মাঝে বসেও মনে হত, মনে হয়— আমার কেউ নেই। কেউ যেন আসবে বলেছিল, কিন্তু সে আর এল না! কেউ যেন ভালবাসবে বলেছিল, কিন্তু ভালবাসল না! সেই আঠেরো-উনিশ বছর বয়সে এই সব ভাব আরও প্রবল ছিল। কিন্তু কারও কাছেই এর উত্তর পেতাম না, সমর্থন পেতাম না। জন কিট্স-ই প্রথম তাঁর ‘সমর্থনের খাতা’ আমার জন্য তুলে ধরেছিলেন। তাঁর লেখার মধ্যে আমি প্রথম পেয়েছিলাম, আমার না-বুঝতে পারা ‘ওয়ান্ডারফুল লোনলিনেস’!
আর ছিল বিস্ময়। ১৭৯৫ সালের ৩১ অক্টোবর যে মানুষটার জীবন শুরু হয়ে হঠাৎ থেমে গিয়েছিল ১৮২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, যে মানুষটা জীবিত কালে তিনটে পাতলা কবিতা সংগ্রহ বের করতে পেরেছিলেন, মাত্র চুয়ান্নটা কবিতা বেরিয়েছিল যাঁর, সমকাল যাঁকে পাত্তাই দেয়নি, সেই মানুষটা এমন সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠলেন কী করে!
প্রথমে চিঠি, তার পর কবিতা। সত্যি বলতে কী, কবিতা তখন খুব ভাল বুঝতে পারতাম না। কবিতা বোঝার মতো অতটা ভাল ইংরেজি তখন জানতামও না! কিন্তু কীসের যে কুহক ছিল, বুঝি না আজও। তাঁর কবিতা আমি অল্প বুঝে, না-বুঝেও পড়ে যেতাম।
তার পর এক দিন কলেজ স্ট্রিট গিয়ে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কিনলাম হলদে হয়ে যাওয়া, উইপোকায় কাটা তাঁর ইংরেজি কবিতার বই। স্যর বললেন, ‘গোল্ডেন ট্রেজারি কিনিস। রোম্যান্টিক এজ-এর অনেক কবিকে একসঙ্গে পাবি।’ কিনলাম। প্রেসিডেন্সি কলেজের দেওয়ালের ধারে সাহাবাবুর দোকান ছিল। ফরসা, ছোট্ট চেহারার মানুষটিকে আজও মনে আছে আমার। বলেছিলেন, ‘ইংরিজি নিয়ে পড়ছ নাকি?’ আমি বলেছিলাম, ‘না, বাড়িতে বসে আছি।’ সাহাবাবু হেসে বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, তবে কিট্সের কবিতা ভাল করে বুঝতে কয়েকটা বই আমি দিচ্ছি। এগুলো নিয়ে যাও। কবিতাগুলো আরও স্পষ্ট হবে।’
’৯৫-এর ডিসেম্বর থেকে ’৯৬-এর জুন আসতে আসতে কিট্সের কবিতাগুলো আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল। মানে, টেক্সট পড়া হয়েছিল। আর মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম, এ বার কলেজে ভর্তি হব ইংরেজি অনার্স নিয়ে।
বাড়িতে বলল, তোর সায়েন্স ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিলি। আরে, অন্তত ফিজিক্স অনার্স নে। আমি বলেছিলাম, ইংরেজিই নেব। কোনও এক জনকে ভালবেসে ইংরেজি অনার্স নেওয়াটা হয়তো মূর্খামো ছিল। কারণ, শুধু কিট্স দিয়ে তো আর সিলেবাস গড়া নয়। চসার থেকে সাইকোলজিকাল নভেল— সব পড়তে হত। ফিলোলজি পড়তে হত। গোল্ডস্মিথ পড়তে হত। আমার অসম্ভব খারাপ লাগত এ সব। কিন্তু তবু পোয়েট্রি পেপারটা খুললে ভাল হয়ে যেত মন।
কবিকে যে কবিতার বাইরেও পাওয়া যায়, এটা ইংরেজি অনার্স না পড়লে জানতে পারতাম না। সেই সময় আমার একটি মেয়েকে পছন্দ ছিল। কিট্সের ‘ব্রাইট স্টার’ পড়ছি তখন। আর ভাবছি, প্রেমে পড়লে তো এ ভাবেই পড়তে হয়। এমন নিশ্চল আর একাগ্র হয়ে। সেই ’৯৭-এ পড়া ‘ব্রাইট স্টার’ মনের ভেতর তার পর থেকেই ঘুরে বেরিয়েছে। একার কক্ষপথে সে আমাকেও নিয়ে ঘুরেছে। তার ষোলো বছর পরে আমি যখন ‘কম্পাস’ নামে একটি উপন্যাস লিখলাম, সেখানেও সেই প্রেমই ফিরে এসেছে। সেই বহু শতাব্দী আগে, রুগ্ন স্বাস্থ্যের এক কবি যেমন নিশ্চল ভাবে ভালবেসেছিল ফ্যানি ব্রনকে, সে ভাবেই একটি ছেলে ভালবেসে গেছে একটি মেয়েকে। সারা জীবন।
অনেকে কিট্সের ‘নেগেটিভ কেপেবিলিটি’, ‘পসথুমাস এগজিসটেন্স’ ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন। বলেন যে, পরবর্তী সময় লর্ড টেনিসন না এলে হয়তো কিট্স এতটা আলোচিত হয়ে উঠতেন না। হয়তো ঠিকই বলেন। এক জন কবি, দুশো বছর পরেও যাঁর প্রাসঙ্গিকতা কমেনি, তাঁকে নিয়ে হাজার রকম বিশ্লেষণ তো হবেই।
কিন্তু এ সব নয়, আমায় প্রথম থেকেই টানত তাঁর একাকীত্ব। শেষ শীতের দুপুরের ফাঁকা নঙ্গী স্টেশনের এক কোণে বসে বহু আগে পড়া ‘ওড টু আ নাইটিঙ্গেল’ সে দিনও যেমন বেভুল করে দিত আমায়, আজও তেমনই দেয়। ‘টু অটাম’-এর নৈঃশব্দ্য আমায় পৌঁছে দেয় সাইমন আর গারফাংকলের ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’-এ। এতটা নিশ্চুপে কে এমন করে কথা বলে? কে এসে বসে তার দু’শতাব্দী পরের কোনও একটা সাধারণ, গুরুত্বহীন ছেলের পাশে! সময়ের সঙ্গে যার আর্থ-সামাজিক পার্থক্যও এত, তার মনের কথাও প্রায় দুশো বছর আগে কী করে জেনে নেন এই কবি! তাই কি তিনি বলতে পারেন, ‘The poetry of earth is never dead.’
কিট্স চেয়েছিলেন, জলের অক্ষরেই লেখা থাক তাঁর নাম। কিন্তু আমার মতো বহু মানুষের বুকের ভেতর জমে আছে সেই জল। আসলে যার আর এক নাম জীবন।
amarchithipotro@gmail.com