Advertisement
E-Paper

রামনাম

মজুমদারদের আমড়াতলায় ছেলেটাকে দেখল কিরু। সে এখন দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্রের নামটা স্মরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। আজ সকালে উঠেই বাবা বলল, কিরু, তোর বইপত্তর নিয়ে আয়, পড়াশোনা কেমন করছিস দেখি। কিরুর মনে হল, এই খেয়েছে! রবিবার সকালে তো বাবার বাঁধা কাজ থাকে— বাজার দোকান, বাগান পরিষ্কার, সাইকেল ধোয়ামোছা; সে সব ছেড়ে বাবা হঠাৎ কিরুর লেখাপড়া নিয়ে পড়ল কেন!

উল্লাস মল্লিক

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
ছবি: দেবাশীষ দেব

ছবি: দেবাশীষ দেব

মজুমদারদের আমড়াতলায় ছেলেটাকে দেখল কিরু।
সে এখন দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্রের নামটা স্মরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
আজ সকালে উঠেই বাবা বলল, কিরু, তোর বইপত্তর নিয়ে আয়, পড়াশোনা কেমন করছিস দেখি।
কিরুর মনে হল, এই খেয়েছে! রবিবার সকালে তো বাবার বাঁধা কাজ থাকে— বাজার দোকান, বাগান পরিষ্কার, সাইকেল ধোয়ামোছা; সে সব ছেড়ে বাবা হঠাৎ কিরুর লেখাপড়া নিয়ে পড়ল কেন! অথচ বাবাই কথায় কথায় বলে, সময়ের কাজ সময়ে করবে; পড়ার সময় পড়বে, খেলার সময় খেলবে, তবেই জীবনে উন্নতি করতে পারবে। বাবার কি জীবনে উন্নতি করার দরকার নেই আর?
ব্যাজার মুখে বইপত্র নিয়ে আসে কিরু। বাবা বলে, প্রথমে তোকে আমাদের মহাকাব্য থেকে ক’টা প্রশ্ন করি। আচ্ছা বল, অযোধ্যার রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্রের নাম কী?
প্ল্যান ছিল, বাবা বাজারে বেরিয়ে গেলেই চড়কডাঙায় যাবে সে। সেখানে আজ সকাল থেকে ধুন্ধুমার ফুটবল ওয়ান-ডে। কিন্তু চড়কডাঙার বদলে বাবা সোজা অযোধ্যায় নিয়ে গিয়ে ফেলতে মাথা গেল গুলিয়ে। এক বার মনে হল ভরত, তার পরেই মনে হল ভীম; তার পরেই মনে হল কোনওটাই নয়— হয় লব, নয় কুশ।
বাবা ভীষণ রেগে বলল, এই সহজ উত্তরটা পারলি না! দূর হ বাড়ি থেকে, উত্তর না জেনে ঢুকবি না।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে শুদ্ধদীপের বাড়ি গিয়েছিল কিরু। শুদ্ধ ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়। ওকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে। কিন্তু শুদ্ধ ভারী হ্যাটা দিল কিরুকে— এঃ হেঃ, এর পর তো নিজের নামটাও বলে দিতে হবে তোকে।

সেখান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় রঘুজ্যাঠার সঙ্গে দেখা। রঘুজ্যাঠা কানে আজকাল কম শুনছে; কিরু সবে বলতে গেছে, জ্যাঠা দশরথের বড় ছেলে... রঘুজ্যাঠা বলে উঠল, হর জেলে! হর জেলের বাড়ি যাবে; সোজা চলে যাও এই রাস্তা দিয়ে, গিয়ে দেখবে একটা তেমাথার মোড়... পুকুরে জাল দেবে বুঝি...?

কিরু আর দাঁড়ায়নি। সোজা চলে এসেছে মজুমদারদের আমড়াতলায়। দরকার নেই বাবা লোকজনকে জিজ্ঞেস করে, মাথা এমনিতে গুলিয়ে আছে, আরও যাবে। তার চেয়ে নিজেই মনে করার চেষ্টা করবে। আজ রবিবার। দুপুরে মাংস ভাত হয়। বড় একটা মুরগির ঠ্যাং কিরুর পাতে পড়ে। মনে না পড়লে সেটা যাবে।

ভাবতে ভাবতেই ওপর দিকে তাকাল কিরু। গাছ ভর্তি থোকা থোকা আমড়া। দুটো আমড়া খেলে হয়। অনেক সময় পেটে কিছু পড়লে, সে আমড়াই হোক বা ল্যাংড়া আম, বুদ্ধি খুলে যায়।

কিন্তু গাছটা বড্ড বড়। এত বড় গাছে ওঠা মুশকিল। তখনই পিছন থেকে কে যেন বলল, আমড়া খাবে? আর কিরু পিছন ফিরে দেখল, তারই বয়সি একটা ছেলে। রোগা ডিগডিগে চেহারা, মুখটা হাসি হাসি।

কিরু বলল, এত বড় গাছ, উঠবে কে?

ছেলেটা বলল, আমি উঠছি।

রোগা প্যাংলা হলে কী হবে, দিব্যি গাছে চড়তে পারে ছেলেটা। চটপট করে গাছে উঠে আমড়া পেড়ে আনল বেশ ক’টা। সবগুলো দিয়ে দিল কিরুকে।

কিরু বলল, তুমি নেবে না?

ছেলেটা বলল, আমি আমড়া খাই না। তুমি বরং নিমদিঘির ওদিকে যে জঙ্গলটা আছে, ওটা একটু পার করে দাও আমাকে।

কিরু বলল, তুমি কি ভয় পাও নাকি?

হ্যাঁ ভাই। ছেলেটা বলল, ওদিকে বড্ড ভূতের উৎপাত।

কিরু হাসল খুব। বলল, দুর; ভূত বলে কিছু আছে নাকি!

আছে আছে, খুব আছে। আঁতকে উঠে ছেলেটা বলল, বজ্জাত বজ্জাত ভূত সব।

কিরু বুক ফুলিয়ে বলল, ঠিক আছে, চলো, দেখা যাক।

দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে চলে এল নিমদিঘির জঙ্গলে। বড় বড় শ্যাওড়া, নিম, বট, অশ্বত্থ গাছের জঙ্গল। রোদ ঢোকে না তেমন। দিনের বেলাতেও বেশ অন্ধকার মতো। প্রবল ঝিঁঝিঁর ডাক চার পাশে। কাছাকাছিই কোথাও একটা তক্ষক ডেকে উঠল কর্কশ শব্দে। গা-টা যেন একটু ছমছম করে উঠল কিরুর। কিন্তু বড় মুখ করে ছেলেটাকে নিয়ে এসেছে সে। প্রেসটিজের ব্যাপার। তাই সে হাসি হাসি মুখ করেই বলল, কোথায় ভূত, যত সব ফালতু ব্যাপার!

বলার সঙ্গে সঙ্গে একটা নিমগাছ হঠাৎ দুলতে লাগল খুব। যেন ঝড় লেগেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, আশপাশের অন্য গাছগুলো স্থির।

কিরুর ভুরুগুলো কুঁচকে গেছে একটু। সে ভাল করে তাকাল গাছটার দিকে। তেমন হাওয়া-বাতাস নেই, কিন্তু গাছটা দুলছে প্রবল। হঠাৎ একটা মোটা ডাল মট করে ভেঙে পড়ল মাটিতে। ছেলেটা পাশ থেকে বলে উঠল— উহঃ!

কিরু বলল, কী হল?

ছেলেটা বলল গাঁট্টা মারল!

কিরু বলল, কিন্তু কাউকে তো দেখছি না। তোমার মনের ভুল।

ছেলেটা বলল, ‘না, না, মনের ভুল নয়। উহঃ আবার দেখো চুল টেনে পালাল; দেখো, দেখো, জামাটাও ছিঁড়ে দিল কতটা!

কিরু দেখল, সত্যিই ছেলেটার জামা বুকের কাছে ছেঁড়া। এ বার ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল কিরুর। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। সে বলল, পালাই চলো।

ছেলেটা ফিস ফিস করে বলল, তুমি ওই নামটা বলো, সবাই পালাবে।

কিরু বলল, কী নাম?

আরে ওই নামটা, দশরথের বড় ছেলের নাম, যেটা শুনলে ভূত পালায়। তাড়াতাড়ি বলো, না হলে, আবার মারবে।

কিরুর তখনই মনে পড়ে গেল— আরে, দশরথের বড় ছেলের নাম তো রাম; এই নামেই তো ভূত পালায়। সে তাড়াতাড়ি চোখ বুজে বিড়বিড় করতে লাগল— রাম-রাম-রাম-রাম...!

সঙ্গে সঙ্গে একেবারে শান্ত হয়ে গেল চার পাশ। ধীরে ধীরে চোখ খুলল কিরু। কিন্তু ছেলেটাও নেই আশপাশে। এ-দিক ও-দিক তাকাল। না, কোথাও নেই। অবাক কাণ্ড, উবে গেল নাকি!

এই তো আমি!

পিছন ফিরে কিরু দেখল, ছেলেটা দাঁড়িয়ে। বলল, যাক বাবা, সব পালিয়েছে।

কিরু বলল, তুমি ছিলে কোথায়, এই মাত্র চার দিকে তাকালাম, কোথাও দেখলাম না তোমায়!

ছেলেটা বলল, একটু সরে গিয়েছিলাম, ওই নামটা তো করছিলে তুমি।

কিরু বলে, রাম নাম?

আরে থামো থামো, করো কী! বাধা দিয়ে বলে ওঠে ছেলেটা, আর দরকার নেই, সবাই পালিয়েছে। উহঃ, এক বার করলে, তাতেই গা-টা চিড়বিড় করে উঠল, বিছুটির জ্বালা একেবারে।

কিরু চোখ বড় বড় করে বলে, তা হলে তুমিও...?

হ্যাঁ ভাই, আমিও! মিটিমিটি হেসে ছেলেটা বলে, আমি সদ্য হয়েছি। এই জঙ্গলটার পরে যে শ্মশান, ওখানে বেলগাছে ব্রহ্মদত্যি থাকেন। নিয়ম হচ্ছে, যারা টাটকা ভূত, তারা প্রণাম করে আসবে তাঁকে। কিন্তু পথে এই জায়গাটায় পুরনোরা ওত পেতে থাকে। র‌্যাগিং আর কী! কিন্তু এক বার প্রণামটা সেরে ফেললে আর চিন্তা নেই। তখন আমিও দলে হয়ে যাব। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, তুমি না থাকলে ওরা আরও হেনস্থা করত।

কিরু বলল, ধন্যবাদ তোমাকেও, তোমার জন্যই রামের...।

চুপ, চুপ, আরে করো কী, আবার ভুলে গেছ!

কিরু বলে, স্যরি, তোমার জন্যেই দশরথের বড় ছেলের নামটা মনে পড়ল! যাই, বাবাকে গিয়ে উত্তরটা দিই। আর দেরি হলে মুরগির ঠ্যাঙ ফসকে যাবে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy