Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৪ ০০:২৪

পিনাকী ভট্টাচার্য

বিভিন্ন হুইস্কির নামের পেছনে ইতিহাস লুকনো আছে— রীতিমত চমকপ্রদ। ‘ব্ল্যাক ডগ’ হুইস্কির নামের পেছনে যেমন কোনও প্রভুভক্ত কুকুরের জন্য মন কেমন করার গল্প নেই। ওয়াল্টার মিলার্ড নামে এক স্কট সাহেব, ভারত থেকে স্কটল্যান্ড ফেরত গিয়েছিলেন সেরা হুইস্কির খোঁজে। অনেক তল্লাশির পর তিনি জেম্স ম্যাকিনলে’র তৈরি একটা ‘ব্লেন্ড’ খুঁজে পেয়েছিলেন। মিলার্ড এই হুইস্কির নাম দেন তাঁর প্রিয় মাছ ধরার ছিপ ব্ল্যাক ডগের নামে, যা দিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের নদীতে স্যামন মাছ ধরতেন।

‘হান্ড্রেড পাইপার্স’ হুইস্কির নাম এমন কেন? সেই একশো পাইপ-বাদকের স্মৃতিতে, যারা স্কটল্যান্ডের প্রবাদপ্রতিম বীর যোদ্ধা বনি প্রিন্স চার্লির সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে যেত, সারা দিনের যুদ্ধের পর তাঁর বিশ্রামের সময় বাজনা বাজিয়ে তাঁকে আরাম দিতে। প্রস্তুতকারকরা দাবি করেন, এই হুইস্কি কয়েক পাত্র পেটে পড়লে এখনও বহু দূর থেকে ভেসে আসা পাইপের বাজনা শুনতে পাওয়া যেতে পারে!

ছোটবেলা থেকে প্রাণ বা প্রেমনাথকে হিন্দি ছবিতে যে সবুজ রঙের বোতল থেকে হুইস্কি খেয়ে প্রবল ভিলেনি করতে দেখেছি, সেই ‘ভ্যাট সিক্সটিনাইন’-এর নাম দেওয়ার ব্যাপারটা বেশ মজার। ১৮৮২ সালে উইলিয়াম স্যান্ডারসন একশো পিপে বিভিন্ন রকম ব্লেন্ডেড হুইস্কি তৈরি করে, এক দল বিশেষজ্ঞকে ডাকেন সেগুলো পরখ করার জন্য। ৬৯ নম্বর পিপের হুইস্কি সেরা হুইস্কি নির্বাচিত হয়েছিল সবার মতে। সেই বিশেষ ব্লেন্ডেড হুইস্কিই আজকের ভ্যাট সিক্সটিনাইন।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে, ব্রিটেনের বিখ্যাত হুইস্কি প্রস্তুতকারক শিভাস ব্রাদার্স একটি হুইস্কি সেই দিন বাজারে ছাড়েন। রানিকে সম্মান জানাতে বোতলের ওপর রাজসিন্দুকের ছবি ছিল, আর এই হুইস্কির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রয়্যাল স্যালুট’।

‘ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’ হুইস্কি বোতলের অতিপরিচিত ও জনপ্রিয় সাদা আর কালো টেরিয়ার কুকুর দুটোর ছবি কিন্তু এই হুইস্কির যৌবনকাল অবধি ছিল না। জেমস বুকানন প্রথম বুকানন ব্লেন্ড তৈরি করার কিছু দিনের মধ্যেই হুইস্কিটি তার স্বাদ আর ধারাবাহিকতার গুণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এতটাই সুনাম হয়, হাউস অব কমন্স-এ স্কচ পরিবেশনের বরাত পেয়ে যান বুকানন। তখন এর নাম ছিল বুকানন’স হাউস অব কমন্স হুইস্কি। বোতলের রং ছিল কালো, আর তাতে সাদা লেবেল-এ হুইস্কির নাম লেখা থাকত। সাধারণ মানুষ দোকানে কিনতে গিয়ে অত বড় নাম না বলে, এক সময় ‘ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’ হুইস্কি চাইতে শুরু করল। বুকানন যখন দেখলেন, আসল নাম ক্রেতারা প্রায় ব্যবহারই করছে না, উনি বোতলের লেবেলে এক কালো স্কটিশ টেরিয়ার আর সাদা ওয়েস্ট হাইল্যান্ড টেরিয়ারের ছবি যোগ করেন। সেই থেকে এই ছবিটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট হুইস্কির মোটিফ হয়ে গেল।

ইংরেজিতে গ্রাউস মানে রাগ। ম্যাথিউ গ্লগ ১৮৯৭ সালে যে ‘ফেমাস গ্রাউস’ হুইস্কি তৈরি করেন, তার নাম কিন্তু মাতাল স্বামীর প্রতি স্ত্রীর রাগকে মনে রেখে নয়। গ্লগ এর নাম দেন স্কটল্যান্ডের জাতীয় পাখি রেড গ্রাউসকে সম্মান জানিয়ে।

‘ওল্ড স্মাগলার’ হুইস্কি ১৮৩৪ সালে প্রথম তৈরি হয়। আর এর নাম দেওয়া হয় সেই স্কটিশ স্মাগলারদের সম্মান জানিয়ে, যারা ১৮২৩ সালে হুইস্কির আইন পাশ হওয়ার আগে ১০০ বছর ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের অন্ধকারে হুইস্কি তৈরি করত আর দিকে দিকে পাঠিয়ে দিত, যাতে সুরাপ্রেমীরা বঞ্চিত না হয়।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

বসে আছি বসের ঘরে। হুগো বস। আশি বছরের উপরে বয়েস। জার্মানদের মধ্যে ‘বস’ পদবি বিরল নয়। ‘বস’ নামের একটা বিখ্যাত পারফিউম আছে। আমার সঙ্গে রয়েছেন সুনীল দাশগুপ্ত। উনিও বৃদ্ধ। সুনীলবাবুই আমাকে নিয়ে এসেছেন বস-বাড়িতে।

কয়েক বছর আগে জার্মানি যাওয়ার একটা সুযোগ হয়েছিল, তিন সপ্তাহ ছিলাম বার্লিনে। প্রয়াত জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় আমাকে সুনীল দাশগুপ্তর হদিশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সুনীলদা খুব ভাল কমরেড।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

ইঞ্জিনিয়ার সুনীলদা চাকরি নিয়ে জার্মানি গিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি করতেন তার আগে। হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বারবারা নামে এক মহিলার সঙ্গে আলাপ হয়, তিনিও বামপন্থী। ১৯৪৯-এ জার্মানি ভাগ হলে দুজনেই পূর্ব বার্লিনে চলে যান। কারণ ওখানে বামপন্থা বিরাজিত। ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেওয়াল ভেঙে গেল, পরের বছর বিভক্ত জার্মানি জুড়ে গেল। কিন্তু এখনও পূর্ব বার্লিনের চরিত্র একটু আলাদা। সার সার পাঁচতলা বাড়ি। বোঝা যায় সরকারি আবাসন। রাস্তাঘাটেও ঝিনচ্যাক কম।

সুনীলবাবুর বাড়িটা পূর্ব বার্লিনের এক প্রান্তে। সরকারি আবাসনে। পুরনো সরকারের সময়ে কম ভাড়ায় থাকা যেত। এখন কিনে নিতে হয়েছে। ঘরের দেওয়ালে লেনিনের ছবি নিভৃতে। নিজেই কফি করে দিলেন। বললেন, বারবারা গেছে ডেন্টিস্টের কাছে। ষোলো কিলোমিটার দূর। অড্ জায়গা। দু’বার ট্রেন পালটাতে হয়। ‘কাছাকাছি ডেন্টিস্ট নেই?’ কাছাকাছি কোনও কমরেড ডেন্টিস্ট নেই। ইউনিফিকেশনের পর দেশটা যা-তা হয়ে গেছে। ডেন্টিস্টও বামপন্থী হতে হবে? আশ্চর্য হই। ‘মাছ-তরিতরকারি কী করেন? কমরেড দোকানদার আছে?’ তা হয়তো নেই, তবে আমি ওয়ালমার্ট, কস্টকো’দের স্টোরে যাই না। কষ্ট করে একটু দূরে গিয়ে বাজার করে নিয়ে আসি। ছোট দোকানদার। কী করব বলো, যতটা পারা যায় নিজেকে ঠিকঠাক রাখার চেষ্টা করি। জ্যোতিপ্রকাশদের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বললেন, ওকে বোলো, আমার সমস্যাটার সমাধান হল না। জ্যোতিও পারল না। বড্ড ডিপ্রেশনে আছি।

সমস্যাটা শুনলাম। উনি পূর্ব জার্মানিতে থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্য চাঁদা তুলতেন, এবং ভারতে পাঠিয়ে দিতেন। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানির অস্তিত্ব শেষ হয়ে গেল, কিন্তু ওঁর হাতে তখনও পাঁচ হাজার মার্ক পড়ে আছে। নতুন সরকার হওয়ার পর ওই মার্ক কারেন্সি ভারতে পাঠানো সম্ভব হল না। টাকাটার একটা গতি করার জন্য উনি ইন্দ্রজিৎ গুপ্তকে চিঠি লিখেছিলেন, চতুরানন মিশ্র, এ বি বর্ধন, কাউকেই বাদ রাখেননি। ইতিমধ্যে জার্মানিতে ইউরো চালু হয়ে গেল। পরের টাকা কোন অধিকারে ইউরোতে পরিবর্তন করবেন? তা ছাড়া টাকার উৎসও জানাতে হত। অসুবিধে ছিল। টাকাগুলো ওঁর কাছেই থেকে গেল শেষ পর্যন্ত। ওঁর আলমারিতে ওঁর টাকা নয়, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির টাকা। ছি। ঘুম হচ্ছিল না, খিদে হচ্ছিল না, সেই যে সিডেটিভ ট্যাবলেট খাওয়া শুরু হল—এখনও চলছে। আলমারিটা খুললেই একটা বিচ্ছিরি অস্বস্তি হত বলে বারবারা টাকাগুলো হুগোর কাছে রেখে এসেছেন।

সুনীলদা এ বার হুগোর গুণগান করতে শুরু করলেন। বললেন, হুগো আমার খুব ভাল বন্ধু। বাঙালিদের খুব পছন্দ করে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের। কারণ এত দিন ধরে এই বাঙালিরা ওদের স্টেটে একটা কমিউনিস্ট গভর্নমেন্টকে টিকিয়ে রেখেছে। হুগোর বাড়িতে লাঞ্চ খেতে গেলাম। দেওয়ালে তিনটে ছবি। মার্ক্স, লেনিন, আর এক জনকে চিনি না। জিজ্ঞাসা করে জানলাম উনি হোনেকার। সমাজতান্ত্রিক জার্মানির সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টির সর্বেসর্বা ছিলেন। মি. হুগো বস আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ওয়েলকাম ম্যান ফ্রম দি স্টেট অব জাটি বস। বুঝলাম জ্যোতি বসুকে বোঝাচ্ছেন। বললেন ১৯৯৬ সালে কলকাতা গিয়েছিলেন। সারা শহরে রেড ফ্ল্যাগ দেখে ওঁর মন ভরে গিয়েছিল। জাটি বস’কে এক বার চাক্ষুষ দেখার ইচ্ছে হয়েছিল, পূর্ণ হয়নি। আজকের লাঞ্চের উপলক্ষ হল রিপাবলিক ডে সেলিব্রেশন। ১৯৪৯-এর ৭ অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক জার্মানির সংবিধান লাগু হয়েছিল।

আরও কয়েকজন বৃদ্ধ কমরেড এসেছেন। বস প্রথমে শরবত খাওয়ালেন। কোক বাড়িতে ঢোকে না। ক্যাডবেরিও না। খুঁজে খুঁজে ‘হ্যালোরেন’ চকলেট নিয়ে আসেন। হ্যালোরেন জার্মান কোম্পানি, পূর্ব জার্মানিতেই কারখানা। একটা দেরাজের দরজা খুলে দেখালেন ভাঁজ করা সমাজতান্ত্রিক জার্মানির জাতীয় পতাকা, আর একটা লাল ঝান্ডা। কাস্তে হাতুড়িটার উপরে চুপ করে বসে আছে কয়েকটা ন্যাপথালিনের গুলি। দেরাজ খুলে একটা বোতল বার করলেন। বললেন, স্নোপিস্টি হুইস্কি। তিরিশ বছরের পুরনো, সমাজতান্ত্রিক। দিনে রাশিয়ান ভদকা খেলেই হত, কিন্তু পুতিনের ভদকা খেতে চাইছেন না এই কমরেডরা। হুইস্কিটাকে বহু দিন বাঁচিয়ে রেখেছি। আর ক’দিন বাঁচব? অসপিশাস্ অকেশনে...

যাওয়ার আগে আমাকে এক শিশি কোলন উপহার দিলেন মি. হুগো। টোস্কা। পূর্ব জার্মানির সময়ের কোম্পানি। আর সুনীলবাবু বললেন, টাকাগুলো নিয়ে যাও। পার্টি অফিসে ছুড়ে ফেলে দিও। পারলে আমিই দিয়ে আসতাম, কিন্তু প্রতিবন্ধী ছেলেটাকে ফেলে কোথাও যেতে পারি না। ছেলেটা আমার পার্টির মতোই অসহায়। হুগো বললেন, মি. জাটি বস’কে আমার রেড স্যালুট জানিও। সুনীলদা কিংবা হুগো বস কারও অনুরোধই রাখতে পারিনি।

swapnoc@rediffmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy