ক্ষীর-পায়েস
বিজয়ার মিষ্টিমুখে যে বাড়িতে এক জামবাটি ক্ষীর ধরিয়ে দেয়, তাঁরা হলেন গিয়ে সব দেবমানুষ, পুণ্যপুরুষ, খাঁটি ভারতীয়ের বংশধর। দুধের সঙ্গে কিছুমিছু মিশিয়ে, (যেমন চাল, চালের গুঁড়ো, সিমাই বা ফল) তাতে মিষ্টি দিয়ে, পরম সুস্বাদু বানিয়ে শেষ পাতে কিস্তিমাতের এই রীতি যে সেই প্রাক্-বৈদিক যুগ থেকে চলছে। ঘন থাকতে পরিবেশন করলে বলা হয় ক্ষীর, আর ঘনত্ব কমিয়ে পাতলা করে বাটিতে ঢাললেই নাম হয়ে যায় পায়েস। তবে চাল আর দুধ তো এ মহাদেশের সব দেশেই সেই কবে থেকে রয়েছে, তাই কোন দেশ যে প্রথম ক্ষীরের সোয়াদ পেয়েছিল— বলা বড় শক্ত।
পারস্যে দুধকে ‘শির’ বলে। সেখানে ক্ষীর বানিয়েই কাজ খতম নয়। আসল বাহাদুরি ছিল নিত্যনতুন রকমের ক্ষীর বানিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করলে। সেই দেশ থেকেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে সিমাইয়ের পায়েস, গাজরের হালুয়া, ফিরনি আর আরও অনেক ধরনের ক্ষীর। ও দিকে মুঘল বাদশাদের হাত ধরে ফিরনি জনপ্রিয় হলেও তা তৈরিতে মুঘলদের কেরামতিই নেই। পারস্যদেশে চালের গুঁড়োর সঙ্গে দুধ মিশিয়ে তাতে গোলাপজলের খোশবো আর পেস্তাবাদাম ছড়িয়ে ফিরনি তৈরি হচ্ছে হাজার বচ্ছর ধরে। পারস্যের বিখ্যাত ক্ষীর ‘শির বিরিঞ্জ’। লোককথা বলে তা দেবদূতদের ভারী প্রিয় খাবার। হজরত মহম্মদ সপ্তম স্বর্গে ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করতে গেলে, তাঁকে ‘শির বিরিঞ্জ’ খেতে দেওয়া হয়েছিল।
প্রচলিত বিশ্বাস, দক্ষিণ ভারতের আম্বালাপ্পুজা মন্দিরে প্রথম পায়েস তৈরি হয়। গপ্পে আছে, সেখানকার রাজা সারা দিন দাবা খেলায় মত্ত থাকতেন। রাজ্যে এক বার প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ। লোকে না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে, কিন্তু রাজার কোনও হেলদোল নেই, তিনি বোড়ে আর গজে এমনই মজে যে প্রজার আর্তি তাঁর কানে ঢুকছেই না। তাদের প্রাণ বাঁচাতে আসরে নামলেন স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ। গরিব ব্রাহ্মণের বেশে তিনি রাজপ্রাসাদে এসে রাজাকে দাবা খেলায় চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। খেলার শর্ত দিলেন যে তিনি জিতলে দাবার প্রথম ঘরে এক দানা চাল রেখে তার পর বাকি ঘরগুলোয় তার দ্বিগুণ করে চাল দিতে হবে— প্রথমটায় একটা চাল, দ্বিতীয়তে দুটো, তৃতীয়তে চারটে, চতুর্থয় আটটা— এই ভাবে। রাজা এই অদ্ভুত শর্ত শুনে হাসলেন আর মেনে নিলেন এই ‘যৎসামান্য’ বাজি। তার পর তো দাবাতে হারলেন আর ব্রাহ্মণের দাবি মেটাতে গিয়ে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। চল্লিশ ঘরে পৌঁছতেই রাজ্যের সমস্ত শস্য ভাঁড়ার ফাঁকা হয়ে গেল আর শেষ ঘরে পৌঁছে দেখা গেল রাজার কাছে ব্রাহ্মণের প্রাপ্য ১,৮৪,৪৭,৭৪৪ ট্রিলিয়ন টন চাল! রাজা বুঝলেন, ব্রাহ্মণ কোনও সামান্য মানুষ নন, তিনি সপাটে গিয়ে পড়লেন তাঁর পায়ে। শ্রীকৃষ্ণ তখন নিজ রূপ ধারণ করে বললেন, চাল ফেরত দিতে হবে না। বদলে আম্বালাপ্পুজার মন্দিরে কোনও ক্ষুধার্ত শরণার্থী এলে তাঁদের যেন এক বাটি করে ক্ষীর দেওয়া হয়। সেই থেকে আম্বালাপ্পুজার মন্দিরে আজও ক্ষীর (পায়েস) বিতরণ করা হয়। আর আমাদের ঘরের কাছের পুরীতে ক্ষীর বানানো হয় ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড়’ (অনেকেরই তেমনই দাবি) রান্নাঘরে— জগন্নাথ মন্দিরের রান্না-কুঠুরিতে। রোজ দশ হাজার লোকে প্রসাদ পায় তার থেকে!
ইউরোপে ক্ষীর বা ‘রাইস পুডিং’ ছিল বড়লোকদের খাবার, কারণ ‘রাইস’ ও-সব জায়গায় প্রায় পাওয়াই যেত না। দুই হাজার বছর আগে থাকতে রোমানরাও ক্ষীর খেত, কিন্তু সেটা ও দেশে কোনও মিষ্টান্ন ছিল না। পেটের গোলমাল হলে ওষুধ হিসেবে খাওয়া হত। এক্কেবারে ‘পাগলা ক্ষীর খা’ কেস!
ছবি: শুভেন্দু চাকী
সৌজন্য: শেফ প্রদীপ রোজারিও
pinakee.bhattacharya@gmail.com
আর তিনটে বছর বাঁচাটা দরকার
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
রাজেনদা আকাশবাণীর ঘোষক ছিলেন, অবসর নিয়েছেন অনেক দিন। খুব সাদাসিধে মানুষ। সাদা মনে কাদা ছিল না বলেই টিফিন বাক্সের লুচি লুঠ হয়ে গেলে বলতেন, কী আর করব, ভাবব ভূতে খেয়েছে। কুকুরে খেয়েছেও বলতে পারতেন, ভূতের বেশি নামতে পারতেন না। সরল লোক বলে ভূতের ভয়টাও ছিল। আকাশবাণীর স্টুডিয়োতে পেল্লায় সাইজের এক জোড়া পিয়ানো আছে। সেই সঙ্গে একটা গল্পও আছে: মিউজিশিয়ান সাহেব-ভূত এসে পিয়ানো বাজিয়ে দিয়ে যায়। পাশের ঘরে নাইট ডিউটি’তে শোওয়া হত। আমাদের এক সহকর্মী পিয়ানো-ঘরে টেপরেকর্ডারে পিয়ানো চালিয়ে দিয়ে রাজেনদাকে বলেছিল: ওই শুনুন, পিয়ানো বাজছে, কিন্তু কেউ বাজাচ্ছে না। রাজেনদা ভয় পেয়েছিলেন এবং আর নাইট ডিউটি করতে চাইতেন না।
রাজেনদা কবিতা আবৃত্তি করতেন। অন্তরঙ্গ কাউকে সেই আবৃত্তি শোনাতেন। নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করতেন, আবৃত্তিটা অমুক ঘোষের চেয়ে খারাপ হয়েছে? তখন ঘোষক গোষ্ঠীতে ঘোষদের আধিপত্য। পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, দিলীপ ঘোষ, শংকর ঘোষ, এঁরা ছিলেন দিকপাল ঘোষক। পরবর্তী কালে এঁদেরই ‘বাচিক শিল্পী’ বলা হতে লাগল। রাজেনদাও বাচিক শিল্পী হয়ে ওঠার বাসনাকে মনের খাঁচায় বন্দি করে দানা খাওয়াতে লাগলেন। রিটায়ার করার কিছু দিন আগে, এক মধ্যরাতে নিঃশব্দ নির্জন স্টুডিয়োতে বসে নিজের ক্যাসেট রেকর্ডারে দশটা কবিতা রেকর্ড করলেন। আমি জেনেছিলাম। উনি সলজ্জ কৈফিয়তে বলেছিলেন, বাড়িতে নয়েজ হয়, এখানে ভাল করে করলাম। নাতি-নাতনিরা শুনবে।
রাজেনদার সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা বড় ডাক্তারের চেম্বারে, সঙ্গে ওঁর বড় ছেলে। অসুস্থ লাগছিল, বাইপাস হয়েছে। ওঁর ছেলে বলেছিল, আমি যদি ওঁকে বাড়ি পৌঁছে দিই, ও তবে অফিস যেতে পারবে। তার পর আমি আর রাজেনদা, বহু দিন পর।
রাজেনদা বলেছিলেন, বাইপাসের পর উনি বড় কষ্টে আছেন, ওঁর স্ত্রী ঘি-মাখন-ডিম কিচ্ছু খেতে দেন না। ‘হিঞ্চে সেদ্ধ, উচ্ছে ভাতে, চারাপোনার ঝোল— কত দিন পারা যায়? চল, দুঃখের কথা দিয়ে একটু চা খাই।’
একটা বেঞ্চিতে বসলাম, ফুটপাতের চা দোকান। ডিম ভাজার গন্ধ।
রাজেনদা বললেন: ওহ্ কী গন্ধ, পারা যায়? দুটো ওমলেট বলে দে না রে, আজ আমি ফ্রি। কী আনন্দ।
ভাবলাম, এক দিন একটু ডিম খেলে কী এমন ক্ষতি হবে! বললাম, দুটো ওমলেট। রাজেনদা জুড়লেন: কাঁচা লংকা বেশি দিও, মরিচগুঁড়ো ছড়িয়ে। ওমলেট মুখে পুরে দিব্যখুশিতে মুখটা বিভাময় হয়ে ওঠে রাজেনদার। তার পর চা খেয়ে নিজেই একটা সিগারেট কিনে ধরালেন। একটা সুখটান, মৃদু কাশি, মুখে হাসি। বলি, এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। রাজেনদা বললেন কিস্সু হবে না, নর্দমা সাফ। মানে বাইপাস হয়ে গেছে। কোনও ব্লক নেই আর। বহু দিন ধরেই ভাবছিলাম চা খেয়ে একটা সিগারেট খাব...।
বলি, আর কী কী ইচ্ছে বাকি রয়ে গেল, রাজেনদা?
রাজেনদা হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেলেন। ‘আমাকে আরও তিনটে বছর বাঁচতে হবে। নাহ্, আর এমন দুষ্টুমি করব না। বাঁচাটা দরকার।
— কেন? তিন বছর পর কী হবে?
— পেনশনের কিছুটা কমিউট করেছিলাম, টাকা নিয়ে নিয়েছিলাম। রিটায়ারমেন্টের পর চোদ্দো বছর পার হয়ে গেলে টাকা কাটা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন পুরো পেনশন।
আমি বলি, আর তিনটে বছর বাঁচলেই আপনি খুশি!
ঘাড় নাড়ালেন। একটা পান। সামান্য জর্দা, কেমন? ব্যস। আর না। তিনটে বছর আরও বাঁচাটা দরকার। আর শোন, আমার বাড়িতে তোর বউদিকে এ সব কিছু বলবি না। দু’পিস আলুর দম খেয়ে যাই, কেমন? বাড়িতে কিছুতেই এমন আলুদ্দম হয় না রে...।
আলুর দমের পর ওঁর বাড়ি। বলেছিলেন: এসো মাঝে মাঝে। কাছেই তো থাকি: একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশিরবিন্দু।
সম্প্রতি গেলাম। বলি, খুশি তো? ফুল পেনশন পাচ্ছেন? ফুল ফুটল রাজেনদার মুখে। তিন হাজার বেশি পাচ্ছি রে ভাই। কিন্তু, মুসুর ডাল হয়ে গেল দেড়শো টাকা কিলো। এখন মনে হচ্ছে আরও ছ’টা বছর বাঁচা দরকার। আশি বছর হয়ে গেলেই বিশ পার্সেন্ট পেনশন বেড়ে যাবে। এইট্টি ক্রস করার পর আর তিনটে বছর। এইট্টি থ্রি। ব্যস। তত দিনে ইঁদুর ধরে ফেলব। ‘মানে?’
— জীবনানন্দের ওই কবিতাটা রে...। বুড়ো পেঁচা বলেছিল ‘চমৎকার! ধরা যাক দু একটা ইঁদুর এবার—’ আসলে সাধ-আহ্লাদ। মনে আছে তোর, সেই কবে, রাত গভীরের নির্জনে কয়েকটা কবিতা রেকর্ড করেছিলাম, ভেবেছিলাম ক্যাসেট বের করব। তখন ছিল ক্যাসেটের যুগ। যা টাকা চাইল, দিতে পারলাম না। রিটায়ার করার পর যা টাকাকড়ি পেলাম, মেয়ের বিয়েতে আর এই ছোট ফ্ল্যাটটাতে ফতুর। তার পর ক্যাসেট-যুগ শেষ, সিডি-যুগ এল। রেকর্ড করে রাখা কবিতাগুলো সিডি করতে যা খরচ, সেটা ম্যানেজ হল না। ভেবেছিলাম, আশি বছর হয়ে গেলে অক্টোজেনারিয়ানদের বেশি পেনশন। তখন জমাবই। তিন বছরের মাথায় সিডি’টা। এইট্টি থ্রি’তে আমাদের বিয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে। তোর বউদিকে বিয়ের দিনে সারপ্রাইজ দেব। বিহারীলাল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শক্তি, সুনীল...। আমার লেখাও একটা ছিল। সবগুলোই প্রেমের কবিতা, বুঝলি না?
swapnoc@rediffmail.com