Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:০৫

আলু

পিনাকী ভট্টাচার্য

আলুর তল্লাশি করতে গিয়ে প্রায় দশ হাজার বছর ব্যাক গিয়ারে গেলাম। কিন্তু রাস্তা পরিষ্কার দেখাচ্ছে ২০০০ বছর আগে থেকে। তখন ইনকা-রা ঝোলে-ঝালে-অম্বলে সব কিছুতেই আলু দিত। হাড় ভেঙে গেলে কাঁচা আলুর রস লাগাত, অন্যান্য খাবারের সঙ্গে আলু খেত হজম করতে, বাতের প্রতিষেধক হিসেবে সঙ্গে আলু নিয়ে ঘুরত, সময় পর্যন্ত মাপত আলুর ফলন কবে হচ্ছে সেটা হিসেব করে। ১৫৩৭ সালে স্প্যানিশ যুদ্ধবাজদের হাতে ইনকা রাজ্যের সঙ্গে উঠে এল আলু। তা নিয়ে স্প্যানিশরা নিজেদের দেশের দিকে রওনা দিল।

ইউরোপে আলু এসে পৌঁছলে শুরু হল থরহরিকম্প! মানুষ ভেবেছিল, আলু শারীরিক উত্তেজনা ভয়ানক বাড়িয়ে দেয়। তারই পরিণাম সিফিলিস আর কুষ্ঠ। দীর্ঘ দিন ধরে জলে ভাসা নাবিকেরা বিভিন্ন বন্দরে নেমে এই সব রোগের জীবাণু শরীরে নেয়, ঘরে ফিরে লক্ষ্মী ছেলের মতো দোষ চাপায় আলুর ঘাড়ে। নিরীহ জনতা মেনেও নিত। কারণ তখনও আলু ছিল এক্কেবারে অপরিচিত। কিন্তু অচিরেই ভুল গেল ভেঙে। আলু তার গুণাগুণ দেখিয়ে স্পেনের সেনাবাহিনীর রোজকার রসদে পাকাপোক্ত জায়গা করে ফেলল। ও দিকে স্পেন সাম্রাজ্য তখন বিক্ষিপ্ত ভাবে সারা ইউরোপেই ছড়িয়ে। সেনাবাহিনীর পিঠে চেপে আলু ছড়িয়ে পড়ল গোটা মহাদেশে।

জার্মানির রাজা ফ্রেডরিখ উইলিয়াম আলু খেয়ে মোহিত হয়ে গেলেন। তিনি সমস্ত প্রজাকে আদেশ দিলেন, আলুর চাষ করে গান্ডেপিন্ডে আলু খেতে। অবাধ্য হলেই নাক কেটে নেবেন! নাক যাওয়ার ভয়ে সব্বাই মিলে আলু চাষ শুরু করল। দেশে ও দেশের বাইরেও আলু উপচে পড়তে লাগল। প্রাশিয়ার লোকে যুদ্ধক্ষেত্রেও রসদ হিসেবে আলু নিয়ে যেতে শুরু করল।

আঠেরো শতকের মাঝামাঝি যখন ফ্রান্স আর জার্মানির মধ্যে সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধ শুরু হল, আর লোক না পেয়ে ফরাসি সরকার পেশা-নেশা নির্বিশেষে সবাইক্কে ঝেঁটিয়ে নিয়ে যুদ্ধ করতে নিয়ে গেল। আঁতোয়াঁ পারমেঁতিয়ের নামে এক ফরাসি ডাক্তারকেও যুদ্ধ করার জন্যে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। ফল যা হওয়ার— ডাক্তার যুদ্ধবন্দি। তাকে শুধু আলু খেতে দেওয়া হত। প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পারমেঁতিয়ের সাহেবের আলুর স্বাদ পছন্দ হয়ে গেল, আর ক্রমে আলুর প্রেমেও পড়ে গেলেন। সে প্রেম এতই ঘন হয়ে উঠল যে ডাক্তার ছাড়া পেয়ে দেশে ফিরে রাজা চতুর্দশ লুই, রানি মেরি আঁতোঁয়ানেত থেকে বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন, এমনকী আমজনতাকে আলুর স্যুপ সমেত আলুর নানা উপাদেয় রান্নার সঙ্গে মোলাকাত করিয়ে দিলেন।

ভারতবর্ষে আমরা প্রথম আলুর উল্লেখ পাই এডওয়ার্ড টেরি’র লেখায়। ব্রিটিশ রাজদূত স্যর টমাস রো’র সম্মানে ১৬৭৫ সালে আসফ খান আজমেঢ়ে যে ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন, তাতে আলু পরিবেশিত হয়েছিল।

আমার কাকা হিমঘরের লোন স্যাংশন করে দিয়েছিল বলে, মালিক দুই বস্তা আলু পাঠান। কাকা সেই বস্তা ফেরত পাঠালে লোকটি কাকাকে বুঝিয়েছিলেন, আলু কেউ ঘুষ দেয় না— উপহার দেয়। আলুর তল্লাশ করতে গিয়ে জানতে পারলাম, স্যর ওয়াল্টার র‌্যালে নজরানা হিসেবে রানি প্রথম এলিজাবেথকে তাঁর নিজের জমিতে ফলানো আলু উপহার দেন। তা হলে, সেই হিমঘরের মালিক ঠিকই বলেছিলেন।

পুনশ্চ: প্রথম বার আলু দেখে রানি এলিজাবেথের বাবুর্চি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল। কী করবে, কী ভাবে রান্না করবে বুঝতে না পেরে আলুর গাছটা রেখে আলুকে আবর্জনা ভেবে ফেলে দিয়ে এসেছিল।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

বোল্টের স্পিডে রুগি দেখা শুরু

সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের নাকি সে রকম কোনও কাজ নেই, ‘আসি-যাই-মাইনে পাই’-এর আসা যাওয়ার পার্টটাও নাকি উঠে গেছে। তাই ২০০৭-এর ভরা বাম আমলে যখন জেলা হাসপাতালের সার্জেন হিসেবে পোস্টিং পেলাম, প্রথমেই বিদেশে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুকে (যার উইকএন্ডে স্ত্রীর সাথে লং ড্রাইভে যাওয়া বা কাজ শেষে দুজনের সময় কাটানোর গল্প গিলতে গিলতে হিংসেয় নীলকণ্ঠ হয়ে যাচ্ছিলাম) খবরটা জানালাম। কিন্তু খুশির বেলুন চুপসাতে শুরু করল অফিস স্টাফ মৃত্যুঞ্জয় ডিউটি রোস্টার শোনাতে শুরু করার পর। সপ্তাহে দু’দিন অ্যাডমিশন ডে, মানে চব্বিশ ঘণ্টায় যখনই ডাকবে তখনই যেতে হবে, সপ্তাহে একটা এমার্জেন্সি ডিউটি, একটা অপারেশন ডে, মাসে এক দিন পোস্টমর্টেম বা অগুনতি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দেওয়া, আর রোজ সকাল-সন্ধ্যা রাউন্ড। মৃত্যুঞ্জয়কে সব ডাক্তাররা কেন ‘মৃত্যু’ বলে ডাকে, বুঝতে পারছিলাম। মৃত্যু অর্ধ-নিমীলিত চোখে জানাল, আমাকে বেশ কয়েকটা বনের মোষ বিতাড়ন কমিটিতেও থাকতে হবে। ছুটি? ‘অফিসারদের আবার ছুটি কী! আপনার কলিগকে ম্যানেজ করে যেতে পারেন, কিন্তু কোনও অঘটন ঘটলে কোম্পানি দায়ী থাকবে না। এখন পাবলিকের হাতে কোনও কাজ না থাকলে একটু-আধটু ডাক্তার ঠেঙিয়ে নেয়। সুযোগ পেলে আপনার কলিগই দু-চার ঘা বসিয়ে দিতে পারে। কেন যে মরতে এখানে এলেন!’

প্রথম অ্যাডমিশন ডে পড়ল আমার জন্মদিনের আগের দিন। কোনও এক দুর্বোধ্য কারণে আউটডোরের পেশেন্ট দেখতে হয় হাসপাতাল থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের আর একটা ইউনিটে। লম্বা একটা আঁকাবাঁকা লাইন, ভাবলাম, ভুল করে বোধহয় কোনও সিনেমা হলের সামনে চলে এসেছি, বোধহয় শাহরুখ খানের সিনেমার ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো চলছে। ভুল ভাঙার পর যে স্পিডে পেশেন্ট দেখা শুরু করলাম, তাতে উসেইন বোল্টও লজ্জা পেয়ে যাবে। পৌনে দুটোর সময় আউটডোর যখন প্রায় শেষ করে এনেছি, ভক্তিনগর (যেখানে অপারেশন থিয়েটার আর সার্জারি ওয়ার্ড) থেকে ফোন: ‘ডাক্তারবাবু, ইনজুরি ঢুকেছে, আসতে হবে।’ ছুটে গেলাম। এক জনের পিঠে ছ’টা কোপ, পিঠের স্ক্যাপুলা নামের হাড়টা সব মাস্‌ল ভেদ করে দু’টুকরো হয়ে ও.টি-র হাওয়া খাচ্ছে। আমার হন্তদন্ত ছুটে আসা দেখে একটু বিরক্ত হয়েই এক সিস্টার মন্তব্য করলেন: ‘নদিয়া কৃষিপ্রধান জেলা, লোকেদের তো একটু কোপানোর অভ্যেস থাকবেই!’

সব কাজ মোটামুটি গুছিয়ে এনেছি, সুপার সাহেবের কাছ থেকে ফোনটা এল। বাজারের কাছে একটা বাস অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, এখন যেন হাসপাতাল থেকে না বেরোই। পেট খিদেয় চুঁইচুঁই, বউকে ফোন করে বললাম, খেয়ে নাও, আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করে নেব। কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে দেখি, এক সিস্টার এক বাটি মুড়িমাখা আর চা নিয়ে আসছেন। কিন্তু সেও কি আর কপালে আছে! ও.টি-র স্টাফ প্রীতমদা উঁকি দিয়ে জানালেন: ড্যামেজ মালগুলোর ডেলিভারি হয়ে গেছে স্যর! এ বারও পরিত্রাতা সিস্টার: মুড়ি নষ্ট করা যাবে না,খেয়ে উঠতে হবে। মহার্ঘ মুড়ি আর মহামূল্যবান সময় পাঞ্চ করে চটজলদি খেয়ে উঠে ও.টি-তে ঢুকেই মন ভাল হয়ে গেল। দুই সিস্টার পটাপট স্টিচ দিচ্ছেন আর প্রীতমদা ততোধিক ঝটপট পেশেন্ট তোলা নামানো করছেন। এক সিস্টারের হাতের কাজ দেখে বুঝলাম, অনেক সার্জেনকেও লজ্জা দেবে! সাড়ে ছ’টার মধ্যে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে খান দুয়েক আর বড়-মেজো-সেজো নেতাদের খান সাতেক ফোন ছাড়া মোটামুটি নির্বিঘ্নে কাজটা নামিয়ে দিয়ে ওয়ার্ডে গেলাম। সেখানে আর এক নাটক! মারপিট করে ভর্তি এক পার্টি, অনেক খুঁজেও তার ইনজুরি পাওয়া গেল না, কিন্তু প্রচণ্ড উত্তেজিত পেশেন্টের কাছ থেকে জানা গেল, অ্যাসেইল্যান্ট তার শাড়ি-জামা ছিঁড়ে দিয়েছে। বোঝাতেই পারলাম না, দরজির দোকানের বদলে সে ভুল করে মুচির দোকানে চলে এসেছে। একটু দুরে অপোনেন্ট পার্টিও ভর্তি, তারও ইনজুরি তথৈবচ! পরে জেনেছি, এ-সবের জন্য কোর্টে উঠতে হয়, হাজির না হলে ওয়ারেন্টও বেরোয়, সে আর এক বিড়ম্বনা। আজানুলম্বিত দাড়ির এক বৃদ্ধকে পাওয়া গেল— যন্ত্রণায় ছটফট করছেন, আগের রাত থেকে তাঁর হার্নিয়া বেরিয়ে আটকে গেছে। আমি তো অবাক! তাঁর ছেলের কাছে জানতে চাইলাম, এত দেরি হল কেন? সে বলল, চিকিৎসার কোনও ত্রুটিই রাখা হয়নি ডাক্তারবাবু, ব্যথার জায়গায় সিঁদুর লাগানো থেকে শুরু করে গোমূত্র পান, সব হয়েছে। বুঝলাম, এ পেশেন্টকে এক্ষুনি অপারেশন করতে হবে। অ্যানাসথেটিস্টকে খবর দিলাম, তিনি সেই সাড়ে তিন কিলোমিটার দুরে গাইনি ও.টি-তে সিজারে অ্যানাসথেসিয়া দিচ্ছিলেন। সাড়ে দশটায় এলেন, ও.টি. শুরু করলাম। তক্ষুনি ওয়ার্ড থেকে আবার খবর, একটা ‘হাল খারাপ পেশেন্ট’ ঢুকেছে। তবু কিছু করার ছিল না। বৃদ্ধের পেটে যে এত প্যাঁচ, বুঝতে পারিনি। ঘণ্টা দেড়েক ধরে নালি কেটে, তাকে আবার জোড়া লাগিয়ে তার পর দৌড়তে দৌড়তে ওয়ার্ডে গেলাম।

মধ্যবয়সি এক ভদ্রলোক নিস্পৃহ চোখে বসে আছেন। সিস্টাররা তাঁকে বহু বার বাড়ি চলে যেতে বলেছেন, কারণ তাঁর একমাত্র সন্তানের ডেডবডি পাওয়া যাবে পর দিন পোস্টমর্টেমের পর। সবুজ কাপড়ে ঢাকা বছর পনেরোর ছেলেটাকে ভদ্রলোক কালই মোটরবাইকটা কিনে দিয়েছিলেন। অকারণে নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিল।

ক্লান্ত শরীরটা টানতে টানতে এমার্জেন্সিতে এলাম। ডিউটিতে থাকা মেডিকেল অফিসার বললেন, খুব ঝামেলা না হলে রাতে আর ডাকবেন না। বাড়ি ফেরার পথে বউকে ফোনে বললাম, খাবার রেডি করো, খেয়েই শুয়ে পড়ব।

বাড়ির কাছে এসে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ঘর অন্ধকার। লোডশেডিং নাকি? দরজা ঠেললাম, খোলা। গলায় প্রায় হৃৎপিণ্ড আটকানো অবস্থায় ঘরে ঢুকে দেখি, ডাইনিং টেবিলে একটা কেক রাখা, একটা মোমবাতি জ্বলছে। আরে, রাত বারোটা তো বেজেই গেছে, আজ তো আমার জন্মদিন! বউ যখন একটা একটা করে ঘরের আলোগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, মনে হল সেই বিদেশের বন্ধুকে জানাই, আমার হয়তো উইকএন্ড নেই, লং ড্রাইভে ঘোরা নেই, কিন্তু ঘরে ফেরার জন্য সব সময় একটা সুন্দর ঘর আছে।

অনির্বাণ জানা, কৃষ্ণনগর, নদিয়া

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy