Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০৩

গত কাল ভারতে শেষ বার ‘শিশু দিবস’ পালন করা হল। কয়েক বছর ধরেই সমাজবিদরা বলছিলেন, দিনটার দরকার নেই। কারণ, আট বছর হল ভারতে ‘কিড ক্যাপসুল’ স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। বাবা-মায়েরা এখন বাড়িতে রেখে, বোর্ডিং বা স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে বাচ্চাদের মানুষ করেন না। ছ’মাস বয়সে এই ক্যাপসুলে ঢুকিয়ে দেন তাদের। ফলে, সমাজে এখন কোনও বাচ্চা নেই, তাকে নিয়ে হাজারও টেনশন নেই। সন্তানের মধ্যে কোন গুণ থাকবে, কী খাবে, প্রিয় রং কী হবে, কোন সাবজেক্ট পড়বে, কী পেশায় যাবে: ক্যাপসুলের ‘ফিচারস’ সেকশনে সব প্রোগ্রাম করে দিতে হয়। তার পর ক্যাপসুলের মধ্যে আপনাআপনি বাড়তে থাকে সন্তান, মা-বাবার ইচ্ছে মতো। ২৩ বছর পর ক্যাপসুল থেকে পূর্ণবয়স্ক শিক্ষিত সন্তান বেরিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ন্ত বয়সের সমস্যা, টিন-এজ প্রবলেম দেখা যায় না দেশে। মা-বাবার প্রত্যাশা পূরণ করতে না পেরে ও সমবয়সিদের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে ডিপ্রেশনে ভোগার ট্রেন্ড শেষ। জুভেনাইল ক্রাইম, সুইসাইড, শিশু নির্যাতন বন্ধ। সকল স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, ক্রেশ তুলে দিয়ে সেই বাড়িগুলোয় কিড ক্যাপসুল রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। এতে সবাই কমবেশি খুশি। কারণ এর ফলে মা-বাবার কেরিয়ারের ক্ষতি হয় না। কিন্তু, পুরনো চাকরির বদলে কিড ক্যাপসুলের দেখাশোনার ভার পাওয়ায় শিক্ষক ও অধ্যাপকরা হতাশ। এ দিকে, ক্যাপসুল কিডদের নিজের মন, ইচ্ছে, চিন্তাশক্তি কিছুই তৈরি হবে না বলে আগাম জানিয়ে দিয়েছে সরকার। সেই নিয়ে ক্ষোভ দানা বাঁধছে দেশের নানা অংশে। তার মধ্যে শিশু দিবস তুলে দেওয়ার ঘোষণায় কোথাও কোথাও বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। কিড ক্যাপসুল হাউসের সামনে ধরনায় বসেছেন মায়েরা। অভিযোগ, টানা ২৩ বছর তাঁদের মমত্ব থেকে বঞ্চিত করার কল বার করেছে সরকার। ভারত বন্‌ধের ডাক দিয়েছে খেলনা প্রস্তুতকারক, ই-গেম নির্মাতা ও কার্টুন চ্যানেল।

অভিরূপ সাহা, নবদ্বীপ

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

শেল-ফায়ারে আকাশ লালে লাল

১৯৬৫’র সেপ্টেম্বর। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলছে। আমি তখন ক্লাস সেভেনে, ব্যারাকপুরের লাগোয়া ইছাপুর নবাবগঞ্জে, গঙ্গার ধারে, শ্রীধর বংশীধর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে পড়ি। গঙ্গার ঠিক পুব পাড়ে, চওড়া পাকা রাস্তার পরেই আমাদের স্কুল। দিনটা ছিল ৭ তারিখ, মঙ্গলবার। স্কুলে গিয়ে তো আমরা অবাক। ঠিক গঙ্গার পাড়ে, একটা বিশাল যন্ত্র, তার সামনের দিকে একটা বিরাট নল মতো কী যেন— সেইটা বসিয়ে জনা দশেক জওয়ান খুব ব্যস্ত নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষায়। এমন দানবীয় একটা যন্ত্র আর সব ব্যস্তসমস্ত জওয়ান দেখে আমরা স্কুলের যত ছাত্র কৌতূহলে ফেটে যাচ্ছি প্রায়! পারলে একেবারে লেপটে থাকি যন্ত্রটার সঙ্গে। জওয়ানদের ক্যাপ্টেন আমাদের ডেকে নিলেন দড়ি-ঘেরা ওঁদের এলাকার মধ্যে। হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে বললেন, এই যন্ত্রটা হল বিমান বিধ্বংসী কামান— অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্‌ট গান। শত্রু-বিমান হানা দিলে আমরা এই যন্ত্র দিয়ে ওদের গুলি করব। প্রকাণ্ড যন্ত্রটার নানান অংশ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, কী ভাবে শেল ছোড়া হবে। অনেকটা সময় ধরে সব দেখে, সেনাদের সঙ্গে বন্ধুতা পাতিয়ে, আমরা ক্লাসে গিয়ে বসলাম।

সেকেন্ড পিরিয়ড, ইংরেজির ক্লাস। মাস্টারমশাই অধীরবাবু এমনিতে খুব রাশভারী, কিন্তু সে দিন তাঁকেও একটু অন্য ভাবে পাওয়া গেল। ইংরেজি না পড়িয়ে তিনি সে দিন শোনালেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইছাপুরে বোমাবর্ষণের কাহিনি। আমরা গোগ্রাসে গিলছিলাম সেই গল্প। ক্লাস-শেষের ঘণ্টা পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গেই সাইরেন বেজে উঠল কান্নার সুরে। সঙ্গে মুহুর্মুহু বিকট আওয়াজ, অনবরত হয়েই চলেছে। শতাব্দীপ্রাচীন আমাদের স্কুল বিল্ডিং কাঁপতে থাকল। হইচই শুরু হয়ে গেল ক্লাসে। অধীরবাবু আমাদের শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন, পাকিস্তানি বোমারু বিমান এসেছে। অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্‌ট গান থেকে গুলি করা হচ্ছে। শুনেই আমরা একছুটে সেই কামানের কাছে। সেখানে তখন ধুন্ধুমার অবস্থা, জওয়ানরা সবাই মহারণে ব্যস্ত। কামান থেকে ঘন ঘন গোলা ছুটছে, ক্যাপ্টেন চিৎকার করছেন ‘ফায়ার, ফায়ার!’ তাঁর আদেশমাফিক অন্য এক জন সেনা প্যাডেলে লাথি মেরে শেল ফায়ার করে চলেছেন। প্রায় আড়াই-তিন ইঞ্চি ব্যাসের, ফুট খানেক লম্বা এক-একটা শেল। আট ফুট মতো লম্বা একটা নল থেকে আগুনের গোলার মতো বেরিয়ে যাচ্ছে শেলগুলো। দুজন জওয়ান বসে আছেন দুই স্টিয়ারিংয়ে, একটা স্টিয়ারিং নলটাকে ঘোরাচ্ছে ডান থেকে বাঁ দিকে, আর একটা ওপর-নীচে।

১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধের সময়কার কলকাতা। সন্ধে গড়াতেই ব্ল্যাক-আউট ছিল চেনা ঘটনা।

ব্যারাকপুরের দিক থেকে গঙ্গার ওপর দিয়ে তখন ইছাপুরের দিকে এগোচ্ছে এক ঝাঁক পাকিস্তানি বিমান। মতলব সম্ভবত ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতে বোমা ফেলা। দূরবিন চোখে এক জওয়ান বিমানগুলোর অবস্থান বিচার করে স্টিয়ারিং-চালকদের নির্দেশ দিচ্ছেন, অমুক ডিগ্রি রাইট, তমুক ডিগ্রি লেফ্‌ট, এত ডিগ্রি আপ, অত ডিগ্রি ডাউন। ক’জন জওয়ান ব্যারেলের মুখে শেল জোগান দিয়ে যাচ্ছেন, এক একটা শেল ছুটছে আর আমরা হাততালি দিচ্ছি, চেঁচাচ্ছি: ‘মারো, মারো!’ যেন জওয়ানদের সঙ্গে দেশের হয়ে যুদ্ধ করছি আমরাও। এক সময় পাকিস্তানি বিমানগুলো চলে গেল। সেনাদের সঙ্গে লজেন্স, কফি খেয়ে, আনন্দে গর্বে বুক ফুলিয়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম।

সে দিন সন্ধে থেকে ব্ল্যাক-আউট। কী অন্ধকার চারদিক! ঘরের ভেতরে হ্যারিকেনের চিমনির ওপরটুকুও কাগজ দিয়ে ঢাকা, যাতে বাইরে আলো না যায়। বড়দের ইতিউতি জটলায় কেবল যুদ্ধ নিয়েই গুজগুজ। ঘরের আলো-আঁধারিতে বইখাতায় মন দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।

ঠিক রাত ন’টায় আবার বেজে উঠল সাইরেন, সঙ্গে অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্‌ট গান-এর গুলির শব্দ। দৌড়ে উঠোনে এসে দেখি, কামানের এক একটা গোলায় আকাশ ভরে উঠছে লাল আলোয়। কয়েক মিনিট পরেই ব্যারাকপুর এয়ারফোর্স থেকে পর পর কয়েকটা ভারতীয় বিমান আকাশে উড়ল। অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্‌ট গান-এর ফায়ারিংও বন্ধ হল। আবার পুরো আকাশ লালে লাল। দেখি, এ বার ভারতীয় বিমানগুলো থেকেই শেল ছোড়া হচ্ছে, শত্রু বিমানের দিকে। আমরা সবাই উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশযুদ্ধ দেখছি, সঙ্গে তুমুল হাততালি আর লাফালাফি। প্রায় আট-ন’মিনিট এমন চলার পর পাক বিমানগুলো পালিয়ে গেল। একটু পর বাজল অল-ক্লিয়ার সাইরেন। আমরাও শান্ত হলাম।

সাত দিন সব চুপচাপ। পরের মঙ্গলবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, সকাল ন’টায় আবার সাইরেন। আবার গুলি। চারদিকে ছোটাছুটি পড়ে গেল। রাস্তা দিয়ে যাওয়া সাইকেল-আরোহী ভয়ে তাড়াহুড়োয় ধাক্কা দিয়ে বসল পথচারীকে। তত ক্ষণে ফের ভারতীয় যুদ্ধবিমান আকাশে উড়েছে, কিন্তু দিনের আলোয় শেলগুলোকে আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। কয়েক মিনিট চলল ধাওয়া আর গুলি ছোড়া। পাক বিমানগুলোকে দেখলাম পূর্ব পাকিস্তানের দিকে উড়ে যেতে। পালিয়ে যাওয়ার আগে ওরাও শেল ছুড়েছিল পলতায় এয়ারফোর্সের অয়েল ট্যাঙ্কারের ওপর। দাউদাউ জ্বলে, পুড়ে গিয়েছিল সেটা। সে দিনই রাতে সকালের রিপিট টেলিকাস্ট। সপ্তাখানেক পরও ফের হয়েছিল, তবে সে বার স্রেফ গ্রাউন্ড ফায়ারিং-এর দাপটেই পাক বিমানগুলো পালিয়ে গিয়েছিল।

যাটের দশকের ওই একটা বছরেই আমরা জেনেবুঝে গিয়েছিলাম যুদ্ধ কী। ব্ল্যাক-আউট, সাইরেন, এয়ার স্ট্রাইক, চার্জ, ফায়ার, অল ক্লিয়ার— শব্দগুলো জড়িয়ে গিয়েছিল জীবনের সঙ্গে। আজও ভুলিনি।

শতদল ভৌমিক, বেলঘরিয়া, কলকাতা

kantraex@yahoo.co.in

ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 60’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy