Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৪২

পটেটো চিপ্‌স

পিনাকী ভট্টাচার্য

খেলে মেদ বাড়ে, রক্তে চিনি বাড়ে, আলুর অপরাধ অনেক। তবু রোজের খাবার আলুতে ভরা। আজ আলুরই দুই কৃতী সন্তানের গপ্প।

সময়টা ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। বিলাসে ডুবে ছুটি কাটাতে মানুষ চলে যেত নিউ ইয়র্কের সারাটোগা স্প্রিংস-এ। সুন্দর হোটেল, সরাইখানা, স্পা আর রেস্তরাঁতে ভর্তি ছিল সে শহর। সারাটোগা লেকের পাশে মুন্‌স লেক হাউস ছিল শহরের নামী রেস্তরাঁ। সেখানে কাজ করত জর্জ ক্রাম। বিখ্যাত জকি ক্রামের ছেলে। আসল নাম জর্জ স্পেক, কিন্তু বাবার নামকে পদবি বানিয়ে অনেক ঘাটের জল খেয়ে শেষমেশ রান্নাকে জীবিকা বানিয়েছিল, নোঙর ফেলেছিল মুন্‌স লেক হাউসের রান্নাঘরে।

১৮৫৩ সালের গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায় এক খদ্দের এই রেস্তরাঁর বিখ্যাত আইটেম ‘মুন্‌স ফ্রায়েড পটেটো’ অর্ডার করেন। সেই পদ পরিবেশন করলে ভোজনরসিক খদ্দেরের পছন্দই হল না। আলু আরও পাতলা করতে হুকুম দিলেন। আলু পাতলা করে কেটে তা ভেজে আবার পরিবেশন করা হল, কিন্তু সেটাও জনাবের পছন্দ হল না। এ বার ক্রাম গেল রেগে, ভাবল তার রান্নার ক্ষমতাকে অপমান করা হচ্ছে। সে আলুকে এ বার কাগজের মতো পাতলা করে কেটে অনেকটা গরম তেলের মধ্যে ছেড়ে দিল। রেখে দিল, যত ক্ষণ না সেই আলুর টুকরোগুলো শক্ত আর মুচমুচে হচ্ছে। তাতে অনেকটা নুন ছড়িয়ে পরিবেশন করল। সে জানত এই আলুভাজা খদ্দেরের অপছন্দ হবেই, আর এই বার সে পরিষ্কার বলে দেবে যে এই রকম খুঁতখুঁতে কাস্টমারকে সে খুশি করতে পারবে না। কিন্তু ঘটল ঠিক উলটো। খদ্দের মুখে দিয়েই চোখ বন্ধ করল আয়েশে। একটা একটা করে আলুভাজা মৌজ করে খেল, আর শেষে বলল, এটা তার সারা জীবনে খাওয়া সেরা আলুভাজা। এই পদ কয়েক দিনের মধ্যেই সাংঘাতিক জনপ্রিয় হয়ে উঠল ‘সারাটোগা চিপ্‌স’ নামে। জন্ম হল পটেটো চিপ্‌সের।

অল্প দিনের মধ্যেই পটেটো চিপ্‌স সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল আর সবাই এর মালিকানা নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে লাগল। সেই মেজাজি খদ্দেরকে সকলেই নিজের বাপ-ঠাকুরদা বলে দাবি করতে লাগল। আসল আবিষ্কর্তা ক্রামকে সবাই ভুলেই গেল। শেষে বিশ শতকে পটেটো চিপ্‌সের আবিষ্কারকের শিরোপা যখন খুঁজেপেতে ক্রামকে দেওয়া হল, সে আর এই দুনিয়ায় নেই। ১৯১৪ সালেই তার আয়ু শেষ হয়েছে।

আলুর অন্য সন্তান ‘ফ্রেঞ্চ ফ্রাই’। এর ইতিহাস কিন্তু বেশ গোলমেলে। এই পদ তৈরিতে ফরাসিদের কোনও কৃতিত্বই নেই। ফ্রান্সের আলুর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার অনেক বছর আগে, সেই সতেরো শতক থেকে বেলজিয়ামে এই পদ তৈরি হচ্ছে। তবে বেলজিয়াম সেই জমানায় স্প্যানিশ নেদারল্যান্ড নামে পরিচিত ছিল। তখন সে দেশে নদীর মাছ লম্বা করে আঙুলের সাইজে কেটে ভেজে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। শীতকালে নদী জমে বরফ হয়ে গেলে আর মাছ জুটত না। মাছের বদলে আলু লম্বা করে কেটে ভেজে খাওয়া হত। এই জনপ্রিয় পদের সঙ্গে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর আলাপও হয়েছিল অস্ট্রিয়া আর ফ্রান্সের যুদ্ধের সময়, আঠেরো শতকে। যুদ্ধটা যে হচ্ছিল বেলজিয়ামেরই মাটিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজ আর আমেরিকান সৈন্য বেলজিয়ামে এলে এই বিশেষ আলুভাজা খেয়ে মুগ্ধ হয়। কিন্তু যেহেতু তখন বেলজিয়ামে সৈন্যবাহিনীর কথ্য আর সরকারি ভাষা ছিল ফরাসি, অন্য দেশের সেনারা এদের মনে করল ফরাসি লোকজন, আর পদটার নাম দিল ‘ফ্রেঞ্চ ফ্রাই’। খাবার বানাল বেলজিয়াম, আর নাম কিনল ফ্রান্স! একেই বলে ‘নেপোয় মারে দই!’

ছবি: শুভেন্দু চাকী

pinakee.bhattacharya@gmail.com

মুগুরে রক্তের দাগ

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

আমার এক জন সুবর্ণবণিক বংশের বন্ধু আছে, বউবাজার এলাকার ওর বাড়িতে অনেক সুসময় কাটিয়েছি। ওদের বাড়ির একটা ছোট ঘরে প্রচুর আড্ডা হয়েছে, এখনও হয়। ওই ঘরটাকে ওরা মুগুরঘর বলে। ঘরে দেওয়ালে একটা বিবর্ণ বাঁধানো ছবি, আর এক পাশে একটা ছোট বেদি। ঘরটার নাম কেন মুগুরঘর, জিজ্ঞেস করলে বন্ধুটি বলেছিল, শুনেছি এই ঘরে মুগুর পুজো হত। — মুগুর পুজো কেন? ও বলেছিল, শুনেছি এক সময়ে মুগুরগুলো পয়া ছিল। মুগুর নিয়ে আর কথা এগোয়নি, কারণ মুগুর সম্পর্কিত জ্ঞান এমন ছিল না যা চর্চাযোগ্য।

ওদের পারিবারিক বড়ির ব্যবসা ছিল। শুনেছি অনেক আগে দোয়াতের কালির ব্যবসা ছিল। শৈশবের অক্ষর পরিচয়ের বইতে পড়েছিলাম ‘দোয়াত আছে কালি নাই।’ এখন দোয়াত-কলম দুটোই নাই। ওরা কালির বড়ির পর ফাউন্টেন পেনের কালি, তার পর ডটপেনের কালি, পরিবর্তনে বিরক্ত হয়ে কালি ছেড়ে এক ভাই বালির ব্যবসায় চলে গেল, এখন বড় প্রোমোটার। এক ভাই বোতাম-চিরুনি। বন্ধুটি কালিতেই পড়ে রইল। লাল কালি। ‘লক্ষ্মী মার্কা তরল আলতা।’

আমার ওই বন্ধু আমাকে একটা ডায়েরি দিয়েছিল। ডায়েরিটা ওর বাবার। ওদের পুরনো বাড়িটা ‘প্রোমোটিং’ হবে বলে বাড়ির দলিল খুঁজতে গিয়ে ওর বাবার কালো ট্রাংকে অনেক খাতাপত্রর মধ্যে ডায়েরিটা আবিষ্কার করে। আমাকে কয়েকটা পাতা দেখিয়ে বলে— এখানেই আছে মুগুর রহস্যের সমাধান। ডায়েরির পৃষ্ঠার গায়ে ছাপা Feb 4. 1948।

‘আজ মুগুর দুইটি গঙ্গায় ভাসাইয়া দিলাম। মা গঙ্গা, তুমি পাপনাশিনী, কলুষ বিনাশিনী, তুমি আমাদিগের পাপ হরণ করিও। ঘরে লক্ষ্মী-গোবিন্দ থাকা সত্ত্বেও মুগুর জোড়াটিকেই কুলদেবতা জ্ঞানে পূজা করিতাম। প্রতিদিন সকালে চন্দন চর্চিত করিয়া ছাদের টবের ফুল নিবেদন করিয়া তবে চা খাইতাম, কারণ ওই মুগুর জোড়াই ছিল আমাদের ফ্যামিলির পিলার স্বরূপ। আমাদের অন্নদাতা। কলকেতায় যখন পড়া-লেখা শুরু হইল, ইস্কুল কলেজ হইতে লাগিল, তখন আমার পিতামহ কালির বড়ি প্রস্তুত করিতে শুরু করিলেন মলঙ্গা লেনের উঠোনে। বিলাত হইতে ডেকস্ট্রিনের গুঁড়া আনাইয়া তাহাতে রঙ মাখাইয়া মুগুর দিয়া পিটাইতে হইত। অতঃপর বড়ি বানাইয়া ছাদে শুকাইতে হইত। শৈশবে আমি এই রূপে কালির বড়ি বানানোর প্রসেস স্বচক্ষে দেখিয়াছি। আমার পিতা ও মাতাকেও দেখিয়াছি পিতামহর সহিত কালির বড়ি বানাইতেছেন। এই মুগুরজোড়ার মধ্যে আমার পিতামাতা, ঠাকুরদার হাতের স্পর্শ রহিয়া গিয়াছে। আমার পূজনীয় পিতা ১৯৩৭ সালে মেশিন কিনিলেন। আর মুগুরের প্রয়োজন হইল না। কারেন্টে চাক্কি ঘুরিয়া মণ্ড তৈয়ার হইত, এবং ডাইসে বড়ি। বিলাতি মেশিন হইলেও স্বদেশি কালি বলিয়া ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় বিলাতি ইংক ট্যাবলেট ফেল করিয়া আমাদের মাল স্কুলে স্কুলে সাপ্লাই হইতে লাগিল। লক্ষ্মীর কৃপা লাভ করিয়া এই নূতন ভদ্রাসন নির্মাণ করিলাম। একটি ঘরে আমাদের পুরনো কারখানার স্মৃতি স্বরূপ মুগুর দুইটি একটি বেদীতে স্থাপন করিয়া আমার স্বর্গত পিতার ফোটোর সহিত নিত্য অর্চনা করিতে লাগিলাম।

১৯৪৬ সালের ভাদ্র মাসের শেষে দাঙ্গা লাগিল। ডাইরেক্ট অ্যাকশন। পাকিস্তান চাও তোমরা? ভারতের সমস্ত মুসলমানের স্থান কি পাকিস্তানে হইবে? কেন পৃথগন্ন হও? দেশবন্ধু, আপনি নাই। হা নেতাজী, আপনি কোথায়? গান্ধীজী কাঁদিতেছেন। আমাদের বাটীর সম্মুখে লাশ। আল্লা হো আকবর চিৎকার। তার পর বন্দেমাতরম ধ্বনি, সঙ্গে জয় মা কালী ধ্বনিও শুনিলাম। এক দিন কয়েক জন যুবক আসিয়া বলিল আমরা গোপাল বাবুর চ্যালা, হিন্দুদের বাঁচাব। মুগুর দুটো দিন। আমি বলিলাম এগুলো আমাদের পারিবারিক সম্পদ। পূজা করি। উহারা কোনও কথা গ্রাহ্য করিল না। বলিল হিন্দুদের এই বিপদের সময় পরিবার দেখাচ্ছেন? উহারা মুগুরজোড়া লইয়া বন্দেমাতরম বলিতে বলিতে লইয়া গেল। পবিত্র শব্দটির কী দশা হইল। আমি পিছন হইতে বলিলাম ফিরত দিও ভাই। আমাদের পূজার জিনিশ। দুই দিন পর ফিরত দিল, মুগুরের গায়ে রক্ত শুকাইয়া কালচে হইয়া গিয়াছে। জমাদার ডাকিয়া উত্তম রূপে ধৌত করিয়া পুনরায় বেদীতে বসাইলাম। চন্দনের ফোঁটা দিবার সময় হাত কাঁপিত। ফুল দিবার সময় সময় মনে মনে বলিতাম ক্ষমা করো। কাহার কাছে ক্ষমা চাহিতাম? পিতার কাছে না লক্ষ্মী-গোবিন্দের কাছে জানি না। আমার গৃহের উল্টাদিকে একটি কর্মকার শানওয়ালা ছিল। তার দোকানে তালা। চিন্তা হইল সে বাঁচিয়া আছে কিনা। দুই মাস পরে সে দোকান খুলিল। ততদিনে এ দিকে শান্ত হইয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলাম কোথায় ছিলে? ওই কর্মকার বলিল— ‘‘সব চাকু-ছোরাগুলো শান দিতে আসছিল। বন্দেমাতরম ছোরা কিম্বা আল্লা হো আকবর ছোরা একই রকম দেখতে, একই রকম কাজ করে। তাই বন্ধ রেখেছিলুম।’’ তাহার কথা শুনিয়া নিজের উপর ঘৃণা হইল। আমি কেন মুগুর দুটোয় রক্ত লাগতে দিলুম? কেন বুক দিয়ে আটকালুম না?

যাহা হউক, টাইম অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হল। মুগুর দুটিকে যেমন পূজা করিতেছিলাম তেমনই করিতে লাগিলাম।

গত চারদিন ধরিয়া এই কাজ আর করিতে পারিতেছি না। ৩০শে জানুয়ারী মহাত্মা গান্ধী খুন হইলেন। ছি ছি ছি। তাঁহার প্রধান দোষ তিনি যথেষ্ট পরিমাণে হিন্দু ছিলেন না। কোনও এক যথেষ্ট পরিমাণের হিন্দু তাহাকে গুলি করিয়াছে।

যে মুগুরে রক্তের কলঙ্ক লাগিয়াছিল, সেই মুগুর লইয়া আর হিন্দুয়ানী করিতে পারিলাম না। গঙ্গায় ভাসাইলাম।’

বন্ধুর বাবার ছবিটার দিকে আগে কোনও দিনই ভাল করে তাকাইনি। ডায়েরির পৃষ্ঠা ক’টা পড়ার পর ভাল করে তাকালাম। চোখাচোখি হতেই নামিয়ে নিলাম আমার চোখ।

swapnoc@rediffmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy