ট্যাক্সির ‘রিফিউজাল’ বাধ্যতামূলক করে দিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এর ফলে প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন কনফিউশন, ‘ট্যাক্সিটা যাবে, না যাবে-না’— তা থেকে রাজ্যের মানুষ চিরতরে মুক্তি পেলেন। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী টিভিতে সংবাদের মধ্যিখানে ঘোষণা করে দিলেন, কোনও ট্যাক্সি আর কোনও দিন কোথাও যাবে না। মানে, যাত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী কোথাও। গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই রাজ্যে মানসিক রোগীর সংখ্যা সাংঘাতিক বেড়ে যাওয়ায় সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে যে কমিটি গঠন করেন, তার সদস্যরা বাঘা সাইকায়াট্রিস্টদের সঙ্গে কথা বলে দেখেন, অধিকাংশ রোগীই মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন দু’ভাবে— হয় ট্যাক্সি পাবেন কি না এই টেনশন সহ্য করতে না পেরে, কিংবা, ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সাংঘাতিক খারাপ ব্যবহারের ট্রমা সহ্য না করতে পেরে। অনেকে এক সময় হলদে ট্যাক্সি ছেড়ে ‘লাক্সারি ক্যাব পরিষেবা’র দিকে ঝুঁকে এই সমস্যা এড়াতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রথমে কয়েক বার ধর্মঘট ডাকার পর, ফল না পেয়ে, হলুদ ট্যাক্সির ড্রাইভাররা রাতারাতি তাদের ট্যাক্সি ধবধবে সাদা রং করিয়ে নেয় এবং প্রাইভেট কোম্পানির লোগো আঁকিয়ে নেয়। তার পর যাত্রীদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতে শুরু করে, মাঝরাস্তায় ঘাড়ে ধরে নামিয়েও দিতে থাকে। এই ক্যামুফ্লাজের ফলে, লোকে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর ওপরেও রেগে ওঠে। কোম্পানিরা মামলা করেও এই গেরিলা আক্রমণ রুখতে পারেনি। ‘আমার ট্যাক্সিতে আমি যা খুশি আঁকব ও লিখব’ বলে বাক্স্বাধীনতার আইনে ছাড় পেয়ে গেছে হলুদ-ড্রাইভার, চিত্রকর ও সাহিত্যিকরা তাদের সমর্থনও করেছেন। বহু বার রং বদলেও এদের সঙ্গে না পেরে, লাক্সারি পরিষেবা উঠে যায়। তার পর এদের বশে আনতে সরকারের এই সিদ্ধান্ত। ‘তা হলে আদৌ ট্যাক্সি পথে চলবে কেন’ এই প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘না চললে ড্রাইভাররা মামারবাড়ি যাবে কীসে চড়ে?’
পুষ্পক নন্দী, রামপুরহাট, বীরভূম
ভোপাল থেকে দাদার চিঠি এল
দেহরক্ষীর গুলিতে মায়ের অকস্মাৎ মৃত্যুর জেরে হঠাৎ দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া তরুণ রাজীব গাঁধীর সরকারের বয়স তখন মোটে এক। ইন্দিরা হাওয়ায় কংগ্রেসের আসন সংখ্যা চারশো প্লাস হবে, খবরকাগজের প্রথম পাতায় কুট্টির কার্টুন দারুণ মিলে গেছে। প্রবীণ নেতাদের বিদেয় করে রাজীব গাঁধী বেছে নিয়েছেন দুন স্কুলের বন্ধু অরুণ সিংহ আর আত্মীয় অরুণ নেহরুকে। আনন্দবাজারে কুট্টির আঁকা কার্টুন ‘রথের সারথি দুই অরুণ’ ক্লাস ইলেভেনে পড়া আমার চোখে তখন ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দিচ্ছে। স্যাম পিত্রোদার হাত ধরে আধুনিক ভারতের স্বপ্ন দেখানো তরুণ প্রধানমন্ত্রী সে সময় সব কিশোর-যুবকেরই আইডল। খবরকাগজের রাজ্য-রাজধানী বিভাগে উত্তর-সম্পাদকীয় কলমে নিয়মিত পড়ছি বরুণ সেনগুপ্ত, কুলদীপ নায়ারের লেখা।
ঠিক সেই সময়ই, সদ্য কুড়ির চৌকাঠ পেরনো আমার দাদা মধ্যপ্রদেশের ভোপালে চাকরি পেয়ে প্রবাসী হল। তাতে পরিবারে আর্থিক সুরাহা হল ঠিকই, কিন্তু বাড়ির সবার খুব মনখারাপ। তখন পাড়ায় টেলিফোন হাতে গোনা, খবর আদানপ্রদানের জন্য ভরসা ডাক বিভাগ। দাদা মাসে মাসে মানি অর্ডারে দশ টাকা পাঠাত, মানি অর্ডারের নীচের সাদা ছোট্ট এইটুকু জায়গায় খুদে খুদে অক্ষরে অনেক কথা লিখত। বিধবা মা, আর ভাইবোনদের চিঠি লিখত আলাদা করে। বার বার সেই চিঠি পড়ে, তার গায়ে হাত বুলিয়ে, আমরা খুঁজে নিতাম আমাদের স্নেহশীল দাদাকে।
খুব সুন্দর গুছিয়ে চিঠি লিখত দাদা। হামিদিয়া রোড, পরে হোসঙ্গাবাদ রোডে ওদের মেসবাড়ির কথা চিঠিতে লিখত মা’কে। ওর সঙ্গে একই মেসে থাকত খড়দহ আর বেলঘরিয়ার আরও পাঁচ তরুণ, ওরা তখন ওখানে এয়ারক্র্যাফ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পড়ুয়া। ওদের শিলনোড়ায় বাটনা বাটা, খিদেয় পড়ে আধকাঁচা রান্নাই গপগপ খাওয়া, এঁটোকাঁটার বাছবিচার না করা, ঘরের মধ্যে চটি পরে ফটফট হাঁটা— এই সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পড়ে মা আঁতকে উঠতেন। ব্যাচেলর ছেলেও চাইলে কী রকম গুছিয়ে গেরস্থালি করতে পারে, জবাবি চিঠিতে সে ব্যাপারে পরামর্শ দিতে মায়ের ভুল হত না।
ট্র্যাজেডির মুখ। ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের ভিড়, হাসপাতালের সারি সারি বেডে।
৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৪। হঠাৎ খবর পেলাম, ভোপাল শহরের ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানায় গ্যাস লিক করায় গোটা শহরটা নাকি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। কালান্তক গ্যাসের নামও জানা গেল— মিথাইল আইসোসায়ানেট, সংক্ষেপে মিক (MIC)। তখন গোটা পাড়ায় টিভি সাকুল্যে দু-একটা, পাশের বাড়িতে টিভির খবর দেখতে ছুটে গেলাম। মারণ গ্যাস লিক করায় এক রাতে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ মারা গেছে। জয়প্রকাশনগর, কাজী ক্যাম্প, খাজাঞ্চিবাগ, কেঞ্চিছোলার অনেক বাসিন্দা প্রবল শ্বাসকষ্টে, চোখ-গলা-বুক জ্বালায়, বমি করতে করতে মারা গেছেন। হাসপাতালগুলোতে তিলধারণের স্থান নেই। খবর দেখছি আর শুধু ভাবছি, ওই জায়গাগুলো থেকে আমার দাদার মেস কত দূরে?
পরের দিন। দাদা বা তার বন্ধুদের তখনও কোনও খোঁজ নেই। খড়দহ, বেলঘরিয়া গেলাম সেই ছেলেগুলোর বাড়ি— বাড়ির লোকের একই রকম উদ্বেগ। খবরকাগজ খুললেই বড় বড় করে ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির খবর, ছবি। শ্মশানে গণদাহ চলছে... মহিলা ও শিশুদের সংখ্যা বেশি... যাঁরা প্রাণটুকু বাঁচাতে পেরেছেন, তাঁরাও জীবন্মৃত..
টানা তিন দিন পরিবারের সবাই অসহ্য উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটালাম। পাড়াপ্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসার সামনে নিজেদের বড্ড অসহায় বোধ হতে লাগল। একটাই চাওয়া: একটু খবর কেউ যদি দিতে পারে! সে দিন সন্ধ্যায় মনোজদার ভাই বাড়িতে এসে জানাল, দাদারা সবাই ভাল আছে। খবর এসেছে। মনোজদা, দাদার সহকর্মী, বহু কষ্টে রতলাম থেকে একটা ট্রাঙ্ক কল করতে পেরেছিল বাড়িতে: ভাল আছি, বেঁচে আছি। অনেকগুলো বাঙালি পরিবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পেরেছিল সে দিন।
দাদার চিঠি এল কিছু দিন পর। পুরনো ভোপাল শহরটা পরিণত হয়েছিল গ্যাস চেম্বারে। সৌভাগ্যক্রমে, দাদাদের বাস নতুন শহরে থাকায় ওরা দুর্ঘটনা এড়াতে সক্ষম হয়। শীতের রাতে ভারী গ্যাসের চাদর শহরের ওপর চেপে থাকায় বস্তিবাসী, প্রান্তিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল বেশি।
কিশোর ভাইটির জন্যও একটা চিঠি পাঠিয়েছিল দাদা। যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। চিঠির শেষটা এ রকম—
‘ডিউটি ছিল না, তবু ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিকে অভ্যর্থনা জানাতে স্টেশনে এসেছিলেন ভোপাল রেল স্টেশনের ডেপুটি এস এস। তিনি লক্ষ করলেন, প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকা মানুষজন কেমন যেন ছটফট করছে। বাতাসে কটু গন্ধের উপস্থিতি। মুহূর্তে বুঝে নিলেন কী ঘটতে চলেছে। চিৎকার করে সকলকে সাবধান করতে লাগলেন। বন্ধ কন্ট্রোল রুম খুলে চতুর্দিকে ফোন ঘুরিয়ে চললেন: কোনও ট্রেন যেন শহরে না আসে। সতর্কবাণী পেয়ে অনেক ট্রেন থেমে গিয়েছিল অনেক আগে। বহু লোকের প্রাণ বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু টেলিফোন হাতে ধরা অবস্থায় নিথর হয়ে টেবিলে লুটিয়ে পড়েছিলেন একনিষ্ঠ রেলকর্মী হরিশ দারভে।’
আর একটা ব্যাপার ঘটেছিল। যে তরুণ প্রধানমন্ত্রী তখনও অবধি ছিলেন সকলের আইডল, অনেকে তাঁর প্রতি কিছুটা হলেও আস্থা হারিয়েছিলেন। এ রকম একটা কথাও এক সময় রটেছিল, তিনি নাকি ইউনিয়ন কার্বাইডের সর্বময় কর্তাকে নির্বিঘ্নে পালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এই নিয়ে যদিও কুট্টির কোনও কার্টুন চোখে পড়েনি!
সরিৎশেখর দাস, নোনাচন্দনপুকুর, ব্যারাকপুর