Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০৩

কেক

পিনাকী ভট্টাচার্য

কেক আর রুটির বয়স প্রায় এক। একঘেয়ে স্বাদে বদল আনতে রুটিই নিজের মেকওভার করে কেক সেজেছিল। তবে কেক খাবারটার থেকে কেক নামটার বরং অনেক কম বয়স। অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগের ভাইকিংদের প্রিয় খাবার ছিল ‘কাকা’। তাই সময়ের সঙ্গে আ-কারদের ছেঁটে একখানা এ-কার সেঁটে কেক নামে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এই খাবারটা গ্রিক-রোমানদের সময়ও ছিল বহাল তবিয়তে, তবে সেই জমানায় কেক হত মধু দিয়ে। কারণ, ইউরোপের সঙ্গে চিনির চেনাচিনি হয়েছে পরে। সম্রাট দারিউসের সৈন্যরা যখন ৫১০ খ্রিস্টপূর্বে সিন্ধু নদীর পাড়ে এসে উপস্থিত হয়, তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল আখের খেত দেখে। মৌমাছি ছাড়া গাছে কী করে মধু তৈরি হয়, সেটা ওরা বুঝেই উঠতে পারেনি। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করার পর ফেরার সময় প্রথম চিনি নিয়ে ইউরোপে ফেরত যান আর কেক তৈরিতে চিনি ব্যবহার করা শুরু হয়। এর পরই রোমান কবি ওভিড-এর লেখাতে পারিবারিক উৎসবে কেক খাওয়ার কথা পাওয়া যায়।

কেক হাজার কিসিমের, আর প্রত্যেক কেকের সঙ্গে একটা করে গপ্প লুকিয়ে। যেমন ধরুন ফ্রুট কেক। তা রোমান যুগে প্রথম বানানো হয়, সেদ্ধ বার্লির মণ্ডর সঙ্গে ডালিমের বীজ আর কিশমিশ মিশিয়ে। ওজনে হালকা আর অনেক দিন পচন ধরত না বলে এই আদ্যিকালের ফ্রুট কেক সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যেত। মধ্যযুগে ফ্রুট কেক আবার নতুন করে জনপ্রিয় হল যখন চিনি আর শুধু বড়লোকদের খাবার রইল না। কারণ, তখন উপনিবেশগুলো থেকে প্রচুর চিনি ইউরোপে আসতে শুরু করেছে। নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলোর রকমারি ফল যে চিনির রসে ডুবিয়ে নিলে অনেক দিন খাওয়া যেতে পারে, তা ইতিমধ্যে জানা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এত জারক দেওয়া ফল নিয়ে কী করা যায়, সেই নিয়ে ভাবতে বসে দেখা গেল, এই ফলগুলো কেকের সঙ্গে মেশালে স্বাদ খোলতাই হবে আর অন্য দেশেও পাঠানো যাবে। তাই নতুন করে নতুন ভাবে ফ্রুট কেকের জন্ম হল। প্লাম কেকও আদতে এক ধরনের ফ্রুট কেক। ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অবধি আঙুর আর কিশমিশকে ‘প্লাম’ বলা হত আর তা দিয়ে তৈরি কেককে বলা হত প্লাম কেক।

যখন চিনি সাধারণ মানুষের কাছে দুষ্প্রাপ্য ছিল, তখনই ক্যারট কেক জনপ্রিয় হয়েছিল। কারণ গাজর দিয়ে পুডিং বা কেক বানালে গাজরের স্বাদই তাকে মিষ্টি আর মুখরোচক করে তুলত। আর এই কেকের সঙ্গে আমেরিকার ইতিহাসও জড়িয়ে। ১৭৮৩ সালের ২৫ নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যের নিউ ইয়র্ক ছেড়ে চলে যাওয়া উদ্‌যাপন করতে লোয়ার ম্যানহাটানের পার্ল স্ট্রিটে সেনাধ্যক্ষদের এক বর্ণিল সমাবেশ ঘটেছিল। সেখানে জর্জ ওয়াশিংটনকে ক্যারট কেক খাইয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল।

ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকের সঙ্গে ইতিহাসের চেয়ে ভূগোলের সম্পর্ক বেশি; এর নাম এসেছে এক লিকিয়র থেকে, এই লিকিয়র তৈরি হয় দক্ষিণ পশ্চিম জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট পর্বতমালায় পাওয়া এক বিশেষ ধরনের চেরি থেকে। এই লিকিয়র মিশিয়ে কেক বানালে এক অনন্য স্বাদ আর গন্ধ তৈরি হয়, তাই কেকের নামের সঙ্গে জায়গার নাম মিশে গেছে।

আজকে তো ভগবান যিশু থেকে বাড়ির শিশু— সক্কলের জন্মদিনের সঙ্গে কেক অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। কিন্তু আদ্যিকালে তা ছিল না। রোমানরা কেক বানাত ঈশ্বরকে নিবেদন করতে, আর গ্রিক সমাজে বিশেষ কেক তৈরি হত বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

ছেলেটি একটি ডাইনি পোষে

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

বছর পঁচিশ আগে মহাশ্বেতা দেবীর চিঠি পেয়েছিলাম। মূল বিষয় ছিল, একটি সাঁওতাল ছেলের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা, কারণ ছেলেটি একটি ডাইনি পোষে। ডাইনিটিও ওর সঙ্গেই থাকবে। তখন আমাদের মতো মহাশ্বেতা-ভক্তদের কাছে অনুরোধ মানে আদেশ। কোনও উঁচু পদেও কাজ করতাম না। কী করা যায় ভাবছি। এক এনজিও-কর্তার সঙ্গে আলাপ ছিল। ওঁকে চিঠিটা দেখালাম। উনি বললেন, ছেলেটিকে ডাকুন।

ছেলেটির নাম পালটে বলি। ও গুণধর সোরেন। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ, বছর পঁচিশ বয়স। পুরুলিয়া জেলার এক গভীর গ্রামে থাকত। ওর গ্রামসম্পর্কের এক বউদিকে জানগুরুরা ডাইনি চিহ্নিত করে মেরে ফেলার নিদান দিয়েছে। ছেলেটি ওই মহিলাকে নিয়ে পালিয়ে পুরুলিয়া শহরের একটি হোটেলে ক’দিন ছিল। পরে ওই হোটেলেই মহিলাটির থাকা-খাওয়া সহ রান্না-বাসনমাজার কাজ হয়ে যায়। হোটেল মালিক ওর ডাইনি- বৃত্তান্ত জানত না। ছেলেটিও পুরুলিয়া শহরে একটা টিভির দোকানে কাজ পায়। লোকের বাড়ি গিয়ে অ্যান্টেনা খাটিয়ে আসত। ওই দোকানেই রাতে থাকত। ছেলেটির বয়ান অনুযায়ী, সেই বউদির সঙ্গে তেমন সম্পর্ক রাখত না। ‘বাঁচা আর বাঁচানোই তো ধর্ম, কী বলেন?’

ওই মহিলার ঘরে হোটেল মালিকের নৈশ অভিসার ছিল। হয়তো ওটাই ওর বাসন মাজার চাকরিতে টিকে থাকবার জন্য ছোট হরফে না-লেখা 'T&C'. কোনও এক নৈশ পর্বে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় হোটেল মালিকটির নাক দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। আসলে, রক্তক্ষয় মস্তিষ্কেই হয়ে থাকবে। লোকটা নাকি কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্থির হয়ে গিয়েছিল। সারা রাত মৃতদেহ আগলে বসেছিল ওই নারী, ভোরবেলায় যখন পাখি সব করে রব, তখন ও উঁচু রবে কেঁদে উঠেছিল। তার পর শোরগোল, কলরব। হোটেল মালিকের সদ্য-সাবালক পুত্র উচ্চৈঃস্বরে ওই মহিলার মাতৃরমণেচ্ছা ঘোষণা করে এবং হোটেল মালিকের সদ্য পতিহারা বউ অমিতবিক্রমে মহিলাকে জুতোপেটা করে। গায়ে ও মুখে তিন-চারটি স্মারক ফোসকা নিয়ে ওই মহিলা গুণধরের কাছে ফিরে আসে। অতঃপর গুণধর ওই মহিলার জন্য একটা খোলার চালের কুঁড়ে ভাড়া করে। এ দিকে গুণধরের মালিক ওই মহিলার পাস্ট না জানলেও প্রেজেন্টটুকু জেনেই নষ্ট গুণধরকে চাকরিচ্যুত করলেন। ফলে থাকার জায়গাটুকুও চলে গেল। সদ্য ভাড়া নেওয়া কুঁড়েঘরে গুণধরকে থাকতে দিল না সে, কারণ মহিলার ধারণা হয়েছিল ও হয়তো ডাইনিই হবে, নইলে হোটেল মালিকটা মরে গেল কেন?

গুণধরকে এনজিও অফিসে আমিই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। উন্নত জাতের হাঁস, ছাগল, শুয়োর চাষে উসাহিত করার জন্য সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে এক জন সাঁওতাল ছেলেই চাইছিল ওরা। চাকরিটা হয়ে গেল। ঝাড়গ্রামে পোস্টিং। এনজিও-কর্তা গুণধরকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোমার না হয় কাজটা হল, কিন্তু সো-কল্‌ড ডাইনিটার কী হবে?’ ও বলেছিল, ওর তো আর গাঁয়ে ফেরার উপায় নেই, ওর জন্যও যদি কিছু ব্যবস্থা বনায়ে দিতে পারেন... ‘ডু ইয়্যু লাভ হার?’— এই প্রশ্নে ছেলেটি দাঁতে জিভ কেটে বলেছিল, শুধু দেখায়ে দিতে চাই ডাইন বুলে কিছুক হয় না। ডাইনকে সঙ্গে লিয়ে থাইকলেও কিছুক হয় না। ওরা বলেছিল, দেখা যাক কী করা যায়। আপাতত ওকে আমাদের হোমে তুলে নিচ্ছি।

বছর খানেক পরই ঝাড়গ্রামে বেড়াতে গিয়ে গুণধরের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ডাইনিকে দেখলাম ওর ঘরেই। ছোটবেলার রূপকথার গল্পে ডাইনির ছবি দেখা চোখ ধাক্কা খেল। সুশ্রী। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-তে কালো রং না মাখা সিমি-প্রায় গড়ন। বছর পঁয়ত্রিশের মতো বয়স হবে। মুড়ি-আলুভাজা মেখে দিল। অনাথ আশ্রমে বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। রান্না করে। চুলও বাঁধা ছিল, লাল ফিতে। মেয়েটির নাম হাওয়ামণি। জানলাম, ওর বিয়ের পর সাত বছরেও সন্তান হয়নি। এর পর ওর স্বামী হলুদ হয়ে যায়, পেটে জল হয় এবং মারা যায়। কিছু দিন পর ওর ভাশুরপো একই উপসর্গে মারা যায়। ও পাড়ার দুটো গরুও বাঁটফুলো রোগে মরল। ওদের বাড়ির লোকজন জ্ঞানগুরুর কাছে গেলে ‘তেলখড়ি’ করে ডাইনি সাব্যস্ত করল।

গুণধর বলেছিল, বোঝাই যাচ্ছে পরিবারে হেপাটাইটিস হয়েছিল। ওকে ডাইন বানালে সম্পত্তি অন্য ভাইরা ভাগ করে নেবে।

দেখলাম, ওরা একসঙ্গেই সুখে আছে। ভাল লেগেছিল।

আবার দেখা হল বছর দুয়েক আগে। ট্রেনে। গুণধরের চোখে কালো চশমা। জামশেদপুর যাচ্ছে। জামাকাপড়ে দুর্গন্ধ। ট্রেনের ঝিকঝিকের মধ্যে শুনলাম এনজিও’টা নেই। গুণধর আর একটা কাজ পায়। পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোকেরা বুকে ব্যাজ লাগিয়ে বলেছে মানুষের উপকারের জন্য টাকা তোলো, কোম্পানি ব্যবসা করে তিন বছরে ডবল ফেরত দেবে। গুণধর চিটফান্ড কথাটাই জানত না।

যাদের টাকা গেল, ওরা পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোকগুলোকে পায়নি। গুণধরকেই পেয়েছিল। চোখে পেরেক ঢুকিয়ে দিয়েছিল।

আর হাওয়ামণি ভেবেছিল ও সত্যিই ডাইনি, নইলে যাদের পরশ করে, তাদের এমন হয় কেন? ও চলে গেছে। বছর খানেক হল। ‘ও বেঁচে আছে কিনা জানি না। চোখেও তো তেমন দেখি না। কোথাও ভিক্ষে করছে কি না কে জানে! মানুষের চোখ হয়তো ভাল করা যায় কিন্তু সমাজের অন্ধত্ব কে ভাল করবে?’ ও বলেছিল। তার পর বলল, ‘থানা থেকে খবর দিয়েছে জামশেদপুরের মর্গে একটা ডেডবডি আছে। ওর ফটোর সঙ্গে মিলছে। একটা চোখে সামান্য দেখতে পাই এখনও। দেখি, ডাইনটাকে চেনা যায় কিনা। আপনি যাবেন?’

আমি তো ভদ্রলোক। সেই মহাশ্বেতাও নেই। কত কাজ। কেন যাব?

swapnoc@rediffmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy