তিরিশের দশকে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সমস্ত ভারতীয় বর্ণমালা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। বলেন, বাংলা, মরাঠি, ওড়িয়া, অহমিয়া, হিন্দি, তেলুগু, তামিল, মালয়ালম, উর্দু ইত্যাদি সব লেখা হোক রোমান বা ইংরেজি হরফে। তাঁর যুক্তিগুলো বেশ ধারালো। এই সব বর্ণমালা প্যাঁচালো এবং জটিল। তুলনায় ইংরেজি হরফ অনেক সরল। শ, ঝ বা জ-এর মতো জিলিপির প্যাঁচ তাতে নেই। তায় ব্যঞ্জনের পর স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণ এলে তা আর এক প্রস্থ নতুন বর্ণের চেহারা এসে হাজির হয়। এ > ে, ঔ > ৌ, ঋ > ৃ, ক্র, ঞ্জ ইত্যাদি। ব্যঞ্জনের ওপর ব্যঞ্জন, তার ওপর আবার ব্যঞ্জন চড়লে তো সোনায় সোহাগা: জ্জ্ব বা স্প্ল ইত্যাদি। ক্ষ, জ্ঞ, হ্ম লিখতে হলে এখনও গা কেমন করে। ছোটবেলায় হ্ন-এর টিকিটা কখন পরে উঠবে আর কখন নিচে নামবে, এই ভুলের জন্য আমিও প্রচুর মার খেয়েছি আর কাঁদতে কাঁদতে ভেবেছি— কেন আমায় বাঙালি হয়ে জন্মাতে হল? একটি অসহায় শিশুকে অপমান করে, হাসির খোরাক বানিয়ে দিয়ে ভাষার প্রতি ভালবাসা জন্মানো যায়? বেশির ভাগ ভারতীয় লিপিতে এই একই যন্ত্রণা।
ভাষাচার্য হিসেব করেছিলেন, শিশু প্রথম বাংলা বর্ণ চেনা থেকে মোটামুটি পড়তে-লিখতে শেখে দু’বছর সময়ে। ইংরেজির ক্ষেত্রে সময়টা মাত্র তিন মাস। কারণ ২৬টা লেটারের বাইরে ইংরেজিতে যুক্তবর্ণের আর কোনও হিজিবিজি নেই। বাংলায় সেখানে প্রায় ৪০০ অক্ষরের দরকার হয়। তার সঙ্গে বানানের জটিলতা জুড়ে যে বিভীষিকার সৃষ্টি হয়, তা ভাষাটাকে মেরে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। আচার্য ইংরেজি হরফে বাংলা পাঠ্যবই ছেপে সুন্দরবনের কিছু প্রাইমারি স্কুলে পড়াতে শুরু করেন। ফল নিয়ে লিখেছিলেন, ‘...the boys and girls were able to read their mother-tongue in this Roman-Bengali much quicker than the ordinary children learning it through the Bengali alphabets.’ (A Roman Alphabet for India - Suniti Kumar Chatterji. Journal of the Department of Letters. Calcutta University Press 1935)
ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রদের মূল সমস্যা পড়া ও লেখায়। নইলে দৈনন্দিন কথাবার্তায় এরা ভালই বাংলা ব্যবহার করে। এমনকী রসিকতার ক্ষেত্রে বাংলার বহুমুখী ইন্টেলিজেন্ট প্রয়োগ এদের মুখে শোনা যায়। বাংলা মিডিয়ামে পড়া প্রাপ্তবয়স্ক বঙ্গসন্তানকে একটা কেজো চিঠি বাংলায় লিখতে বললে গায়ে জ্বর এসে যায়। সেটা তাঁরা ইংরিজিতে লিখতে চান। অথচ এঁরা বাংলাটাকে ভালবাসেন। ভাষার প্রতি ভালবাসা আর লিপির প্রতি অ্যালার্জি এই নিয়ে অধিকাংশ বাঙালি ঘুরে বেড়ায়।
ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে রোমান হরফ চলে বলে, ইউরোপের একটি দেশের মানুষের পক্ষে ইউরোপের আর একটি দেশের ভাষা শেখা যতটা সহজ, এক জন ভারতীয়র পক্ষে আর একটি ভারতীয় ভাষা শেখা ততটাই কঠিন। অথচ বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা হিন্দি, তামিল, মরাঠি বা গুজরাতি বুঝতে ও বলতে পারেন, কিন্তু পড়তে বা লিখতে পারেন না। আবার তামিল, মরাঠি, গুজরাতি বা হিন্দিভাষীদের মধ্যেও অনেকে আছেন যাঁরা বাংলা বুঝতে ও বলতে পারেন। কিন্তু পড়তে-লিখতে পারেন না। যদি সব ভারতীয় ভাষা ইংরেজি হরফে লেখা হয়, তা হলে সব ভারতীয়র পক্ষে সব ভারতীয় ভাষা পড়া, লেখা এবং শেখা সহজ হয়ে যায়। এর ফলে ওঁরা অতি সহজে বাংলা সাহিত্যের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারেন, লেখালিখিতেও নতুন মাত্রা ও স্বাদ আনতে পারেন। আর আমরাও বাংলা সাহিত্য যে শ্রেষ্ঠ, এমন একটা ধারণা নিয়ে কুয়োর ব্যাং হয়ে বসে আছি, সেটা কেটে যেতে পারে। লিপির বিভেদ তুলে দিলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ পরস্পরকে আরও ভাল বুঝতে পারবেন, সাবন্যাশনালিজমের প্রবণতা কমবে এবং জাতীয় সংহতির ভিত দৃঢ় হবে। বিদেশিদের পক্ষেও বাংলা শেখাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। দুনিয়া জুড়ে বাংলা চর্চার পথ সুগম হলে আখেরে বাংলারই লাভ।
এ ব্যাপারে ভাষাচার্যের মূল প্রেরণা ছিলেন কামাল পাশা। ১৯২৮ সালে তিনি তুরস্কে সরকারি ফরমান জারি করে গায়ের জোরে রোমান হরফ চালু করেন। ভৌগোলিক অবস্থানের ফলে তুরস্ক চিরকালই এশীয় ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির মিলনস্থল। কামাল পাশা বুঝেছিলেন, এই মিলনমেলাকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া দরকার। এ প্রসঙ্গে ভাষাচার্য লিখেছিলেন, ‘বঙ্গদেশের এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ ও সর্বজন-সমাদৃত লেখক— একাধারে তিনি বৈজ্ঞানিক ও আভিধানিক এবং রস-রচয়িতা— তিনি আমায় বলিয়াছিলেন যে, যদি তাঁহার হাতে কামাল পাশার মতো ক্ষমতা থাকিত, তাহা হইলে আইন করিয়া দেশে বাংলা ভাষায় তিনি রোমান অক্ষর প্রচলন করাইতেন।’ (ভারতে রোমক লিপি। সাংস্কৃতিকী। ২য় খণ্ড। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। বাক সাহিত্য। ১৩৭২) যে তিনটি বিশেষণ প্রয়োগ করা হয়েছে তাতে বুঝতে পারি, ওই ব্যক্তি রাজশেখর বসু ছাড়া আর কেউ নন। এ নিয়ে দেশদ্রোহিতা এবং বাংলাবিদ্বেষের অভিযোগ আসতে পারে বলে সুনীতিকুমার সতর্ক ছিলেন, সমস্ত দায় নিজের কাঁধে নিয়ে, রাজশেখর বসুর নামটা পর্যন্ত উল্লেখ করেননি।
ভাষাচার্য খেটেখুটে হিন্দি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, মরাঠি, গুজরাতি, সিন্ধি, ওড়িয়া, অহমিয়া, তামিল, কন্নড়, তেলুগু, কোল, সাঁওতাল ইত্যাদি ভাষার সমগ্র বর্ণমালা ইংরেজি হরফে কেমন হবে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেল তৈরি করে ফেলেছিলেন। বাংলার ক্ষেত্রে ক > k, খ > kh, গ > g, ঘ > gh ইত্যাদি। পুরো বর্ণমালাটি তুলে দেওয়ার পরিসর এখানে নেই। যাঁরা উৎসাহী তাঁরা উপরিউক্ত প্রবন্ধটি বা http://www.archive.org/stream/journalofthedepa033555mbp/journalofthedepa033555mbp_djvu.txt/// অ্যাড্রেসে গিয়ে দেখতে পারেন। ওই বর্ণমালার ওপর চোখ বোলালে বোঝা যায় আজকের অধিকাংশ বাংলা ফোনেটিক সফ্টওয়্যার রচিত হয়েছে ভাষাচার্যের গাইডলাইন একটু এ দিক ও দিক করে। প্রোগ্রামাররা সচেতন ভাবে তাঁকে অনুসরণ করেছেন কি না, তাঁরাই জানেন। যদি না-ও করে থাকেন, তবু ভাষাচার্যের দূরদৃষ্টি প্রমাণিত হয়।
নেহরুর ইচ্ছেয় ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দি হতে চলেছে এটা স্বাধীনতার অনেক আগেই নির্ধারিত হয়ে যায়। কুড়ির দশকের শেষে জাতীয় কংগ্রেস কলকাতায় একটি অল পার্টি কনফারেন্সের আয়োজন করে, যেখানে ভাষাচার্য উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তাঁর হিন্দিকে রোমান অক্ষরে লেখার প্রস্তাব ফুৎকারে উড়ে যায়। নইলে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদের পক্ষে হিন্দি শেখা অনেক সহজ হত। এই ভাবে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে হিন্দির আধিপত্য কায়েমের রাস্তাটি খোলা রাখা হয়। ১৯৩৪ সালে ফরিদপুরে অল বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ টিচার্স কনফারেন্সে বাংলাকে রোমান হরফে লেখার পক্ষে ২৫টি এবং বিপক্ষে ৩২টি ভোট পড়ে। তার পর এই উদ্যোগ ধামাচাপা পড়ে যায়।
ধর্মীয় মহলেও এ বিষয়ে চূড়ান্ত বিরোধিতা ছিল। ওঁ, হ্রীং, ক্লীং, ফট্, স্বাহা এ সব ধ্বনি কি ইংরেজিতে লেখা হবে নাকি? দেবীপক্ষের দিনে মণ্ডপে বসে শেষে ইনজিরি হরফে চণ্ডীপাঠ করতে হবে? এর বিরুদ্ধে যুক্তি দুটো। আমাদের পুরাণ স্তোত্র মূলত দেবনাগরী হরফে লিখিত। সংস্কৃতের কাছে এক দিন বাংলাও ম্লেচ্ছ ভাষা ছিল। আজ কিন্তু বাড়িতে যাঁরা পুজো করতে আসেন তাঁরা বাংলাতেই সংস্কৃত শ্লোক পড়েন। মানে স্তোত্রগুলির পবিত্রতায় এক প্রস্থ বেনোজলের ছিটে আগেই পড়ে গেছে। তুরস্ক তো ইংরিজি হরফে লেখা কোরানও গ্রহণ করেছে। আর, এক সময়ে দণ্ড, পল, প্রহর মেনে পুজোর নির্ঘণ্ট হত। আজ পাঁজিগুলোও ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম ধরে নির্ঘণ্ট বাতলায়, যেটা আবার গ্রিনিচ মিন টাইম বা কোঅর্ডিনেটেড ইউনিভার্সাল টাইম মেনে নির্ধারিত। এতটা যদি মেনে নেওয়া যায় তো ইংরিজি হরফ মেনে নিতে বাধা কোথায়? টেকনোলজি বড় বালাই। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে বিভিন্ন দেশের মধ্যে ট্রেন যোগাযোগ শুরু হওয়াতে একটা আন্তর্জাতিক টাইম স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন দরকার হচ্ছিল। প্রতিটি দেশ যদি নিজের খেয়াল খুশি মতো ঘড়ি ধরে চলত, তো হয় কেউ কোনও ট্রেন ধরতে পারত না বা ধুম-ধাম অ্যাক্সিডেন্ট হত। আজকেও দেখছি, ভাষাচার্য যেটা পারেননি, টেকনোলজি সেটা করে দিচ্ছে। মোবাইল মেসেজ, ব্লগ, চ্যাট, ফেসবুকে হরবখত ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা হচ্ছে। অতি বড় বাংলাভাষাপ্রেমীরাও এটা নির্দ্বিধায় করে চলেছেন। কারণ তাঁরা বাংলা টাইপ ও বানানে স্বচ্ছন্দ নন। তাই প্রতি দিন কোটি কোটি বাংলা শব্দ ইংরেজি হরফে পৃথিবীর আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্যান্য ভারতীয় ভাষার ক্ষেত্রেও তাই। এমনটা চললে হয়তো আর বছর তিরিশেকের মধ্যে ভারতীয় লিপিগুলো ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে। সেটা আমাদের পক্ষে শাপে বর হবে।
এখন তো টেকনোলজি এসে গিয়ে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। চার পাশে তার লক্ষণ একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাচ্ছি। আগে দৈনন্দিন হিসেব-নিকেশের প্রয়োজনে নিরক্ষর মানুষরা ইংরেজি হরফে শুধু 1, 2, 5 আর 0 চিনতেন। কারণ ওই মূল্যমানে নোট বা কয়েন পাওয়া যেত। মোবাইলের দৌলতে এখন 3, 4, 6, 7, 8, 9 চিনে ফেলেছেন অনেকে। আমার বাড়ির কাজের দিদি এবং রিকশাওয়ালারা কী সুন্দর মোবাইলের নানা অপশন বুঝতে পারেন। সেগুলো তো ইংরেজিতেই থাকে। তাঁরা ফোন করেন, রেডিয়ো শোনেন, গেম্স খেলেন। বাংলা লিপির প্রতি অযথা আবেগ ও অন্ধ ভক্তিটুকু ত্যাগ করলে এই মানুষগুলোর কাছে বাংলা সাহিত্যের সিংহদরজা খুলে যাবে, হয়তো বিদেশিদেরও যুক্ত করা যাবে।
এও সত্যি যে আমরা নিজেদের চেষ্টায় বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে মধ্যযুগের গণ্ডি থেকে বার করতে পারিনি। ইউরোপিয়ানদের ঠেলা দরকার হয়েছিল। তারা ছাপাখানা নামের একটা ইনফর্মেশন টেকনোলজির মাধ্যমে বাংলা হরফে বই ছাপা শুরু করে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রেই ছাপা বই। আজও আর একটা ইনফর্মেশন টেকনোলজির ঠেলা জোরদার হয়ে উঠছে।
sinha_sugata@yahoo.in