Advertisement
E-Paper

সিনেমার সত্যি আর মিথ্যেরা

কে যেন বলেছিলেন সিনেমা মানেই মিথ্যাচার! চোখে জল আনা ভীষণ দরকার, না হলে সিনটা মাঠে মারা যাবে, কিন্তু বিখ্যাত নায়িকার কান্নাই পাচ্ছে না। গ্লিসারিনও চোঁ-চোঁ করে শুষে নিচ্ছে চোখ। বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক টেনে মারলেন এক চড়। অবশেষে মাঠ ভিজল চোখের জলে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এক নায়ক সকালবেলা বেরোবেন শুটিংয়ে। ভয়ংকর তাড়াহুড়ো।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

কে যেন বলেছিলেন সিনেমা মানেই মিথ্যাচার! চোখে জল আনা ভীষণ দরকার, না হলে সিনটা মাঠে মারা যাবে, কিন্তু বিখ্যাত নায়িকার কান্নাই পাচ্ছে না। গ্লিসারিনও চোঁ-চোঁ করে শুষে নিচ্ছে চোখ। বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক টেনে মারলেন এক চড়। অবশেষে মাঠ ভিজল চোখের জলে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এক নায়ক সকালবেলা বেরোবেন শুটিংয়ে। ভয়ংকর তাড়াহুড়ো। এমন সময় স্ত্রী এক থালা লুচি, তরকারি, বেগুনভাজা, পায়েস নিয়ে এলেন। নায়ক বললেন, মানে? স্ত্রী বললেন, আজ তোমার জন্মদিন, ভোরে উঠে নিজে সব তৈরি করেছি, খেতেই হবে। অগত্যা... এ দিকে গিয়েই খাওয়ার সিন। পরিচালক বললেন, গোগ্রাসে খেতে হবে। আপনার চোখ, মুখ, হাত, চিবনো সব বলে দেবে— আপনি তিন দিন অভুক্ত। অগত্যা...
এক বার ক্ষমতার কাছে থাকা এক মহিলা দলবল সমেত এলেন একটি ছবির প্রস্তাব নিয়ে। নায়ক, মানে স্বামী বিবেকানন্দের চরিত্রে করবেন মুম্বইয়ের এক ঝড়তি হিরো। বাজেট সাত কোটি, বাড়লেও ক্ষতি নেই। প্রস্তাব না করার আগেই ভদ্রমহিলাকে দেখে কেন জানি না মুখ থেকে বেরিয়ে এল, আর আপনি বুঝি নিবেদিতা হবেন? ভদ্রমহিলা হেঁ হেঁ করে হেসে বললেন, এই না হলে ডিরেক্টরের চোখ? সাঁ করে এসে আমার পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, আর তৎক্ষণাৎ আমার ডান হাত উঠে গেল তাঁর মাথায়। এর পর যা হল, তা মনে পড়লে আজও হাসতে হাসতে টেবিলের তলা থেকে খাটের তলায় গড়িয়ে যাই। মাথায় হাত দিয়ে কেমন অদ্ভুত লাগল। একটু চাপ দিলাম, আরও অদ্ভুত লাগল। আবার চাপ দিলাম, অত্যদ্ভুত লাগল, আর সঙ্গে সঙ্গে আমার চাপের চমকে এক ঝটকায় বেরিয়ে এল আমার চেয়েও ঝাঁ-চকচকে এক টাক। আমি ভয়ংকর অপ্রস্তুত। ভদ্রমহিলা ‘চুল’ মাথায় বসাতে বসাতে বললেন, ‘আপনি জানেন, রাজকুমারেরও চুল ছিল না। শাহরুখ খান, বচ্চন স্যর... সবার পরচুলা। ওঁরা পারলে আমি পারব না কেন? সিনেমায় তো সব হয়।’ সত্যিই তো, সিনেমায় কত টাক চুলে ভরে যায়, কত চুল টাকের তলায় ঘুমিয়ে থাকে!

এক বার ‘টোপ’ করতে গিয়ে দরকার ছিল এক পাল বাঁদর আর হনুমানের। আর একটা একলা বুড়ো গাছের, যেখানে তারা খায়দায় ঘুমোয় আর স্বপ্ন দেখে। সকাল বিকেল সন্ধে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে এক দিন প্রান্তর জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একা সেই গাছের দেখা মিলল। কিন্তু বাঁদর? হনুমান? তাদের পাই কোথায়! মাদ্রাজে নাকি সিনেমার জন্য সব রকম জন্তুজানোয়ার পাওয়া যায়। এক বার এক মাদ্রাজি বেড়াল এসেছিল আমার ছবি ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’-এ অভিনয় করতে। সঙ্গে তিন জন লোক। পার ডে পাঁচ হাজার। যাতায়াত, খাইখরচা, পকেটমানি তো আছেই। প্রথম দিনেই বুঝতে পারলাম, অ্যাক্টিংয়ের ‘অ্যা’ও জানে না সেই হাড়গিলে বেড়াল। ফলে কলকাতা থেকে বেড়াল আনাতে হল আবার, সে আবার কেঁদো এক হুলো। এখান-ওখান থেকে কিছু মনমরা বাঁদর জোগাড় হল, কিন্তু হনুমান কোথাও পাওয়া গেল না। কী আর করা, শুটিং শুরু করতেই হল। দিন দুয়েক কেটেও গেল, তার পর ঘটল অভাবনীয় সেই ঘটনা। শুটিং‌ শুরু হয়েছে, হঠাৎ প্রান্তরের চারপাশ থেকে ধুলোর ঝড় উড়িয়ে স্পটের দিকে উড়ে আসতে লাগল পাল পাল হনুমান। ইউনিটের অধিকাংশই নিমেষে আশ্রয় নিল গাড়ির ভেতর, কেউ কেউ ভয়ের চোটে ঢিল ছুড়তে গেল। তাদের কোনও মতে ঠান্ডা করলাম, আর সেই হনুমানের দল আমাদের একলা গাছকে ঘিরে ঠায় বসে রইল যত ক্ষণ না শুটিং শেষ হয়। মধ্যিখানে লাঞ্চ ব্রেকে তারাও নিমেষে উধাও, আবার যেই শুটিং শুরু হল, তারাও ফিরে এল আবার শট দিতে। দুরন্ত সব শট। এর পর রোজই তিনটি হনুমান ঠিক চলে আসত শুটিং শুরু হওয়ার সময়, থাকত যত ক্ষণ না আমি ‘প্যাক আপ’ বলছি। দূর থেকে গম্ভীর মুখে বসে আমাদের কাজকর্ম দেখত। ইউনিটের মধ্যে তাদের নামকরণ হয়ে গেল: তারকভস্কি, বার্গম্যান আর বুনুয়েল।

‘চরাচর’ ছবির শেষ দৃশ্যের জন্য বাছা হয়েছিল সমুদ্র ডিঙিয়ে জেগে থাকা খাঁ-খাঁ একটি চর। ছবির শেষ দৃশ্যে নায়কের দরজার ও-পারে আর সব দৃশ্য মুছে গেছে, বদলে শুধু দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র আর হাজার হাজার পাখি। শুনেছিলাম এই চরে পাখি আসে, কিন্তু দূর থেকে কয়েক দিন লক্ষ করে দেখলাম, মাঝে মাঝে কয়েকটা পাখি আসে, একটু থাকে, আবার উড়ে যায়। ব্যস, ওই পর্যন্তই। মনখারাপ নিয়ে এক দিন চড়ে বসলাম নৌকোয়, সেই চরের উদ্দেশে। কিছু তো একটা করতে হবে। পৌঁছে দেখি অসম্ভব এক দৃশ্য, যা স্বপ্নেও ভাবিনি। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে বসে আছে শ’য়ে শ’য়ে পাখি। নড়ছে না চড়ছে না, শুধু বসে আছে। একটি শটেই দৃশ্যটি তোলা হবে। অতএব সেট খুলে এনে আবার লাগাতে হচ্ছে চরে। কার্পেন্টাররা কাজ করছে, দূরে পাখিরা বসে আছে। ট্রলি পাতা হল, পাখিরা বসে আছে। বুকের ভেতর ঢপাস ঢপাস হচ্ছে, যদি পাখিরা উড়ে চলে যায় এত শব্দে! কিন্তু পাখিরা বসেই আছে। এই দৃশ্য এক বারেই টেক করতে হবে, দু’বার হবে না। বলে দিয়েছিলাম, আমি হাত তুললেই বাকি সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠবে। শট শুরু হল। যেমনটি বলা, দরজা খুলে লখা, মানে রজিত কপূর, ছুটতে শুরু করল সমুদ্রের দিকে, এক বারও পেছনে না তাকিয়ে। ওর পেছন পেছন আমরা ক্যামেরা নিয়ে। ঠিক সময় হাত তুললাম, চিৎকার করে উঠল সবাই, পাখিরা একসঙ্গে উড়তে শুরু করল। আকাশ ভরে গেল পাখিতে। লখা তখনও ছুটে চলেছে। তার পরের ক’দিন সমুদ্রের কাছের আর এক বালিয়াড়িতে কাজ ছিল। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝেই চোখ চলে যেত সেই চরের দিকে। পাখি কেন, একটা পালকও কোনও দিন দেখিনি!

‘তাহাদের কথা’র শুটিং চলছে ওড়িশায়। লোকেশন ছোট্ট একটা নাম না জানা নদী, ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া একটা জায়গা, কয়েকটা গাছ, অনেক দূরে হারিয়ে যাওয়া তিরতিরে একটা রাস্তা। এরই মধ্যে অসাধারণ এক সেট বানিয়েছেন নিখিল সেনগুপ্ত। অনেক সময় একা একা কাজ করতেন নিখিল, কখনও ঘুমিয়ে পড়তেন সেটের ভেতর, কখনও সারা রাত কাজ করে যেতেন। নিখিলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন খুব কাছের বন্ধু, চিত্রপরিচালক বিপ্লব রায়চৌধুরি। সেই ঢুকে গেলেন নিখিল আমার ছবিতে। সেট ঘিরে তৈরি হয়েছিল বৃত্তের মতো শক্তপোক্ত মাচা। তার ওপর ট্রলি। নিখিলকে বলেছিলাম একটু বেশি দরজা-জানলা রাখতে, যাতে এক জানলা দিয়ে এক দরজা, এক দরজা দিয়ে আর এক জানলা দেখা যায়। বাড়ির ভেতর মিঠুন আর অনসূয়ার এক দৃশ্য। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। জানলা থেকে দরজা থেকে দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি, তার মাঝখানে মিঠুনের মোনোলগ। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই, ফলে বৃষ্টি তৈরি করতে হবে। দমকল নিয়ে আসা হল। সেই এক আঁজলা নদীতে পাইপ লাগিয়ে জল নেওয়া হল। এক বার রিহার্সাল, তার পরেই টেক। অসামান্য হল রিহার্সাল। সেই দুরন্ত বৃষ্টিতে আমরাও বেশ ভিজে গেছি। মাথা-টাথা মুছে এ বার টেক-এর জন্য রেডি। সন্ধ্যাও হয়ে আসছে, যেটা প্রয়োজন ছিল। এমন সময় প্রোডাকশন ম্যানেজার এসে বলল, এক ফোঁটাও জল নেই নদীতে। ব্যস, শুটিং বন্ধ। লম্বা মুখে আমরা যে যার আস্তানায় ফিরে এলাম। সবার একটাই চিন্তা, জল পাই কোথায়? পর পর দু’দিন এ ভাবেই কাটল। খটখটে নদী, খটখটে আকাশ, খিটমিটে মন— দৃশ্যটা বোধহয় বাদই দিতে হবে। মিঠুনও দেখি চুপচাপ বসে আছে ফ্লোরে। হঠাৎ কে যেন বলল, এক বার দেখুন। তাকিয়ে দেখি, চারপাশ থেকে ঘুরঘুট্টি মেঘ এসে জড়ো হয়েছে সেটের ওপর। তাড়াতাড়ি একটা শুকনো রিহার্সাল সেরে আমরা লাফিয়ে উঠলাম মাচায়, বৃষ্টি এল ঝাঁপিয়ে। বৃষ্টি এল সব কিছু একাকার করে দিয়ে।

মাঝে মাঝে মনে হয়, সিনেমা শুধুই মিথ্যে বলে না। অনেক মিথ্যেকেও সত্যি করে দিয়ে যায়।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy