Advertisement
E-Paper

সু ম না মি

দুনিয়া জুড়ে লঘুসংগীত, গানের বাজার ফর্দাফাঁই। ব্যবসায়ীরা বলেন, এর জন্য দায়ী ‘পাইরেসি’, ‘রিপিং’। গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগ শেষ হওয়ার পর থেকেই পাইরেসির যুগ শুরু হয়ে যায়। গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগে রেকর্ড ডুপ্লিকেট করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ক্যাসেটের যুগে ছবিটা গেল পালটে। কলকাতার চাঁদনিতে কয়েক জন ব্যবসায়ী ডুপ্লিকেট করার যন্ত্র বসিয়ে ফেলেন আশির দশকের প্রথম দিকেই।

কবীর সুমন

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

দুনিয়া জুড়ে লঘুসংগীত, গানের বাজার ফর্দাফাঁই। ব্যবসায়ীরা বলেন, এর জন্য দায়ী ‘পাইরেসি’, ‘রিপিং’। গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগ শেষ হওয়ার পর থেকেই পাইরেসির যুগ শুরু হয়ে যায়। গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগে রেকর্ড ডুপ্লিকেট করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ক্যাসেটের যুগে ছবিটা গেল পালটে। কলকাতার চাঁদনিতে কয়েক জন ব্যবসায়ী ডুপ্লিকেট করার যন্ত্র বসিয়ে ফেলেন আশির দশকের প্রথম দিকেই। একটা থেকে একটা, একটা থেকে দুটো, একটা থেকে চারটে বা তারও বেশি— এই রকম নানান ক্ষমতার মেশিন পাওয়া যেত। তা ছাড়াও ক্যাসেট প্লেয়ারের সঙ্গে একাধিক ক্যাসেট রেকর্ডার জুড়ে জুড়েও ডুপ্লিকেট করার রীতি ছিল সেই সময়ে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও, গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ভারতের বিভিন্ন রেকর্ড-ক্যাসেট কোম্পানি ওই মিউজিক ক্যাসেট বিক্রি করেই কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করতে পেরেছিলেন এবং কেউ কেউ তাঁদের শিল্পীদের ভাল রয়্যালটিও দিতে পেরেছিলেন। অবশ্য এটাও ঠিক যে, কোম্পানিকুল ও শিল্পীকুল সমানে নালিশ করে যাচ্ছিলেন— পাইরেসির কারণে তাঁদের লাভের ভাগ কমে যাচ্ছে, নেপোয় মেরে দিচ্ছে দই। কোনও কোনও নেপোর নাম-ঠিকানা পেয়ে পুলিশ কালেভদ্রে হানাও দিচ্ছিল। ফুটপাতে ঢেলে বিক্রি করা পাইরেটেড ক্যাসেটের সম্ভারের ওপরেও কোথাও কোথাও ঠিকই পড়ছিল পুলিশের থাবা।

কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা সিডির যুগে কিন্তু সংগীত ব্যবসা গুরুতর মার খেল। সেটা হল মূলত প্রযুক্তির ভূমিকার কারণে। কুটিরশিল্পের কায়দায় গ্রামোফোন ডিস্ক থেকে গ্রামোফোন ডিস্ক বানিয়ে নেওয়ার প্রযুক্তি ছিল না। ক্যাসেট থেকে ক্যাসেট বানিয়ে নেওয়ার প্রযুক্তি কিন্তু এসে গিয়েছিল ওই যুগ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। ওই পদ্ধতিতে মূল রেকর্ডিংয়ের উৎকর্ষ মার খাচ্ছিল অনেকটাই, কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ শ্রোতার তাতে কিছু যায় আসে না। ধ্বনি-বিশ্বস্ততা নিয়ে আমরা তেমন চিন্তিত নই।

সিডির যুগ কম্পিউটারের ব্যবহার উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়ারও যুগ। আর কম্পিউটারের সাহায্যে সিডি থেকে সিডি কপি করে নেওয়া সহজ কাজ। কপি-সুরক্ষিত সিডি হলে কী হবে, সেই সুরক্ষা-ব্যবস্থা নস্যাৎ করে দেওয়ার সফ্টওয়্যার সহজেই পাওয়া যায়। যদি কোনও কোম্পানির সুরক্ষা-ব্যবস্থা দুর্ভেদ্যও হয়, যে-কোনও সিডি প্লেয়ারের ইয়ারফোন আউটলেটে তার লাগিয়ে, সহজলভ্য কম্পিউটার সফ্টওয়্যারে মূল সিডির গানবাজনা একেবারে বাংলা মতে রেকর্ড করে নিয়ে, তা থেকে সিডি বানিয়ে নিলে ঠেকাচ্ছে কে? কাজেই, প্রযুক্তির উন্নতি দুনিয়াময় নেপোর সংখ্যায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছে। গানবাজনার সিডি বানিয়ে তা থেকে লাভ করার উপায় কোম্পানিগুলোর অল্প কিছুকালের পর আর নেই। অতএব সংগীত বাণিজ্যে মন্দা।

পশ্চিমবঙ্গে আজ যাঁদের বয়স চল্লিশ, তাঁদের জন্ম যখন হয়েছিল, তখনও গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগ। জন্মেই তো আর কেউ ‘পুজোর গান পুজোর গান’ করে না। সেটি করার বয়স মানে কৈশোর। আজকের চল্লিশদের বয়স যখন, ধরা যাক দশ, তখন বাংলা আধুনিক গানের জগৎ চিঁ-চিঁ করছে, তার বেশি জোর নেই। গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগ তখন ইতিহাসের অমোঘ ভিডিয়ো-অডিয়ো সফ্টওয়্যারে ‘ডিজল্ভ’ করছে ক্যাসেটের যুগে। মনিটরে দেখা যাচ্ছে— গ্রামোফোন রেকর্ডের ছবি ক্রমাগত ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর আর ক্যাসেটের ছবি ক্রমশ আরও আরও স্পষ্ট।

সত্যি বলতে, পুজোর গানের যুগ গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগের সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়। এর একটি কারণ, গ্রামোফোন রেকর্ডের সঙ্গে বেতারের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। রেকর্ড কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আকাশবাণীর চুক্তি ছিল, আর আকাশবাণীর প্রতিটি কেন্দ্রে ছিল গ্রামোফোন রেকর্ড বাজানোর যন্ত্র ও সম্প্রচার ব্যবস্থা। আকাশবাণী থেকে ক্যাসেট বাজানোর ব্যবস্থা আশি ও নব্বইয়ের দশকে ছিল না।

এ ছাড়া, পশ্চিমবঙ্গে গ্রামোফোন রেকর্ডে পুজোর গান শুরু হওয়ার সময় থেকেই ৭৮ আরপিএম-এর একটি ডিস্কে একই শিল্পীর গাওয়া দুটি গান থাকত। এর পর ষাটের দশকের গোড়ার দিক থেকে ভারতে এক্সটেন্ডেড প্লে ও লং প্লে রেকর্ড ছাপা হতে থাকল যখন, ৪৫ আরপিএম-এর স্ট্যান্ডার্ড প্লে রেকর্ডও তখন বের হল। স্ট্যান্ডার্ড প্লে ডিস্কে এ-পিঠে একটি, ও-পিঠে একটি— মোট দুটি গান থাকত, অর্থাৎ সেই ৭৮ আরপিএম-এর মতোই। এই উৎপাদনরীতি সত্তরের দশকেও ছিল। ১৯৭২ সালে আমার গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম গ্রামোফোন ডিস্ক বেরোয়। স্ট্যান্ডার্ড প্লে, দুটি গান। ১৯৭৩ সালেও একই। অর্থাৎ, গ্রামোফোন ডিস্কের যুগে পুজোর গানই বলুন, বসন্ত সমাগমই বলুন আর রবীন্দ্রজয়ন্তীই বলুন, যে-কোনও বিশেষ উপলক্ষে রেকর্ড প্রকাশের সময় এক জন কণ্ঠশিল্পীকে দুটির বেশি গান নিয়ে ভাবতে হত না। আধুনিক গানের বেলা গীতিকার-সুরকারদেরও লক্ষ্য ছিল শিল্পীপিছু দুটি গান বানানো।

ক্যাসেটের খাঁই অনেক বেশি। লুপ-বিন মেশিনে ক্যাসেটের ফিতে কেটে প্রয়োজনমাফিক দৈর্ঘ্য বানিয়ে নিয়ে খোলে পুরে দেওয়া সম্ভব হলেও, মোটে দুটি গানের জন্য একটা গোটা ক্যাসেট? না। অন্তত খান আষ্টেক গান না থাকলে ক্যাসেটই হত না প্রথম যুগে। বেশ কিছু দিন ভেবেচিন্তে দুটি গান বানালে তার যে আবেদন, আটটি গান আট জন গান-বাঁধিয়েকে দিয়ে বানিয়ে নিলে সেই আবেদন হবে কি না সন্দেহ। তা ছাড়া, শারদ-অর্ঘ্যের গান আমজনতার ‘পুজোর গান’ হয়ে উঠত আমজনতার ঘরে ঘরে বেতার মারফত পৌঁছে গিয়ে। ক্যাসেটের যুগে তা ব্যবহারিক প্রযুক্তির কারণেই সম্ভব ছিল না। আকাশবাণীর মিডিয়াম ওয়েভে ক্যাসেট বাজানো যেত না।

ধরা যাক, সেটা সম্ভব হলেও, পুজোর এক মাস আগে থেকে বেতারে এক জন শিল্পীর ক্যাসেটায়িত আটটি নতুন আধুনিক গানের মধ্যে বেতারে ক’টি বাজানো সম্ভব হত? ডিস্ক-পিছু দুটিমাত্র নতুন আধুনিক গান, শ্যামাসংগীত বা পল্লিগীতির যুগে— বাজারস্বীকৃত সবচেয়ে নামজাদা শিল্পীদের দুটি গানই পুজোর আগে থেকে অনুরোধের আসরে শোনার সুযোগ ছিল স্ট্যাটিসটিক্সের দিক দিয়েই বেশি। ফলে দুটির মধ্যে দুটিই, অথবা নিদেনপক্ষে একটি গান মনে থেকে যাওয়ার সুযোগও বেশি ছিল।

ক্যাসেট ও সিডির যুগে প্রতি ক্যাসেট বা সিডিতে গানের যা সংখ্যা, তাতে সে দিনের সোনাঝরা সন্ধ্যার স্মৃতিবিধুর পুজোর গানের সামাজিক-মেজাজের ধারা আর বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে, আমাদের মধ্যে পঞ্চাশোর্ধ্ব যাঁরা, বড়জোর তাঁরা বিগত যুগের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারেন। কেউ কেউ ফেলেনও। গানের দিক দিয়ে পুজোর সময়টাকে অতীত-পিয়াসীদের হায়-হায় কাল বলা যেতেই পারে।

kabir suman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy