Advertisement
E-Paper

সু ম না মি

কবীর সুমনরংচঙে জামা, তাতে জরির কাজ, কালো প্যান্ট আর চটি পায়ে কিছু লোক বাজনা বাজাতে বাজাতে চলেছেন। পেছনে পেছনে আমিও চলেছি গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে, খালি পায়ে। বাজনার আওয়াজ শুনে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছি মেজোজ্যাঠাবাবুর বাড়ি থেকে, যেখানে উঠেছি আমরা কটক থেকে কলকাতায় এসে। ১৯৫৫ সাল, দুপুর। এমন দৃশ্য কটকে দেখিনি।

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৪ ১৭:০৪
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

রংচঙে জামা, তাতে জরির কাজ, কালো প্যান্ট আর চটি পায়ে কিছু লোক বাজনা বাজাতে বাজাতে চলেছেন। পেছনে পেছনে আমিও চলেছি গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে, খালি পায়ে। বাজনার আওয়াজ শুনে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছি মেজোজ্যাঠাবাবুর বাড়ি থেকে, যেখানে উঠেছি আমরা কটক থেকে কলকাতায় এসে। ১৯৫৫ সাল, দুপুর। এমন দৃশ্য কটকে দেখিনি। দেখিনি এই সব বাজনাও। পরে বাবা শিখিয়ে দিয়েছেন নাম: ক্ল্যারিনেট, কর্নেট, টিউবা, বিগ ড্রাম।

তাঁদের বাজানো সুরটা আমার আজও মনে আছে: পমর‌্ প রে -/ গ - ম - / প - গ - / - - - -// পর্ম প রে -/ গ - ম - / রে - সা - /- - - - // তার পরের সুরটাও থেকে গিয়েছে মনে। কিন্তু স্বরলিপি পাঠের বিড়ম্বনায় কাউকে আর ফেলতে চাই না। এই রকম ব্যান্ডপার্টির বাজনা তার পর কত বার কত জায়গায় শুনেছি, কিন্তু ওই সুরটি আর শুনতে পাইনি।

এই তো, বছরখানেক আগে সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘কাঙাল মালসাট’ ছবির শুটিং করছিলাম বিড়লা তারামণ্ডলের সামনে, অনেক রাতে। ঘোড়ায় টানা গাড়িতে বেগম জনসনের ভূমিকায় আমাদের শহরের এক চমৎকার গায়িকা, অভিনেত্রী মিস জোজো, আর দণ্ডবায়সের ভূমিকায় এই অধম। আমাদের সঙ্গে চলেছে চিৎপুরের এক ব্যান্ডপার্টি, কোনও একটি গানের সুর বাজাতে বাজাতে। মিস জোজো জানালেন, ওটি একটি ‘হিট’ হিন্দি গান। সুর আর মনে নেই। তাল মনে আছে। বাংলায় যেটাকে আমরা বলি ডবল-দাদরা। ঢাঁইকুড়কুড়-ঢাঁইকুড়কুড় বলে গেলে ওই তালের চলনটা শরীরে পাওয়া যায় ভাটপাড়ার পিসিমা না হলে।

চিৎপুরের ব্যান্ডপার্টি কোনও গানের সুর বাজাচ্ছে মানে সেটি ‘হিট’ গান। ছেলেবেলা থেকে দেখে এলাম বড় পুজোর ভাসানে আর নানান সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যান্ডপার্টিগুলি ভাড়া খাটে। ভাড়া খাটে তাসাপার্টিও। তবে, এদের মধ্যে তফাত আছে। বিভিন্ন দিশি তালযন্ত্রে একসঙ্গে তাল বাজানোই তাসার কাজ এবং লয়ে ও আওয়াজে সেই বাজনা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে। ব্যান্ডে চিরকাল থাকত, এখনও থাকে, সুর বাজানোর নানান যন্ত্র, যেমন ক্ল্যারিনেট, কর্নেট, টিউবা, হর্ন। ক্ল্যারিনেট ও কর্নেট আমাদের গ্রামের যাত্রাতেও দীর্ঘকাল বেজে এসেছে।

তাসায় দেখতাম, এখনও দেখি সুর বাজানোর একটি মাত্র যন্ত্র। ছেলেবেলায় ও কৈশোরে দেখতাম-শুনতাম ক্ল্যারিনেট। তাকে এক দিন হটিয়ে দিল ‘টাইসোকোটো’। এই যন্ত্রটি তারের, কোলে শুইয়ে বাজাতে হয়। এক শিল্পী এই যন্ত্রে ‘হিট’ গানের সুর বাজান, যা কিছু বছর হল ইলেকট্রনিক অ্যামপ্লিফায়ারের সাহায্যে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাইকেল রিকশা বা সাইকেল ভ্যানে বসা সেই টাইসোকোটো-বাজিয়ের পেছনে-সামনে তাসাপার্টির তাল-বাজিয়েরা হাঁটতে থাকেন বাজাতে বাজাতে।

ক্ল্যারিনেটের যুগে অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহার করা হত না। ক্ল্যারিনেটশিল্পী তাল-বাজিয়েদের সঙ্গেই থাকতেন এবং তাঁর যন্ত্রটি নানান দিকে তাক করে তুলে, কখনও আবার নামিয়ে, তালে তালে শরীরের বুলি খেলিয়ে ‘শোম্যানশিপ’ দেখাতেন। বেশ লাগত। তাসাপার্টির এই আকর্ষণীয় দিকটি আর নেই।

বাকি অনেক কিছুই থেকে গিয়েছে আগের মতো। তাসাপার্টিতে বরাবর এক জন থাকেন, যিনি একটি তালযন্ত্র গলায় ঝুলিয়ে বাজান। ঠিক নাম জানি না, তাই বলছি ‘মিনি-নাকাড়া’। দেখে আসছি এঁর বয়স অন্যদের চেয়ে কম। আগে দেখেছি এই মিনি-নাকাড়াশিল্পী রাস্তার এক ধারে পুরনো কাগজ, গাছের শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে তাঁর যন্ত্রের চামড়ার ছাউনিটা গরম করে নিচ্ছেন। দুটি কাঠির আঘাতে তখন টংটঙে আওয়াজ দিচ্ছে যন্ত্রটি। তাসার অন্য সদস্যরা তাঁদের ভারী যন্ত্রে মধ্য লয়ে তাল তোলার খানিক ক্ষণ পর মিনি-নাকাড়াশিল্পী তাঁর যন্ত্রে একটা উঠান নিচ্ছেন। তার পর শুরু করছেন তাঁর বাজনা। ভারী তালযন্ত্রগুলিকে তাদের মতো বাজতে দিয়ে এই নবীন শিল্পী তাঁর মিনি-নাকাড়ায় দুটি কাঠির সাহায্যে ছন্দ ভেঙে ভেঙে, ছোট ছোট টুকরো তৈরি করে, লয়কারির নানান প্যাটার্ন গড়ে নিচ্ছেন। ভারী তালযন্ত্রগুলির একটানা গুমগুমে ধ্বনির পরিমণ্ডলে মিনি-নাকাড়ার কড়কড়ে আওয়াজ: কমান্ডো-হানা। রণক্ষেত্রে অবিরাম তোপ দাগছে কিছু কামান, আর তার ভেতর দিয়ে এক জন কমান্ডো অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে, কখনও এ দিক, কখনও ও দিক থেকে হঠাৎ হঠাৎ হানা দিচ্ছে, পর পর গুলি চালাচ্ছে, আবার থামছে, আবার চালাচ্ছে। এই কলকাতা শহরে তাসাপার্টির মিনি-নাকাড়ায় লয়কারির যে তুরীয় আস্ফালন এ জীবনে শুনে নিয়েছি, তা আমায় জীবনে ও সংগীতে বেপরোয়া হতে শিখিয়েছে। এই বেপরোয়াপনাকে ধারণ করে আছে কিন্তু যথেচ্ছাচার নয়। প্রতিভা, প্রশিক্ষণ, রেওয়াজ, অধ্যবসায়, সৃষ্টিশীলতা। তাসাপার্টির এই মিনি-নাকাড়াশিল্পী তালবাজনার সুকুমার রায়: ‘হাতি লোফেন যখন তখন’। ‘ষষ্ঠীচরণ’ হওয়া সবার কম্ম নয়। কলম থাকলেই সুকুমার, গিটার থাকলেই সুমন, আর তালবাজনা থাকলেই তাসার ওই জাত-বাউন্ডুুলে তালবাজ হওয়া যায় না।

কত কী পালটে গেল দুনিয়া জুড়ে। পালটাল না কলকাতার ব্যান্ডপার্টি আর তাসাপার্টির ডবল-দাদরা তালের গানের সুর আঁকড়ে থাকার ঝোঁক। ব্যান্ডপার্টি আর তাসাপার্টি ‘হিট’ গান বাজিয়ে থাকেন। এঁদের ঝোঁক ডবল-দাদরা তালের গান বাজানোর দিকে। তা হলে কি বলা যায়, এ দেশের ‘হিট’ গানগুলি সচরাচর ওই তালে? ঢাঁইকুড়কুড়-ঢাঁইকুড়কুড়? এক শ্রোতা ও সংগীতশিল্পী হিসেবে এটুকু বলতে পারি, বেশির ভাগ মানুষ দেখেছি তিন বা ছ’ মাত্রার গান হলে তালে তালে হাততালি দিতে বা নিজের হাঁটু বা কিছুর ওপর হাত দিয়ে তাল দিতে চান বেশি। আর ডবল-দাদরা হলে তো কথাই নেই। আমাদের ব্যান্ডপার্টি আর তাসাপার্টি সেই কথাই-নেই-তে আছেন। আর আছেন আর্থিক অনটনে।

১৯৫৫ সালে আমার পাঁচ-ছ’ বছর বয়সে জীবনে প্রথম যে ব্যান্ডপার্টির সদস্যদের দেখেছিলাম, তাঁদের কালোকোলো-পোড়-খাওয়া শরীরে ছিল আধময়লা ইউনিফর্ম, পায়ে ছিল চটি। পুরনো, ছেঁড়াখোঁড়া। ষাট বছর পরেও তাঁদের শরীর সেই একই ধরনের, পায়ে একই চটিগুলোই। মুখগুলো ক্লান্ত, ম্লান। অল্প বয়সেও দেখতাম কোথাও বাজাতে এলে তাঁরা উদাসীন মুখে রাস্তার ধারে উবু হয়ে বসে থাকেন। ডেকরেটরের নড়বড়ে, ভাঁজ করা চেয়ার বা পুরনো টুলও তাঁদের কেউ দেয় না। আজও তা-ই দেখি।

ভদ্দরলোকদের নানান অনুষ্ঠানে এঁরা অপরিহার্য অথচ ব্রাত্য প্রকৃত ‘ব্রাত্যজন’। দারিদ্র এঁদের পিটিয়ে চলেছে আর এঁরা পিটিয়ে চলেছেন এঁদের যন্ত্রগুলো। এঁদের ‘সংগীত’কে কোনও রকম অভিমান না করেই ‘রুদ্ধ’ বলা যায়। রুদ্ধ না থাকলে এঁরা হয়তো অন্যান্য তালের গানও বাজাতেন ‘হিট’-এর চিন্তা না করে।

kabir suman sumonami
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy