Advertisement
E-Paper

সীমাবদ্ধ

১৯৬৫-তে অর্থনীতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। সচ্ছল অবস্থা মোটেই ছিল না। তাই রোজগারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হল। রানিগঞ্জ থেকে কয়লা কিনে কলকাতায় বিক্রি করতাম। লরি চেপে নিত্য আসা-যাওয়া সইল না। লোকসান হল বেশ কিছুটা। চাকরির সন্ধান শুরু করলাম। কখনও গাড়ির ফিল্টার, কখনও লরির ত্রিপল, কখনও বেবিফুডের সেল্সম্যান-গিরি করে বুঝলাম, এ পথের পথিক আমি নই।

দীপংকর দে

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৩৩

১৯৬৫-তে অর্থনীতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। সচ্ছল অবস্থা মোটেই ছিল না। তাই রোজগারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হল। রানিগঞ্জ থেকে কয়লা কিনে কলকাতায় বিক্রি করতাম। লরি চেপে নিত্য আসা-যাওয়া সইল না। লোকসান হল বেশ কিছুটা। চাকরির সন্ধান শুরু করলাম। কখনও গাড়ির ফিল্টার, কখনও লরির ত্রিপল, কখনও বেবিফুডের সেল্সম্যান-গিরি করে বুঝলাম, এ পথের পথিক আমি নই। অন্নসংস্থান তা হলে কী করে হবে? পারিবারিক সূত্রে রাধিকাপ্রসাদ গুপ্ত ওরফে শাঁটুল গুপ্তর সুপারিশে তিনশো টাকা মাইনের চাকরি পেলাম ‘গ্রান্ট অ্যাডভারটাইজিং’ নামে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায়। মন বসে গেল। সে সময় বিভিন্ন অফিস-ক্লাবে বছরে একটি করে নাটক হত। পিকলু নিয়োগীর পরিচালনায় স্টার থিয়েটারে অভিনয় করলাম যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে। বিধাতা সম্ভবত সে দিন থেকেই আমার ভাগ্য অন্য ভাবে নির্ধারণ করলেন।

সত্যজিৎ রায় ঘোষণা করলেন, শংকর-রচিত ‘সীমাবদ্ধ’ উপন্যাসটি তিনি চিত্রায়িত করবেন। অফিস-ক্লাবের সহকর্মীরা আমাকে উসকে দিতে লাগলেন যেন আমি পরিচালকের সঙ্গে সত্বর যোগাযোগ করি। আমি তো মহা দোলাচলে! সত্যজিৎ রায়কে চিনি না, জানি না, পৌঁছব কী করে? ১৯৭০ সাল। তখন টেলিফোনে ল্যান্ডলাইনের যুগ। গাইড ঘেঁটে বিশপ লেফ্রয় রোডের ফোন নম্বর পেলাম। রিসিভারে হাত রেখে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু ক্ষণ। সাহস হচ্ছিল না। কপাল ঠুকে ফোন করতেই জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘সত্যজিৎ রায় বলছি।’ পরিচয় প্রদানের পর ওই ছবিতে অভিনয় করার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। জানালেন, সব চরিত্র নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। আমার জন্য কোনও কাজ নেই। উনি বিজ্ঞাপন জগতের বিখ্যাত মানুষ আর আমার সবেমাত্র হাতেখড়ি হয়েছে। কেন জানি না, হঠাৎই সদয় হলেন ও পর দিন সকাল দশটায় বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। সাহেবি আমলের কাঠের চওড়া সিঁড়িওয়ালা বাড়ি। এমনিতেই নিজের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। তার ওপর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে দ্বিগুণ শব্দময় মনে হচ্ছে।

দোতলায় সবে উঠেছি, দেখি দীর্ঘদেহী মানুষটি এক ভদ্রলোক ও এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলছেন। পরনে ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি। বেশ কঠিন স্বরে ‘ইংরেজি বলতে পারেন?’ বলে তাঁদের বিদায় করলেন। আমি ত্রস্তপদে আবার নীচে পালিয়ে গেলাম। আমার ভাগ্যের লিখন কি একই হবে? কিছু ক্ষণ পরে, সাহস সঞ্চয় করে দরজায় কলিং বেল বাজালাম। নিজেই দরজা খুললেন। ‘লোকে এত বিরক্ত করে! আসুন’, এই বলে অভ্যর্থনা জানালেন, যেন আমি কত দিনের চেনা! ‘আপনাকে তো বলেছি সব চরিত্র নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। খুব শিগগির শুটিং শুরু হবে।’ উভয়পক্ষ কিছু ক্ষণ নীরব। মনে হল আমাকে জরিপ করছেন। বিজ্ঞাপন জগৎ সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন। ছবি-সংক্রান্ত একটি শব্দও ব্যয় করলেন না।

‘চা খাবেন?’

মন বলল, হলেও হতে পারে। দু’পেয়ালা চা এল। সবে চুমুক দিয়েছি, হঠাৎই বললেন, ‘একটা ছোট চরিত্র আছে। চলবে?’ শব্দগুলো দৈববাণীর মতো কানে প্রবেশ করল। নির্বাচিত হলাম। (এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, সত্যজিৎ রায়ের অজান্তে আমার সম্মানমূল্য ধার্য হয়েছিল পঁচাত্তর টাকা এবং ওই টাকা আদায় করতে প্রোডাকশন ম্যানেজার নিশীথ চক্রবর্তী তিন দিন ‘হিন্দ’ সিনেমার পাশে ওঁদের অফিসে দৌড় করিয়েছিল)।

এক রবিবার ইউনিয়ন কার্বাইড অফিসে শুটিংয়ের ডাক পড়ল। মেক-আপ ম্যান অনন্ত দাস আমার মুখে কোনও রং মাখালেন না, শুধু পাউডার পাফ করে ছেড়ে দিলেন। মনঃক্ষুণ্ণ হলাম। শুনেছিলাম চিত্রতারকাদের মুখে লাল-হলুদ কত না রং মাখানো হয়! তার পর দেখি নায়ক বরুণ চন্দ, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, অজয় বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ কোনও শিল্পীকেই মেক-আপ করা হয়নি। বুঝলাম এটাই ‘ফিল্ম রিয়েলিটি’।

একটা লম্বা রেলগাড়ির মতো লাইন। তার ওপর মোটা তক্তায় চাপানো হয়েছে বিশাল ক্যামেরা। কালো কাপড়ে মাথা ঢাকলেন পরিচালক। ‘সোজা হেঁটে এই ডান দিকের ঘরে ঢুকে যাবে।’ তাই করলাম। কাট। জীবনের প্রথম শট দিলাম। ‘ভাল হয়েছে।’ ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল।

এর পর নায়কের অফিস চেম্বারে শট। ক্যামেরার সামনে আমি, আর আমার পিছনে একটি ‘উষা’ কোম্পানির পাখা। ছবিতে পাখাটির প্রয়োজন আছে। কিন্তু পাখার নাম তো হবে ‘ব্রিজ’ (Breeze) অর্থাৎ, বাতাস। সত্যজিৎ রায় সেই সময় রথ্ম্যান্স সিগারেট খেতেন। প্যাকেট থেকে রুপোলি তবকটা ছিঁড়ে ‘উষা’ লেখাটিকে মুড়ে ফেললেন। তার পর একটা দেশলাই কাঠির মাথা দিয়ে তার ওপর ‘ব্রিজ’ লোগো এম্বস করলেন। এক হাত দূর থেকে মনে হচ্ছিল, সত্যি সত্যিই এটা আসল খোদাই। এই যে খুঁটিনাটির প্রতি নজর, এতেই প্রমাণ হয় তিনি ছিলেন জাতশিল্পী। আমার মতো নগণ্য এক বিজ্ঞাপনের চাকুরেকে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন আর্টওয়ার্ক কী ধরনের কার্টরিজ পেপারে ভাঁজ করে পেশ করা হয়।

শুনেছিলাম, পরদায় চরিত্রের ঠোঁট মিলিয়ে সংলাপকে বলা হয় ‘ডাবিং’। পরিচালক আমার বেলায় একটি ‘নাগ্রা’ টেপ রেকর্ডার ও একটি স্টপ-ওয়াচ ব্যবহার করলেন। ‘এই যে স্টপ-ওয়াচ মিলিয়ে তোমার সংলাপ ভাগ করছি, আমার ভাগগুলো শুনে শুনে তুমি ঠিক সেই ভাবে বলো। পরদার দিকে একদম তাকাবে না।’ এক জন নতুন শিল্পীর প্রতি কী অসীম সহানুভূতি দেখালেন! ইন্দ্রজালের মতো শব্দ আর ঠোঁট মিলে যেতে লাগল। সত্যজিৎ রায়ের মতো এক জন ‘টোটাল শিল্পী’র সান্নিধ্য লাভ করে নিজেকে চিরধন্য মনে করি।

‘সীমাবদ্ধ’ ছবির পর বেশ কিছু দিন রায়বাড়ি থেকে কোনও ডাক পাইনি। কয়েক বছর পর অকস্মাৎ তলব এল ‘জন অরণ্য’ ছবিতে নায়কের বড় ভাই ভোম্বলের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। সত্যজিৎ রায়ের শেষ তিনটি ছবি, অর্থাৎ ‘গণশত্রু’, ‘শাখা-প্রশাখা’, ‘আগন্তুক’ ছবির চরিত্রগুলোতেও, ভোম্বলের মতোই, আমি মূলত কেরিয়ারিস্ট— শক্ত মাটিতে পা রেখে চলি, কল্পনায় গা ভাসাই না। ‘জন অরণ্য’র প্রথম দিন শুটিং। বাবা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ছোট ছেলের মার্কশিট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘এটা কী করে হয়? কী করে হয় এটা?’ ছোট ভাইয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট এত খারাপ হতে পারে না। সে দিন আমার কী যে হল, বলে বোঝানো যাবে না। মার্কশিট হাতে ধরে বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে শুরু করলাম। কাঁপুনি আর থামে না। মানিকদা আলো নিভিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমাকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দিলেন। সবাই মিলে ধরাধরি করে আমায় বেতের চেয়ারটায় বসিয়ে দিল। বেশ কিছু ক্ষণ পর আলো জ্বলে উঠল। ‘ঠিক আছো তো? চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তাঁর স্নেহের বাণী সত্যিই আমাকে শান্ত, স্থির করে দিল। আর সমস্যায় পড়তে হয়নি।

আর এক দিনের কথা মনে পড়ে। মানিকদার বউমা বুনি, সন্দীপ রায়ের স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা। নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছে। মানিকদা শুনেছিলেন, আমি অল্পবিস্তর জ্যোতিষচর্চা করি। দু-চার দিনের মধ্যেই ‘আগন্তুক’ ছবির শুটিং শুরু হবে। তাঁর কাছে কিছু নির্দেশ নিতে গিয়েছি। ঠাট্টা করে প্রশ্ন করলেন, ‘কী বলে তোমার জ্যোতিষ? বুনির ছেলে হবে না মেয়ে?’ বলে ফেললাম, ‘মেয়ে।’ এ বার গড়ের মাঠে ‘আগন্তুক’ ছবির প্রথম দিনের শুটিং। উৎপলদা কয়েকটি কিশোরকে বিজ্ঞান শেখাচ্ছেন মাঠে বসে। দূরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখা যাচ্ছে। আমিও শুটিং দেখতে গিয়েছি। প্রণাম করতেই বলে উঠলেন, ‘এক চড় দেব। বুনির আজই ছেলে হয়েছে।’ ঘাবড়ে গেলাম। কাঁধে হাত রেখে ভয়মুক্ত করলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘ছেলে হয়েছে বুনির।’ রায় পরিবারের শিক্ষা, ঐতিহ্য, ঘরানা ওই মুহূর্তটুকুতে তাঁর চোখেমুখে যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। সেই আলোকশিখা সন্দীপ-পুত্র সৌরদীপের মধ্যে আজ জাজ্বল্যমান, সেটা ‘বাদশাহী আংটি’ ছবির শুটিং করতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি।

deepankarde1234@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy