Advertisement
E-Paper

সুমনামি

কবীর সুমনবলতে ইচ্ছে করছে, পুরাকালে— আসলে ষাটের দশকে তো বটেই, হয়তো সত্তরের দশকেও— কলকাতার অনেক পাড়ায় শোনা যেত ভোরের একটু পরে থেকেই কোনও-না-কোনও বাড়িতে কেউ গলা সাধতে বসেছেন। কেউ নেহাতই অল্পবয়সি। কচি গলা। কেউ বা কিশোরী। বেশি বয়সি কেউ গলা সাধছেন, তাও শোনা যেত, যদিও কম।

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

বলতে ইচ্ছে করছে, পুরাকালে— আসলে ষাটের দশকে তো বটেই, হয়তো সত্তরের দশকেও— কলকাতার অনেক পাড়ায় শোনা যেত ভোরের একটু পরে থেকেই কোনও-না-কোনও বাড়িতে কেউ গলা সাধতে বসেছেন। কেউ নেহাতই অল্পবয়সি। কচি গলা। কেউ বা কিশোরী। বেশি বয়সি কেউ গলা সাধছেন, তাও শোনা যেত, যদিও কম। ‘ধোঁয়াশা কুয়াশা কাদা/ ভোরবেলা গলা সাধা’ লিখতে পারতাম না, যদি ‘গড়িয়াহাটার মোড়’ গানটা আজ লিখতাম। আজ আর ভোরবেলা গলা সাধা শুনি না তেমন।

অতীতের গলা সাধা ছিল সা রে গা মা পা ধা নি সা। তারসপ্তকের সা থেকে ফেরত। আবার তারের সা পর্যন্ত। সব শুদ্ধ স্বর। সাতসকালে শুদ্ধ স্বরের সঙ্গে কোমলগুলিকে এবং তীব্র মধ্যমকেও সাধতে কোনও দিন কাউকে শুনেছি বলে মনে পড়ে না। প্রথমে ধীর লয়ে, তার পর ক্রমান্বয়ে দ্রুত লয়ে, প্রায় তানের মতো করে শুদ্ধ স্বরগুলি সাধছেন, এমন নেহাত কম শুনিনি। কিন্তু শুদ্ধ কোমল তীব্র মিলিয়ে, যাকে বলে ক্রোম্যাটিক স্কেলে গলা সাধতে শুনিনি কাউকে। অথচ ১২টি স্বরের মধ্যে কোমল-তীব্র পাঁচটিকে বাদ দিয়ে কেবল সাতটি স্বর নিয়ে হাঁচোড়পাঁচোড় করে গেলে লাভ কী— এই প্রশ্ন সংগীতের সাংঘাতিক ঐতিহ্যপূর্ণ এই দেশে কাউকে করতে শুনিনি ছেলেবেলা থেকে।

রাগসংগীত শিখতে গেলে, এমনকী নেহাত বাজারচলতি হিট আধুনিক গানের বাইরে বাংলায় যে সব সিরিয়াস গান আছে— আধুনিক, শ্যামাসংগীত, ভক্তিগীতি, রজনী-দ্বিজেন্দ্র-অতুল-নজরুল মিলিয়ে— সেগুলি কিছু কিছু শিখতে গেলে এক কালে বাংলার অনেক ছাত্রছাত্রীকেই ‘পালটা’ শিখতে হত। পালটা হল, স্বরগুলি নানান ভাগে, বিভিন্ন পরম্পরায় গেয়ে গেয়ে গলা তৈরি করার প্রকরণ। গলার ব্যায়াম। কিন্তু বেশির ভাগ ‘পালটা’ই শুদ্ধ স্বর দিয়ে তৈরি। ব্যতিক্রম যে ছিল না তা নয়, কিন্তু সেগুলি ব্যতিক্রমই।

গলা তৈরি না হলে গান হবে কী করে? এটা তো বনিয়াদি প্রশ্ন হওয়ার কথা। গলার ব্যায়াম, কণ্ঠচর্চার কিছু পরীক্ষিত উপায়, প্রক্রিয়া না থাকলে এবং সেই পথে না এগোলে যে কোনও দেশে গায়ক-গায়িকা তৈরি হবেনই বা কী করে? মানুষ চিরকাল গান শিখেছে। এমন কোনও দেশ আছে কি, যেখানে কেউ কোনও দিন কারও কাছে গান শেখেনি? আমাদের দেশে কত বিচিত্র ধরনের গান। কিছু কিছু গান গলায় জন্ম থেকে সুর আর তালের আন্দাজ থাকলে, ঝোঁকগুলোকে বোঝার ক্ষমতা থাকলেই, শিখে নেওয়া যায়। কিছু কিছু গানের সুরে আবার স্বরের খেলা, কারুকাজ থাকে। আশ্চর্য, কারও কারও গলায় তার কিছু কিছু বিনা তালিমে, বিনা কণ্ঠচর্চাতেও এসে পড়ে। যেমন ছোট ছোট তান। সবার গলায় কিন্তু আসে না। রবীন্দ্রনাথের গান যে বাংলার মধ্যসমাজে এত জনপ্রিয়, তার একটা কারণ— তাঁর বেশ কিছু গান মামুলি ক্ষমতাতেও মোটের ওপর গেয়ে দেওয়া যায়। দিলীপ কুমার রায় নাকি খেদ করতেন যে তাঁর গান অতটা সমাদর পায়নি। মুশকিল হল, তাঁর গলা এতটাই তৈরি ছিল, এতটাই বিস্ময়কর ছিল তাঁর গলার দৌড় ও দক্ষতা (এই ক্ষমতা নিয়ে কি তিনি জন্মেছিলেন, না বিস্তর খেটেখুটে রপ্ত করেছিলেন?) যে তাঁর সুর করা গানগুলি মোটের ওপর ঠিকমত আয়ত্তে এনে গাইতে গেলে বহু বছর কণ্ঠচর্চা করা, কীর্তন থেকে শুরু করে ধ্রুপদ খেয়াল ঠুংরি পর্যন্ত নানান আঙ্গিকে দক্ষতা অর্জন করা দরকার। বাসরঘরে কেউ না কেউ ‘এসো আমার ঘরে এসো’ বা ‘সে দিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ গেয়ে দিচ্ছেন— এ আমরা সংগীতের এই উদ্ভট সময়েও ভাবতে পারি। কিন্তু দুম করে কেউ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়ে দিচ্ছেন দিলীপ কুমার রায়ের ‘এ যে কোন কর্মনাশা’ বা ‘আজিও তোমারে খুঁজিতে শিখিনি গানে’! এর চেয়ে বরং কল্পনা করা সহজ যে, আজকের কোনও বাংলা অ্যাসিড বা কালকেউটের ছোবল রক্ ব্যান্ড ঠিক সুরে-তালে-ছন্দে-ভাবে ‘আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল’ গানটি গাইছেন-বাজাচ্ছেন এবং পিছনে মস্ত বড় স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে পান্নালাল ভট্টাচার্যর ছবি।

এমন মানুষ সব দেশেই আছেন, যাঁরা গান গাওয়ার উঁচু মানের ক্ষমতা নিয়ে জন্মাননি, কিন্তু গলায় অল্পবিস্তর সুর আছে, আর মাথায় আছে তালের বোধ। সুরের বোধও থাকা দরকার, কিন্তু সেটা দেখেছি গলায় কম-বেশি সুর আর মাথায় তাল-ছন্দ বোধ থাকলে আপনিই থাকে। কম-বেশি গান গাইতে পারে এমন কাউকে দেখেছেন কি, যিনি রবীন্দ্রনাথের ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ গানটি ২৫০ বার শুনেও ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’র সুরে ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ কথাগুলি গেয়ে তবে ছাড়ছেন? এমন ঘটনা কোথাও ঘটলে তা ভারতেই বোধহয় ঘটবে, কারণ, ২০১৫ সালেও ভারতের এক মস্ত নেতা দাবি করতে পারেন, সিদ্ধিদাতা গণেশ হলেন বিশ্বে প্লাস্টিক সার্জারির প্রথম নিদর্শন।

আপশোসের কথা হল, সংগীতচিন্তায় ভারতের ঐতিহ্য হাজার চারেক বছরের পুরনো হলেও, উপমহাদেশে রাগসংগীত, পল্লিসংগীত ও আধুনিক সংগীত এত বিচিত্র ও উঁচু মানের হলেও, গানের গলা তৈরি এবং গানের গলা দীর্ঘ কাল রক্ষা করার কোনও সর্বজনগ্রাহ্য ও যুক্তিসংগত পদ্ধতি আমরা তৈরি করতে পারিনি। এর ফলে এক প্রজন্মের দক্ষ ও কণ্ঠসম্পদবান গায়ক-গায়িকাদের বয়স হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের তালিমে ও শিক্ষায় বিকাশ লাভ করা নতুন প্রজন্মের কণ্ঠশিল্পী আমরা বেশি পাইনি। রাগসংগীতে আচার্য বড়ে গোলাম আলি খান ও আচার্য আমীর খানের শিষ্যদের মধ্যে আমরা ক’জনকে পেয়েছি, যাঁদের গান আজও আমাদের নাড়া দেয়? আধুনিক গানে সুধীরলালের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শ্যামল মিত্র ও উৎপলা সেন দুই দুর্দান্ত শিল্পী। তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে? ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর ছাত্রদের মধ্যে পান্নালাল ভট্টাচার্য, সনৎ সিংহ, সুদাম বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর? জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখেছিলেন। জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের শিষ্যদের মধ্যে ক’জন আমাদের মন জয় করতে পেরেছেন? চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের এক ঝাঁক কণ্ঠশিল্পী ও সুরকার আধুনিক বাংলা গানকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন প্রায় অলৌকিক এক স্তরে। তার পর?

গলা তৈরি, কণ্ঠচর্চা ও গান শেখা বিষয়টি নিয়ে আগামী পর্বেও লিখব।

sumanami kabir suman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy