Advertisement
E-Paper

সি-সেভেন্টিন সিটটা দেবেন প্লিজ!

নব্বইয়ের দশক আমার বেড়ে ওঠার সময়। তখন ডানা গজাচ্ছে, একা একা কলকাতায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। সিনেমা-পাগল হয়ে গেছি— সুপারম্যান থেকে পথের পাঁচালী, ডান্স ডান্স থেকে রুদালী— সব সিনেমা মুখস্থ। হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা ছবি শেষ করে দেখছি তামিল, তেলুগু, ফরাসি, লাতিন আমেরিকান ছবিও।

ববি চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
নব্বইয়ের দশকের নিউ এম্পায়ার সিনেমা হল। চলছে হলিউডি ছবি ‘হোয়াইল ইউ ওয়্যার স্লিপিং’।

নব্বইয়ের দশকের নিউ এম্পায়ার সিনেমা হল। চলছে হলিউডি ছবি ‘হোয়াইল ইউ ওয়্যার স্লিপিং’।

নব্বইয়ের দশক আমার বেড়ে ওঠার সময়। তখন ডানা গজাচ্ছে, একা একা কলকাতায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। সিনেমা-পাগল হয়ে গেছি— সুপারম্যান থেকে পথের পাঁচালী, ডান্স ডান্স থেকে রুদালী— সব সিনেমা মুখস্থ। হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা ছবি শেষ করে দেখছি তামিল, তেলুগু, ফরাসি, লাতিন আমেরিকান ছবিও। আর মুখস্থ করছি আনন্দলোক। কলেজের নাটকে আমার অভিনয় দেখে সবাই বলত, তুই অভিনয় শিখিস? আমি এমন ভাবে মাথা নাড়তাম, হ্যাঁ আর না, দুটোই বোঝাত। আসলে মুখে বলতে পারতাম না, আমি অভিনয় শিখি এসপ্ল্যানেডের সিনেমা হলগুলোয় গিয়ে।

ধর্মতলার প্রতিটা বাঁকে তখন সিনেমা হল। খানকুড়ি তো হবেই। লাল, গোলাপি, হলুদ, সাদা রঙের কাগজের টিকিট পকেটে পুরে, ঢুকে যেতাম সেই মায়াপুরে। সিনেমা-দেখার অভিজ্ঞতা নিয়েই ডায়রি লিখতাম। কোন সিনেমা কেমন লাগল, গল্পটা কী ছিল, সঙ্গে কে দেখতে গিয়েছিল, সব। সঙ্গে সেই সিনেমার টিকিটও আটকে রাখতাম। সেই সব ডায়রি, জমানো টিকিট আজও আছে।

আমার খুব প্রিয় একটা হল ছিল ‘টাইগার’। একতলা হল, তার সাজসজ্জা, পরিবেশ আজকের মাল্টিপ্লেক্সের ধারেকাছেও আসবে না, কিন্তু আমার কাছে ওটাই ছিল স্বপ্নের দুনিয়া। জেমস বন্ডের ‘আ ভিউ টু আ কিল’ সিনেমাটা দেখেছিলাম ওখানে। রজার মুর-এর করা শেষ বন্ড-ছবি, রিলিজের ক’বছর পরে দেখেছিলাম ওই হল-এ। তত দিনে ছবিটাকে নিয়ে উন্মাদনা চরমে। একে ওই বয়স, তার ওপর জেমস বন্ডের ছবি, তাতে ‘এ’ সার্টিফিকেট, আর তারও ওপর এসপ্ল্যানেডের অন্ধকার হল-এ বসে একা একা দেখা। মনে হচ্ছিল, এই তো বড় হয়ে গেছি!

তখন আমার সকাল হত রক্সি-তে। সাড়ে ন’টার শোয়ে তামিল ছবি, তার পর সাড়ে বারোটায় নিউ এম্পায়ার-এর শো। নিউ এম্পায়ারেই মনে হয় সবথেকে বেশি সিনেমা দেখেছি। টিকিট কাটার সময় বলতাম, সি-সেভেন্টিন সিটটা দেবেন প্লিজ! ওটা আমার বাঁধা জায়গা ছিল। ইন্টারভ্যালে সোজা লবি-তে, সেখানে কফিতে কোকো পাউডার ছড়িয়ে দিত। সেই সঙ্গে আপার ক্রাস্ট-এর চিকেন প্যাটিস। ওই দুটো না হলে আমার সিনেমা দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যেত। নিউ এম্পায়ারের পাশেই লাইট হাউস, তার মাথায় ওয়ার্নার ব্রাদার্সের প্রতীক ‘ডব্লু বি’। পাশাপাশি দুটো হল, যেন পিঠোপিঠি দুই ভাইবোন। নিউ এম্পায়ার আজও আছে, লাইট হাউস এখন জামাকাপড়ের দোকান।

সোজা হেঁটে ডানের গলিতে ঢুকলে ‘গ্লোব’। পুরো সাহেববাচ্চা সিনেমা হল, কত্ত যে ইংরেজি সিনেমা আসত! ‘গ্লোবে ইংরিজি ছবি দেখে এসেছি’, বললে খুব সম্মান মিলত সে সময়। ‘বেবি’জ ডে আউট’, ‘লায়ন কিং’, ‘জুরাসিক পার্ক’ ওখানেই দেখেছি। কলকাতার মানুষ রোদজল উপেক্ষা করে ইয়াব্বড় লাইন দিত গ্লোব-এ ছবি দেখতে, লাইন এঁকেবেঁকে চলে যেত নিউ মার্কেটের দিকে। দু’বার মারামারি লেগে গিয়েছিল, এক বার ‘প্রিটি উওম্যান’-এর টিকিটের লাইনে, আর এক বার ‘জাজমেন্ট ডে’র। সারা ভারতে গ্লোবের সাউন্ড আর পিকচার কোয়ালিটির খ্যাতি ছিল। ওরা শব্দ আর প্রোজেকশন এক্কেবারে অরিজিনাল রাখত। আর একটা দারুণ জিনিস ছিল, গ্লোবের বিরাট পরদাটা সিনেমা শুরুর আগে যেমন আস্তে আস্তে উঠত, ঠিক সেই গতিতে হলের আলোগুলোও আস্তে আস্তে নিভে যেত। হল-এর মধ্যে ফ্যান আর এসি মিলিয়ে দারুণ একটা হাওয়া বইত।

ধর্মতলা আর তার চারপাশটা জুড়ে থাকা কত্ত হল তখন! যমুনা, রক্সি, চ্যাপলিন, সোসাইটি, রিগাল, এলিট, মেট্রো, প্যারাডাইস, ওরিয়েন্ট, নিউ সিনেমা, লিবার্টি, মুনলাইট, ম্যাজেস্টিক, লোটাস, জ্যোতি, হিন্দ... কাউকে বাদ দিয়ে ফেললাম? এদের সব ক’টার মধ্যে আমার ছেলেবেলা পড়ে আছে। ‘হিন্দ’-এ তখন সব নামী হিন্দি ছবিগুলো আসত। ‘বেটা’ রিলিজ করেছে, আমার ঠিক সামনের সিটেই বসল একটা বিরাট মোটা আর তেমনই লম্বা লোক। এমনই দশাসই, কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। টর্চ দেখিয়ে সিেট বসিয়ে দিতেন যিনি, তিনি মুখচেনা ছিলেন। খানিক পরে আমাকে টর্চের ইশারায় ডেকে সাইডের একটা সিটে বসিয়ে দিলেন। আমি তো অবাক!

নব্বই দশকের গোড়ার দিকে হিন্দি ছবির হলগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। একটা ফ্যান-ক্লাব ছিল, নাম ‘মিঠুন-মাধুরী ফ্যান অ্যাসোসিয়েশন’। মিঠুনদার ছবি এলেই তারা হল-এ ‘গুরু, গুরু!’ বলে চিৎকার করত আর পাগলের মতো নাচত। ডায়লগ শুনতে পাচ্ছি না বলে বিরক্ত হব কী, আমিই কত বার তালে তাল ঠুকে নেচে ফেলেছি! স্ক্রিনে মাধুরী, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খানের ফার্স্ট অ্যাপিয়ারেন্সের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত মানুষ। বসুশ্রী হল-এ ‘দিওয়ানা’ দেখতে গেছি, ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো। পরদায় শাহরুখ খানের আগমন বিরতির পর, বাইকের ওপর বসে ‘কোই না কোই চাহিয়ে’ গােন। সে দিন বসুশ্রীতে ঝড় উঠেছিল। চার দিকে শুধু পয়সার আওয়াজ। কোল্ড ড্রিংকসের ছিপিও ছুড়ছিল লোকে।

ব্ল্যাকারদেরকেও খুব মিস করি। শাহরুখ-মাধুরী জুটির ‘কোয়লা’ এসেছে মেট্রো সিনেমায়। প্রথম দিন সব শো হাউসফুল। আমি তো আবার সেই দিনই দেখব। তাই ভিড়ের মধ্য থেকে ব্ল্যাকারকে চিনে, তার পিছন পিছন দৌড়লাম সেই ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের অফিস পর্যন্ত। তার পর, টিকিট বাগিয়ে, ভর্তি হল-এ ঢুকে সে কী আনন্দ!

ভবানীপুরের পূর্ণ, উজ্জ্বলা, ভারতী, হাতিবাগানের শ্রী, উত্তরা, ধর্মতলার চ্যাপলিন, মেট্রো, আজ বন্ধ। কোথাও জামাকাপড়ের দোকান, কোথাও অনুষ্ঠানবাড়ি হয়েছে। খুব মনখারাপ হয়। সে দিন একটা ছবির প্রোমোশনে ‘ইন্দিরা’র স্টেজে উঠলাম। কথা বলব কী, আমি তো তখন সমানে দেখে যাচ্ছি সেই সিটটা, যেটায় বসে আমি মিঠুনদার ‘দালাল’ ছবির ‘গুটুর গুটুর’ গানটার সঙ্গে বেদম তালি দিচ্ছিলাম! এই হলগুলো যে আমার বড় প্রিয়! লাইটহাউসের মাথায় আজ যে স্পাইডারম্যান ঝুলে আছে, তাকে প্রায়ই মনে মনে বলি, ভাই, এত তো বড় বড় সমস্যার সমাধান করো, এই নব্বইয়ের সিনেমা হলগুলোকে বাঁচাতে পারো না?

bobbymobil2001@yahoo.com

নব্বইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy