দিগন্ত ছোঁওয়া অতল সুনীল সাগর। সেই সাগরের সোনালি বেলাভূমির এক ছোট গর্তে থাকত এক লাল টুকটুকে কাঁকড়া। সমুদ্রের সঙ্গে তার ভারী ভাব। সুয্যি ওঠার আগে বাসা ছেড়ে সে বেরোত সমুদ্রের ঢেউটাকে এক বার ছুঁয়ে আসার জন্য। আবার সন্ধের আগেও এক বার দেখা করে আসত তার ওই বন্ধুটার সঙ্গে। আর জোয়ারের সময় যখন তার ছোট্ট বাসার দরজার সামনে সমুদ্রভাই এসে দাঁড়াত তখন তার আনন্দ আর দেখে কে!
এই ভাবে দিনগুলো কাটছিল বেশ ভালই। এক দিন হল কী, সমুদ্রের ধারে জেলেরা এসে হাজির। হইহই করে জাল ফেলে অনেক মাছ আর কাঁকড়া ধরে ধরে তাদের হাঁড়িতে ভরতে লাগল। গর্তের ভিতরে থাকায় অতটা বোঝেনি লাল কাঁকড়াটা। সে নিত্যদিনের মতো বেশ একটু সকাল সকালই রওনা দিল সাগরবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। এক পা দু’পা করে এগোতে এগোতে এক বার পিছু ফিরল। দেখল, বা রে! বেশ যে একটা আলপনা তৈরি হয়েছে তার পায়ের ছাপগুলো দিয়ে। এই না দেখে প্রবল উৎসাহে ঘুরে ঘুরে চরকি কেটে কেটে মনের আনন্দে তার দাঁড়া আর পা দিয়ে দিয়ে নতুন নতুন ভাব-বিভঙ্গের বিচিত্র আলপনা তৈরিতে মশগুল হয়ে পড়ল। হঠাৎ, এ কী! হায় হায়! তারই বন্ধু সমুদ্র এক ঢেউয়ে তার এত সাধের আলপনা খানিকটা ধুয়ে দিল যে! কাণ্ড দেখে খানিকটা থতমত খেয়ে কাঁকড়া ভাবল— আচ্ছা কাণ্ড তো! দিল তো আমার এতটা পরিশ্রম বৃথা করে! যা-ই হোক, আর এক বার না হয় চেষ্টা করা যাক।
মনে মনে এই ভেবে লাল কাঁকড়া আবার তার দুই মোটা দাঁড়া আর ছ’খানা সরু দাঁড়া দিয়ে আর এক নতুন ধাঁচের আলপনা তৈরি করতে করতে সমুদ্রের সৈকত দিয়ে সমুদ্রেরই দিকে এগোতে লাগল।
এই যাঃ! একটু পরেই যে আবার বলা নেই, কওয়া নেই সাগরবন্ধুর ঢেউ এসে তার চেষ্টাটা মাটি করে দিল। এ বার কাঁকড়া একটু অবাকই হল। মনে মনে খুব বিরক্ত হয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল, আচ্ছা বেরসিক তো! যাক গে, আর এক বার নতুন করে, সুন্দর করে আলপনাটা দেওয়া যাক। এই না ভেবে নতুন উদ্যমে সে আলপনা কাটতে লাগল সোনালি বালুর ওপর।
এই রে! আবার! আবার সেই বে-আক্কেলে কাণ্ড! দিল সব মুছে!
এ বার লাল কাঁকড়া সত্যিই রেগে আরও লাল হয়ে গেল।
বন্ধু না ছাই! বন্ধু হয়ে বন্ধুর এমন অপকার কেউ করে! রাগে গজগজ করতে করতে আট-আটখানা সরু মোটা দাঁড়া-পা চালিয়ে তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে গেল সে সমুদ্রের কাছে। তার পর বেশ একটু মেজাজ দেখিয়ে বলল, ছিঃ বন্ধু! ছিঃ! আমি তোমায় কত্ত ভালবাসি, আর তুমি কিনা আমার দেওয়া অত সুন্দর আলপনাগুলো বার বার
নষ্ট করছ? কেন বন্ধু, এ রকম কেন তুমি করছ?
সমুদ্র কিন্তু একেবারে শান্ত, চুপচাপ। সমুদ্রের কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে কাঁকড়ার তো খুব দুঃখ আর অভিমান হল। মুখখানা কালো করে এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ছলছল চোখে বলল, আমি না হয় এক ছোট্ট দুর্বল কাঁকড়া আর তুমি না হয় এক শক্তিশালী বিশাল সমুদ্র। তাই
বলে কি বন্ধুর প্রতি এমন নিষ্ঠুর ব্যবাহার করতে হয়? এ কি তোমার মতো বড়র পক্ষে শোভা পায়? বলতে বলতে কাঁকড়ার চোখে তো এ বার জল এসে গেল।
বন্ধুকে অভিমানে কাঁদতে দেখে সমুদ্রের খুব কষ্ট হল। সে এ বার খুব নরম গলায় কাঁকড়ার কাছে জানতে চাইল, ভাই, তুমি কি সত্যিই আমাকে বন্ধু বলে মনে করো? সাগরের সন্দেহ দেখে কাঁকড়া এ বার বেজায় কষ্ট পেল। সে দুই দাঁড়ায় চোখ ঢেকে আরও কাঁদতে কাঁদতে বলল, সে কী! আমি তো সেই কবে থেকে তোমাকে আমার প্রিয় বন্ধু বলে মনে করি। তোমায় কত ভালবাসি আমি! তোমাকে রোজ দু’বেলা না দেখে থাকতে পারি না। তোমার সঙ্গে কত সুখের দুখের গল্প করি, তোমার ঢেউয়ে নাচানাচি করি। তুমি আমার কত বড় আপনজন, তা কি তুমি বোঝো না? আর সেই তুমিই কিনা আমার আনন্দে একেবারে, যাকে বলে একেবারে সত্যিসত্যিই জল ঢেলে দিলে! আমার আলপনা— এক বার নয়, দু’বার নয়, তিন তিন বার নষ্ট করে দিলে! কেন তুমি এমনটা করলে বন্ধু? এই বলে কাঁকড়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
সমুদ্র এ বার কাঁকড়ার আরও কাছে এসে তার নরম নরম ফেনা দিয়ে কাঁকড়ার চোখের জল মুছিয়ে তার গায়ে ছোট ছোট ঢেউয়ের আলতো নরম ছোঁওয়া বুলিয়ে বলল, বন্ধু, তুমি আমার সত্যিকারের প্রিয় বন্ধু। তাই
তো তোমার ভালর জন্যই আমি ও-কাজ করেছি।
আমার আলপনা মুছে দিল, আবার বলছ— ভালর জন্য! কাঁকড়ার চোখে আবার জল। সমুদ্র বলল, তুমি তো জানো না বন্ধু, তুমি যখন তোমার বাসা থেকে বেরোলে, তোমার ওই বাসার একটু দূরেই জেলেরা মাছ আর কাঁকড়া ধরছিল।
জেলেদের কথা শুনে কাঁকড়া তো আঁতকে ওঠে, তাই নাকি! আমি লক্ষই করিনি! কী বিপদ!
হ্যাঁ বন্ধু। তুমি তো আলপনা দেওয়ার আনন্দে মত্ত। আর আমি শুধু ভয় পাচ্ছি, যদি তোমার ওই পায়ের দাগ দেখে জেলেরা তোমাকে ধরে ফেলে, কী হবে! তাই তো আর কোনও কথা না ভেবে তোমার পায়ের দাগ— মানে, তোমার ওই সুন্দর আলপনা আমাকে বারে বারে মুছে দিতে হল। ও বন্ধু, ও আমার ছোট্ট প্রিয় সোনা বন্ধু, তুমি আর রাগ কোরো না। চলো, আমার ঢেউয়ে চড়িয়ে সেই প্রবালদ্বীপের আশ্চর্য আলপনা দেখিয়ে আনি তোমায়।