প্রতিবেদক: আপনার নামে তো অনেক কমপ্লেন! নাকি খেলনা কারখানায় ক্রিসমাসের আগে বেশি ক্ষণ খাটান কিন্তু এক পয়সা ওভারটাইম দেন না!
সান্তা ক্লজ: তোদের বাঙালিদের মূল প্রবলেম কী বল তো? তোরা ভাবিস, ক্যাবলামি একটা মহৎ গুণ! ভুল! যে লোকটা অফিসে বসে কবিতা লেখে, সে মহৎ কবি নয়, সে অপদার্থ কর্মী। তার বই ছাপিও না, নড়াটি ধরে বের করে দাও! একটা বিশাল সিস্টেম চালাতে গেলে ‘সেই ক্যালাকান্ত গোটা দুই আন তো’ পলিসিতে চললে হবে না, লেবারদের চাপে রাখতে হবে, যাতে নিরন্তর বাপ বলে। লাই দিলেই লস! এই তো একটা গাড়ল সে দিন আমার স্যাটেলাইটের আংটা ভেঙে দিল!
প্রতি: আপনার স্যাটেলাইট আছে!
সান্তা: না থাকলে চলবে? ২৪x৭ পৃথিবীর সমস্ত বাচ্চার দিকে নজর রাখতে হয়, এমনকী বাথরুমেও! ব্যাটারা তো চিঠিতে ‘আমি খুব ভাল’ থিমে অংবং মিথ্যের জাহাজ পাঠাচ্ছে, আমায় তো সত্যি পারফর্ম্যান্সটা জানতে হবে!
প্রতি: সে কী! আপনি সারা ক্ষণ শিশুদের দিকে সিসিটিভি তাক করে স্পাইয়ের মতো কটমটান! ওরা তো মিথ্যে বলে না, নাহয় কল্পনার ভাগটা বেশি।
সান্তা: হাঃ, মিথ্যে ওদের জন্মভাই! কল্পনার ভাগটাকে কার্যসিদ্ধির জন্যে ওরা রেগুলেটর টিপে সারা ক্ষণ বেশি-কম করছে। কয়েকটা অবশ্য ঠিকঠাক স্পেসিমেন, হোমওয়ার্ক না হলে নিজেই কান ধরে দাঁড়িয়ে যায়।
প্রতি: এটাই আপনার নামে সবচেয়ে বড় কমপ্লেন, আপনি ‘ভাল বাচ্চা’ আর ‘দুষ্টু বাচ্চা’র স্টিরিয়োটাইপকে ফুয়েল জোগাচ্ছেন! যে বাচ্চারা সমাজের ‘ভাল’ তাঁবুতে সুড়সুড়িয়ে ঢুকছে, সারা ক্ষণ গাঁতিয়ে পড়াশোনা করছে, বাপ-মা’র কথা মিনমিনিয়ে শুনছে— তাদের বরাদ্দ দারুণ খেলনা, আর যারা নিজেরা ভেঙেচুরে নতুন পৃথিবী বানাতে চাইছে— তাদের কয়লার টুকরো!
সান্তা: বাব্বা, তুই তো তেএঁটে বাচ্চাগুলোকে নকশালদের স্টেটাস দিয়ে দিলি রে! খুদে বিচ্ছুদের অসভ্যতা আর ভেবেচিন্তে বিদ্রোহ এক হল? এরা কি উপদেশগুলোকে আখরোটের মতো থেঁতলে দেখছে ভেতরের পেরেকে মরচে কি না? আসলে তো ওরা বদমেজাজি বাঁদর, যারা গুরুজনদের উত্ত্যক্ত করে খিল্লি ভোগ করে, সাউথ সিটি গেলেই আছাড়িপিছাড়ি অসভ্যতা মচিয়ে সফ্ট টয় আদায় করে। যাদের পাছায় আচ্ছাসে থাবড়া মেরে ব্রাইট লাল করে দেওয়া দরকার। বাচ্চা ইস্কুলে ঠিকঠাক পড়ুক, টিচারকে হেসে গুড মর্নিং বলুক, পার্কে গিয়ে অন্য বাচ্চাকে ঠেলে ফেলে না দিয়ে শান্ত হয়ে স্লিপে চড়ুক, হাসিমুখে সবার সঙ্গে চকোলেট শেয়ার করুক— এগুলো চাওয়ার মধ্যে অন্যায় কী?
প্রতি: অন্যায় হল, এর মধ্যে দিয়ে তাকে আসলে একটা প্রতিবাদহীন ও সুতরাং প্রতিরোধহীন নাগরিক করে গড়ে তোলা হচ্ছে। বশ্যতা শেখানো হচ্ছে, যাতে পরে সে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার সাহস না পায়!
সান্তা: উরিশ্লা! তুই তো অ্যা শুনলে অ্যালজেব্রা ভেবে লড়তে লেগে যাস! তোর বাড়ির বাচ্চাকে তা হলে তুই কী বলিস? তুমি আমার কথা শুনতেও পারো, আবার আমায় চার-অক্ষরও দিতে পারো, বন্ধুকে আদরও করতে পারো, মেরে তার দাঁত খুলেও নিতে পারো, সবার সামনে নাকের ফুটোয় আঙুল ঢুকিয়ে সর্দিগোল্লা নিয়ে খেলতে পারো, হেডমাস্টারের মাথায় ওয়াটার বট্ল উপুড় করে দিতে পারো, এগুলো সব তোমার মৌলিক অধিকার? এ বার তুমি বেছে নেবে যেটা পছন্দ? এবং যেগুলোকে সমাজ বাঁশ-বেয়াদপি বলে লেবেল করেছে সেগুলোর দিকেই যদি হেলে থাকো, তবে তুমি রিয়েল এক পিস প্রথা-লাথানো কালাপাহাড়, ফড়ফড়ে ফ্যাতাড়ু, এবং হুররে!
প্রতি: না, আমার বাড়ির বাচ্চাকে ঠিক তা বলিনি—
সান্তা: বলিসনি, কারণ জীবন একটি আঁতেল গ্রন্থ নয়। ধুলোমাটির এই পৃথিবীর বুকে ভেগোলজি আর বজ্জাতি পাঞ্চ করে মহৎ স্টেটাস পাওয়া যায় না। এখানে হাতে তুলে পটল দর করতে হয়, মাসের শেষে ক’দিন মাছ না খেয়ে থাকতে হয়, এবং নিজের সন্তানকে ভদ্রলোক করে গড়ে তুলতে নাকানিচোবানি খেতে হয়। সেখানে থিয়োরির বিপ্লব ফলাতে গেলে হড়কে হড়াৎ! পটি করার পর ছোঁচাতে হয়, এও তো একটি সামাজিক প্রথা, যা অনিচ্ছুক বাচ্চার ঘাড়ে, মানে পেছনে, জোর করে চাপানো হয়! কার্ল মার্ক্স তো তাঁর বাড়িতে ক্রিসমাস উদ্যাপন করতেন, ঝামেলা তো পাকাননি। বাচ্চারা যখন তাঁর ঘাড়ে চড়ে ‘এই ঘোড়া হ্যাট হ্যাট’ বলেছে, তিনি টগবগের তালে বিশাল শরীরটাকে দুলিয়েছেন, ভাবেন তো নি যে এতদ্দ্বারা এরা অবোলা অশ্বকে শোষণ করা শিখছে এবং তার ইচ্ছা-নিরপেক্ষ ভাবে তার ঘাড়ে চড়া যায় ও নিজের যান হিসেবে তাকে ব্যবহার করা যায়, এই হায়ারার্কি তাদের সত্তায় খচিত হয়ে যাচ্ছে?
প্রতি: আরে মার্ক্স তো ঘোড়া-ঘোড়া খেলতে চাইছে বলে বাচ্চাগুলোকে কানচাপাটিও দেননি! বাচ্চাদের আপনি বাঁদর বলছেন, পেটাতে চাইছেন! বাচ্চারা কখনও বাঁদর হয় না, বড়রাই তাদের বাঁদর করে!
সান্তা: হয় তোর চোখ নেই, কিংবা ক্লিশের কাছে লোন আছে। বাচ্চা একটা ফাঁকা কলসি নয়, যে, যা ঢালবে তা দিয়েই তৈরি হবে। সে এক গাদা জিন-ক্রোমোজোমের পিন্ডি, তার স্বভাব অনেকটাই আগে থেকে তৈরি, বহু ক্যান্ডিডেট একেবারে চোখ খুলেই ম্যানিপুলেট করা শুরু করে, ইচ্ছে করে শীতের রাতে বিছানায় ঘুরে ঘুরে হিসি ছাড়ে। আর বাপ-মা’র সেক্স লাইফ নষ্ট করতে তো প্রত্যেকটা ওস্তাদ!
প্রতি: ছিছিছি! ছিঃ! এই আপনি বাচ্চাদের সর্বাধিক মসিহা! এ তো একটা শিশু-ঘিন্নুক! একটা বাচ্চা বচ্ছরকার দিনে খারাপ খেলনা পেলে তার ট্রমা-টা ভাবতে পারেন!
সান্তা: যাব্বাবা! সে যে গোটা বছর অন্যকে ট্রমিয়েছে, তার বেলা? ‘তুমি ভাল হলে পুরস্কার পাবে, খারাপ হলে তিরস্কার’ এই জরুরি শিক্ষাটাকে এড়িয়ে যদি সে বড়ও হয়, কোন পৃথিবীতে জাগ্রত হবে? সেখানে কি সবাইকে সমান প্রোমোশন দেওয়া হবে? সমান হাততালি? তুই কি চাস, পাশ-ফেল উঠে যাক, এটিপি র্যাংকিং ঘুচে যাক? ফেডেরার যে ট্রফি পাবে, হরিদাস পালও তাই? এই সাম্যের ধুনকিতে এর পর তো বলবি, সুন্দরীর উচিত প্রত্যেক ইচ্ছুককে সমান চুম্বন বিলোনো! আরে, মানুষের শ্রেষ্ঠ ঝলকানিগুলো তো অসাম্যের জিংগলই গাইছে! প্রতিভা, চিন্তা, সৃষ্টির গরীয়ান অসাম্যই একটা রবীন্দ্রনাথকে ছিটকে তোলে পিলপিলে গবেটের গাদ থেকে। তা হলে একটা বাচ্চার দাদা ভিখিরিকে নিজের টিফিন দিয়ে যে খেলনা পাবে, সে পাখির চোখে কাঠি বিঁধিয়েও একই খেলনা পাবে কেন?
প্রতি: আরে আপনার আবার এত বেগড়বাঁই টাইপ তত্ত্ব কীসের? শিশুর সবচেয়ে বড় ট্রমা: যখন সে জানতে পারে, আপনি আসলে নেই!
সান্তা: হোহোহো! নেই তো কী হয়েছে? ‘নেই’ কি ‘আছে’র চেয়েও সত্যি নয়? বাঙালি কি নেই-দিনগুলোর ভেতরেই নাক গুঁজড়ে পড়ে নেই? নেই-প্রেমিকার শোকে কি সে ডেলি লেঙ্গি-ব্রণ খুঁটে একাক্কার করছে না? আর, যে ‘নেই’-এর ওপর ভর করে কয়েক হাজার কোটি টাকার বেওসা হ্যাপেনিং, সে ‘আছে’-র মুখে বল্গা পরিয়ে এখনও কয়েক সহস্রাব্দ স্লেজ টানবে!