Advertisement
E-Paper

হলদে রঙের জুলুম

গভীর, ঝকঝকে বিশেষ এক ধরনের হলুদ রং। আলো পড়লে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠত। প্রাচীন কাল থেকেই দূরপ্রাচ্যে ব্যবহৃত হয়েছে রংটি। পঞ্চদশ শতকে ওলন্দাজ শিল্পীরা এই রঙে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। আর উনিশ শতকের মধ্যে তা জয় করে নিল গোটা ইউরোপ। দুনিয়ার তাবড় শিল্পীদের তাক লাগানো এই রঙের নাম ‘ইন্ডিয়ান ইয়েলো’। তৈরি হত প্রধানত ভারতেই।

সুস্নাত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:৩২

গভীর, ঝকঝকে বিশেষ এক ধরনের হলুদ রং। আলো পড়লে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠত। প্রাচীন কাল থেকেই দূরপ্রাচ্যে ব্যবহৃত হয়েছে রংটি। পঞ্চদশ শতকে ওলন্দাজ শিল্পীরা এই রঙে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। আর উনিশ শতকের মধ্যে তা জয় করে নিল গোটা ইউরোপ।

দুনিয়ার তাবড় শিল্পীদের তাক লাগানো এই রঙের নাম ‘ইন্ডিয়ান ইয়েলো’। তৈরি হত প্রধানত ভারতেই। কিন্তু কী ভাবে? উনিশ শতকের শেষ দিক পর্যন্ত এ উত্তর তামাম দুনিয়ার কাছে অজানা ছিল। কৌতূহলও চূড়ান্ত। ১৮৩৯ সালে ‘দি আর্ট অব পেন্টিং ইন অয়েল অ্যান্ড ফ্রেসকো’ গ্রন্থে লেখা হল, এক প্রকার বড়সড় গুল্মের নির্যাস থেকেই সম্ভবত এটা তৈরি হয়। সঙ্গে বলা হল, রঙটিতে গোমূত্রের মতো দুর্গন্ধ আছে। ১৮৪৪ সালে অনেক পরীক্ষার পর ‘দ্য লন্ডন, এডিনবরা অ্যান্ড ডাবলিন ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিন অ্যান্ড জার্নাল অব সায়েন্স’ লিখল, ইন্ডিয়ান ইয়েলো-র উৎকট গন্ধের জন্য অনেকে মনে করেন উট, হাতি বা মোষের গল ব্লাডারে জমা পাথর থেকে রংটি তৈরি হয়; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এটি প্রাণিজ নয়, উদ্ভিদই এর উৎস।

জমাট বাদামি বলের আকারে সেই রং চড়া দরে বিকোত লন্ডন, প্যারিস, ভিয়েনা... আ-ইউরোপ। শুধু ভারতের কোন গ্রামে কী ভাবে যে সেটি তৈরি হয়েছে, তার কোনও হদিশ মিলছিল না। ব্রিটিশ সরকার সেই দায়িত্বই দিল ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়কে। ‘কঙ্কাবতী’ কি ‘ডমরু চরিত’ ছাপা হতে তখনও ঢের দেরি! রহস্যের পরদা ফাঁস করতে মুঙ্গেরে হাজির হলেন ত্রৈলোক্যনাথ। খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দিলেন ১৮৮৩ সালের ২৭ আগস্ট। জানালেন, এই জমাট রং বা ‘পিউরি’ প্রস্তুত হয় বিশেষ রকমের গোমূত্র থেকেই। মুঙ্গেরের মির্জাপুরে এক শ্রেণির গোয়ালা তা প্রস্তুত করে।

গরুগুলিকে শুধু আমপাতা ও জল খাইয়ে রাখা হয়! তার পর নির্দিষ্ট সময়ে তাদের মূত্র সংগ্রহ করা হয়। আগে থেকেই তাদের রেচনস্থানে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে এমন অভ্যাস করে দেওয়া হয় যে, ‘হস্তক্ষেপ’ না করলে তারা মূত্রত্যাগও করতে পারে না। বিন্দুমাত্র মূত্রও যাতে পাত্রছাড়া না হয়, সে জন্যই এই আগাম ব্যবস্থা। মাটির পাত্রে সংগৃহীত মূত্র পর্যায়ক্রমে আগুনে গরম করা হয় ও রোদে শুকোনো হয়। সেই শুকনো অধঃক্ষেপই হাতে করে ঢেলা পাকিয়ে তৈরি হয় বহুমূল্য ইন্ডিয়ান ইয়েলো।

ওই বছরই কলকাতা আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত ‘ইকনমিক প্রোডাক্টস অব ইন্ডিয়া’-এ ছাপা হল ইন্ডিয়ান ইয়েলো-র কথা। কিন্তু আসল তথ্যটি উঠে এল বেঙ্গল ইকনমিক মিউজিয়াম-এর ‘ডাইস অ্যান্ড ট্যানস অব বেঙ্গল’ রিপোর্টে। সাফ বলা হল, যে গরুগুলি এই রং উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, তারা বড়জোর বছর দুয়েক বাঁচে। সুতরাং, যে গোয়ালারা এই কাজ করছে, তারা আদতে গো-হত্যাকারী। এ-ও বলা হল, এ কাজে বেশ মোটাসোটা লাভই হয়ে থাকে, এমনকী, কয়েক জন গোয়ালা আয়করও দিয়ে থাকে! লন্ডনের ‘জার্নাল অব দ্য সোসাইটি অব আর্টস’ ছাপল ‘টি. এন. মুখার্জি’-র পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টটি।

একে উপযুক্ত পুষ্টির অভাব, তার ওপর আমপাতার বিষ। রঙিন রেচনের চাপে নিরীহ প্রাণীর তিলে তিলে করুণ ফ্যাকাশে মৃত্যু। রিপোর্টে গরুর অকালমৃত্যুর অভিযোগ গোয়ালাদের অস্বীকার করার কথা থাকলেও, রিপোর্ট নিয়ে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। অত্যাচারের রং তখন হলুদ।

তবে, বছর দশেক হল, ব্রিটিশ সাংবাদিক ভিক্টোরিয়া ফিনলে ‘কালার: আ ন্যাচারাল হিস্ট্রি অব দ্য প্যালেট’ বইয়ে ত্রৈলোক্যনাথের রিপোর্টটি আদ্যন্ত ভুল বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। ইন্ডিয়ান ইয়েলো-র পরদা ফাঁস নেহাতই ইয়েলো জার্নালিজম, নাকি সত্যিই ভেলকি দেখিয়েছিল ভারতীয় গোমূত্র? ঘটনা যা-ই হোক না কেন, শোনা যায়, অমানবিক পদ্ধতি অবলম্বনের অভিযোগে ১৯০৮ সালে নিষিদ্ধ হয়ে যায় এর উৎপাদন ও বিক্রি। তাই এখন যদি ইন্ডিয়ান ইয়েলো পাওয়া যায়, সম্ভবত তা দু’নম্বরি।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy