Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Iftar food

Zakaria Street Food: খাদ্যরসিকদের ইফতার-পার্টি থেকে মুটে-মজুরদের রোজা ভাঙা, সবেরই গন্তব্য জাকারিয়া স্ট্রিট

নাখোদা মসজিদের ছত্রছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা জাকারিয়া স্ট্রিটের গল্প যতটা সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের, ততটাই সংঘাতের। মাড়োয়ারি আর মুসলিমের অনেক ঘাত প্রতিঘাত, চাপান উতরান, আবার ভাল থাকারও সাক্ষী এই রাস্তা।

জাকারিয়া স্ট্রিট, নাখোদা মসজিদের ছত্রছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এই রাস্তার গল্প যতটা সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান নিয়ে, ততটাই সংঘাতের।

জাকারিয়া স্ট্রিট, নাখোদা মসজিদের ছত্রছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এই রাস্তার গল্প যতটা সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান নিয়ে, ততটাই সংঘাতের। ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র

সায়ন্তনী মহাপাত্র
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২২ ১৭:২৯
Share: Save:

অন্নদাশঙ্কর রায় তার ছেলেবেলার গল্প বলতে গিয়ে পাঠান মাস্টারমশাই খোন্দকার সাহেব, বাবার বন্ধু আতাহার মিয়াঁ আর খেলার সঙ্গী আব্দুলকে নিয়ে যে ছবি এঁকেছেন, সেই সময়টা থেকে আমরা অতিক্রম করেছি অনেকটা পথ, পেরিয়ে এসেছি দেশভাগ, দাঙ্গা, হত্যা, লুণ্ঠনের অনেক বিষবাষ্প। সময়ের সঙ্গে পারস্পরিক বিশ্বাস আর আদান প্রদান কমতে কমতে রয়ে গিয়েছে বৈরিতার এক চোরাস্রোত। তবুও কোনও এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় রমজান মাস এলেই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব পথ গিয়ে আজকাল মিলছে জাকারিয়া স্ট্রিটে।

জাকারিয়া স্ট্রিট, নাখোদা মসজিদের ছত্রছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এই রাস্তার গল্প যতটা সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান নিয়ে, ততটাই সংঘাতের। মাড়োয়ারি আর মুসলিম, এই দুই সম্প্রদায়ের অনেক ঘাত প্রতিঘাত, চাপান উতরান, আবার ভাল থাকার সময়েরও সাক্ষী এই রাস্তা। হাজি নূর মুহাম্মদ জাকারিয়া, যার নামে এই রাস্তার নামকরণ তিনি ছিলেন কাচ্ছি মোমিন সম্প্রদায়ের এক জনপ্রিয় ব্যবসায়ী। ইতিহাস বলে, এই শহরের দরিদ্র মুসলমান সমাজের এক হিতৈষী নেতা হিসেবে বাংলা তথা সমগ্র দেশের রাজনীতিতেও তাঁর প্রভাবশালী ভূমিকা ছিল।

কোনও এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় রমজান মাস এলেই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব পথ গিয়ে আজকাল মিলছে জাকারিয়া স্ট্রিটে।

কোনও এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় রমজান মাস এলেই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব পথ গিয়ে আজকাল মিলছে জাকারিয়া স্ট্রিটে। ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র

আঠেরো শতকের শেষের দিকে, পুরোনো কলকাতার বেশির ভাগ জায়গার মতোই এই জায়গাও ছিল আদ্যন্ত আবাসিক একটি এলাকা। মূলত মুসলিম অধ্যুষিত এই অঞ্চলে, বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের অট্টালিকার পাশেই ছিল ছোট বড় মুসলমান বস্তি। কিন্তু মুসলমান বস্তি বিক্রি হয়ে জমির মালিকানা যখন চলে যেতে থাকে ধনী মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের হাতে তখনই বদলে যেতে থাকে এই রাস্তার চরিত্র। আবার ১৯১০ সালের পর, বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংঘাতে জর্জরিত এই রাস্তা থেকে পয়সাওয়ালা মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ও সরে যেতে থাকে দক্ষিণ কলকাতার দিকে। তার পর থেকেই বড়বাজার সংলগ্ন এই জায়গার চরিত্র ও বদলাতে থেকেছে দ্রুত গতিতে।

বর্তমানের জাকারিয়া স্ট্রিট বললে বোঝায় ব্যস্ত, ঘিঞ্জি এক বাণিজ্যিক এলাকা। পুরোনো ধাঁচের অপূর্ব সুন্দর কারুকার্যময় স্থাপত্যের পাশেই এলোমেলো গজিয়ে উঠেছে দোকানপাট, অফিস ঘর আর গুদাম। সারা বছর মালবোঝাই গাড়ি, যানবাহন, হকার আর পথচলতি মানুষের ভিড় ঠেলে এখানে চলাফেরা করাটাই দুষ্কর। আর রমজানের সময় এলে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় এক মস্ত চ্যালেঞ্জ।

সারা বছর মালবোঝাই গাড়ি, যানবাহন, হকার আর পথচলতি মানুষের ভিড় ঠেলে এখানে চলাফেরা করাটাই দুষ্কর। আর রমজানের সময় এলে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় এক মস্ত চ্যালেঞ্জ।

সারা বছর মালবোঝাই গাড়ি, যানবাহন, হকার আর পথচলতি মানুষের ভিড় ঠেলে এখানে চলাফেরা করাটাই দুষ্কর। আর রমজানের সময় এলে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় এক মস্ত চ্যালেঞ্জ।

মসজিদের সামনে থেকে যেখানে রাস্তাটা রবীন্দ্র সরণির সঙ্গে গিয়ে মেলে, সেই পুরো রাস্তা জুড়ে রমজানের মাসে স্থায়ী দোকানের পাশাপাশি রাতারাতি গজিয়ে ওঠে হাজার অস্থায়ী দোকান। লখনউ, বিহার, গয়া থেকে এসেও মানুষ দোকান দেন। কবাব, হালিম, বিরিয়ানির সঙ্গে বাকারখানি, শিরমালের গন্ধে ম ম করতে থাকে পুরো জায়গাটা।

এক শনিবারের সন্ধ্যায় ঝিকমিক আলোয় সাজানো চাঁদোয়ার তলা দিয়ে আমরা যখন জাকারিয়া পৌঁছলাম, তখন পশ্চিম দিগন্ত রাঙা করে সূর্য পাটে বসেছে আর পুরো রাস্তা জুড়ে সারা দিনের পরে রোজা খোলার এক অদ্ভুত সুন্দর আনন্দময় উৎসবের পরিবেশ। দোকানে, রেস্তরাঁয়, বাড়ির বারান্দায় কিংবা রাস্তাতেও বিছানো হয়েছে দস্তরখান। কোথাও চপ মুড়ি ছোলা, কোথাও বা হরেক ফল আর শরবত দিয়ে রোজা ভাঙছেন সারা দিনের অভুক্ত মানুষজন। মসজিদ থেকেও দেদার বিলোনো চলছে ইফতারি।

‘‘মুহ মে ডালতে হি গোলে গেছে তো দিদি?’’

‘‘মুহ মে ডালতে হি গোলে গেছে তো দিদি?’’

পুরো রাস্তা জুড়েই থরে থরে সাজানো হরেক কিসিমের বাহারি রুটি, কবাব, পকোড়া, দই বড়া, সেমাই আর শরবতের পসরা । এ সব কিছু পাশ কাটিয়ে কোনও দোকানের সামনে এক দণ্ড থামলেই কানে আসবে আন্তরীক অভ্যর্থনা। যে মানুষটা সকাল ১০ টা থেকে প্রকাণ্ড হালিমের হাঁড়ি ক্রমাগত নেড়ে নেড়ে, সন্ধে ৬ টায় লেবু লঙ্কা সহযোগে আমাদের হাতে হালিমের বাটি তুলে দিলেন তার হয়তো তখনও রোজা ভাঙার সময়টুকুও হয়নি। কিন্তু ইফতারি ভোজের স্বাদ নিতে আসা এই ৮০ শতাংশ অমুসলিম জনগণকে খাওয়ানোর সময় তার মুখের হাসির আর আকিঞ্চনের কোনও খামতি নেই।

ফুটপাথের উপর সাজিয়ে বসা রুটির দোকানের কাকা আবার ভাঙা ভাঙা বাংলায় সুন্দর করে বুঝিয়ে দেবেন কোন রুটি কি অনুষঙ্গে খেতে হয়। জোর করে দুটো বাড়তি খাস্তা রুটি তিনি ব্যাগে ভরে দেবেনই আপনার বাড়িতে রেখে আসা ছোট ছোট ছেলে মেয়ের জন্য, ‘‘সকালে নাস্তায় গরম দুধে ভিজিয়ে ওদের দেবেন দিদি। দুপুর অব্দি আর খাই খাই করবে না।’’

কোনও দোকানের সামনে এক দণ্ড থামলেই কানে আসবে আন্তরীক অভ্যর্থনা।

কোনও দোকানের সামনে এক দণ্ড থামলেই কানে আসবে আন্তরীক অভ্যর্থনা।

বোম্বে সিক্স-এর মতো দোকানে প্রবল ভিড় দেখে আবার বাইরে দাঁড়িয়ে পরোটা চাঁপ খেতে চাইলে প্রশ্রয়ের আড়ালে কপালে জুটবে ঈষৎ বকুনি, ‘‘নাহি দিদি, অন্দর যাকে আচ্ছে সে বৈঠকে খাইয়ে, তভি না মজা আয়েগা।’’

ফ্যানের তলায় টেবিলে বসে তৃপ্তি করে খেয়েও আপনার রেহাই নেই। বাইরে বেরিয়ে চাচাকে বলে যেতে হবে এপ্রিলের এই ভরা গরমে ওই বিশাল তাওয়ায় তার বানানো চাঁপ কতটা মোলায়েম আর তুলতুলে ছিল।

‘‘মুহ মে ডালতে হি গোলে গেছে তো দিদি?’’

কবাব, বিরিয়ানি, হালিম বা শরবত যা-ই খান সঙ্গে এই এক গাল হাসি বিনামূল্যে পাবেনই পাবেন। সারা দিন অভুক্ত থেকে, অপরিসীম পরিশ্রম করার পরেও কী ভাবে যে এঁদের হাসি এত অমলিন থাকে সে রহস্য আপনি ভেদ করতে পারুন বা না পারুন, তবুও ঠাসাঠাসি ভিড় ঠেলে, গরমে গলদঘর্ম হয়ে, প্রায় যুদ্ধ করে, লাইন দিয়ে খাবার খেয়েও আপনার মনে এতটুকু বিরক্তি আসবে না। বরং খোদ কলকাতার বুকে ছোট্ট এই এক অন্য ভারত থেকে ফেরার সময় অকারণেই মন জুড়ে থাকবে এক ভাল লাগার রেশ। একটু হলেও আশা জাগবে, হয়তো এ ভাবেই এক দিন সব ঠিক হয়ে যাবে!

উর্দু ভাষায় কিউয়াম কথার অর্থ হল চিনির শিরা। খোয়ায় মাখানো শুকনো, মিষ্টি এই সেমাই স্বাদে গন্ধে আমাদের বাঙালি ঘরের সিমুইয়ের পায়েসের চেয়ে অনেকটাই আলাদা।

উর্দু ভাষায় কিউয়াম কথার অর্থ হল চিনির শিরা। খোয়ায় মাখানো শুকনো, মিষ্টি এই সেমাই স্বাদে গন্ধে আমাদের বাঙালি ঘরের সিমুইয়ের পায়েসের চেয়ে অনেকটাই আলাদা।

আসন্ন ঈদ উপলক্ষে রইল বেনারসী সিমুই বা কিওয়ামী সেমাই এর এই রেসিপি। উর্দু ভাষায় কিউয়াম কথার অর্থ হল চিনির শিরা। খোয়ায় মাখানো শুকনো, মিষ্টি এই সেমাই স্বাদে গন্ধে আমাদের বাঙালি ঘরের সিমুইয়ের পায়েসের চেয়ে অনেকটাই আলাদা।

কিওয়ামী সেমাই (৪ জনের জন্য)

উপকরণ

বেনারসী সিমুই: ১০০ গ্রাম

খোয়া: ১০০ গ্রাম

চিনি: ১২৫ গ্রাম বা আপনার স্বাদ মতো

ঘি: ১/৪ কাপ

ড্রাই ফ্রুটস (মখনা, আমন্ড, কাজু, খেজুর, শুকনো নারকেল, কিশমিশ, পিস্তা ইত্যাদি): ১ কাপ

জল: ১/২ কাপ

দুধ: ২ বড় চামচ

ছোট এলাচের গুঁড়ো: ১/২ চা চামচ

জাফরান: এক চিমটি (রঙের জন্য)

সাজানোর জন্য শুকনো গোলাপের পাপড়ি আর তবক ইচ্ছে মতো

পদ্ধতি

দুধ হালকা গরম করে জাফরান ভিজিয়ে রাখুন।

২ বড় চামচ ঘি গরম করে খুব কম আঁচে সিমুইটাকে ভাল করে ভেজে নিন। সময় নিয়ে কম আঁচে প্রায় ১৫-২০ মিনিট ধরে ভাজুন, এটার উপরে রান্নার স্বাদ ভীষণ ভাবে নির্ভর করবে। হয়ে গেলে নামিয়ে ছড়িয়ে ঠান্ডা করে নিন।

বাকি ২ চামচ ঘি গরম করে প্রথমে মখনা ভেজে নিন, তার পরে বাকি ড্রাই ফ্রুটস দিয়ে হালকা করে ভেজে তুলে নিন।

হালকা হাতে খোয়া গুঁড়ো করে কম আঁচে ২ মিনিট নেড়ে নিন। ঢেলে সরিয়ে রাখুন।

চিনি আর জল দিয়ে কম আঁচে শিরা বানান। চিনিটা গলে গেলে মিডিয়াম আঁচে রান্না করুন আরও ৫ মিনিট। এতে প্রথমে খোয়াটা ভাল করে মিশিয়ে নিন। তার পরে দিন সমস্ত ড্রাই ফ্রুটস। ২ মিনিট রান্না করে গ্যাস বন্ধ করে দিন। আঁচ থেকে নামিয়ে ২ মিনিট এই মিশ্রণটিকে ঠান্ডা করুন। তার পর ভেজে রাখা সিমুই একটু একটু করে মিশিয়ে দিন। শেষে জাফরান ভেজানো দুধ দিয়ে মিশিয়ে ঢেকে রাখুন ১০ মিনিট।

সুন্দর করে বাদাম আর তবক দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Iftar food Zakaria Street ramzan eid Iftar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE