Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Traditional bengali recipe

Phoron for Bengali Dishes: কোন রান্নায় কী ফোড়ন পড়লে স্বাদ বদলে যেতে পারে, জানা আছে কি

রান্নার স্বাদ বাড়াতে সঠিক ফোড়ন অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু অনেকেই জানেন না, কোন রান্নায় ঠিক কোন ফোড়ন দিতে হয়।

পাঁচ ফোড়নে কী আছে অনেকেই তা জানেন না।

পাঁচ ফোড়নে কী আছে অনেকেই তা জানেন না। ছবি: সংগৃহীত

সৌমিতা চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২২ ১৯:৩৮
Share: Save:

বাঙালির জীবনের সঙ্গে ‘আড্ডা’ শব্দটি অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত । এমন অনেক আড্ডার মাঝেমাঝেই শোনা যায় কেউ না কেউ বলে ওঠেন,

‘‘তুই আর ফোড়ন কাটিস না তো।’’

সাধারণত অন্যের কথার মাঝখানে কথা বলাকে বলে ফোড়ন কাটা। কিন্তু কখনও ভেবেছেন এটা কেন বলা হয়? আদতে যে কোনও রান্নার স্বাদ গন্ধ বাড়িয়ে তোলার জন্য মূল উপকরণের মতই সঠিক ফোড়ন খুব জরুরি। ফোড়ন ঠিক না হলেই রান্নার তাল কাটে। কথার মাঝখানে মূল কথার বাইরে অন্য কেউ কিছু বলায় কথার তাল কাটে বলেই হয়তো আমরা বলি ‘ফোড়ন কাটা’। জেনে নিন এই ফোড়নের সাত সতেরো।

ফোড়নটা ঠিক কী, তা অনেকেরই প্রশ্ন। কেউ কেউ জানতে চান, পাঁচ ফোড়ন আদতে কী? কী কী থাকে তাতে? অনেকের কাছেই বিষয়টা পরিষ্কার নয় । অথবা কোন রান্নায় কোন ফোড়ন সঠিক স্বাদ গন্ধ বাড়িয়ে তুলবে, সেটা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন অথবা সংশয় থাকে৷ অনেকই নতুন সংসার করছেন বা সদ্য রান্না শুরু করেছেন। কেউ হয়তো কর্মক্ষেত্রে একা থাকেন, যাঁরা জানেনই না ফোড়নের প্রকৃত ব্যবহার৷ তাঁদের ধারণা কিছুটা স্পষ্ট করার জন্য এই বিশেষ প্রতিবেদন।

ফোড়ন মানে কী

ফোড়ন অর্থাৎ সম্বরা। রান্না শুরু করার আগে তেলে, বা ঘি বা মাখনে প্রথম যে গোটা মশলাগুলি দিলে সুগন্ধ এবং স্বাদ বৃদ্ধি হয়, তাকে বলে ফোড়ন৷ আমরা বাঙালিরা সবুজ মুগ বা কালো বিউলির ডালকে তরকা বলি। যদিও আদৌ তরকার ডাল বলে কিছু হয় না। ওর আসল অর্থ তড়কা। উত্তর ভারতে ডাল বিভিন্ন পদ্ধতিতে বানিয়ে তার উপর ‘তড়কা লাগানো’ হয়ে থাকে। সেটাই মুখে মুখে ঘুরে রান্নার নামই তরকা হয়ে গিয়েছে৷ তবে একটু দেখলেই বোঝা যাবে এই তড়কার প্রকৃত অর্থই ফোড়ন৷

পাঁচ ফোড়ন

প্রথমেই বলা যাক পাঁচফোড়নের কথা। যা নিয়ে এত বিতর্কের অবতারণা সেই পাঁচফোড়নে আসলে কী কী থাকে? পাঁচটি আলাদা গোটা মশলা বা ফোড়নের মিশ্রণই পাঁচ ফোড়ন। এই পাঁচ গোটা মশলা যথাক্রমে মেথি, মৌরি, সাদা জিরে, কালো জিরে ও রাঁধুনি। যাঁরা ভাবেন সর্ষে পাঁচ ফোড়নের অন্তর্গত, তাঁরা আংশিক সঠিক জানেন। কারণ সর্ষে সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা এক ফোড়ন। এটি আলাদা ভাবে ব্যবহৃত হয়৷ যদিও স্থানভেদে বা জিনিসের প্রতুলতার অভাবে কখনও কখনও এক-দুটি মশলা আলাদা হয় পাঁচফোড়নে (যেমন বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে সর্ষে ব্যবহৃত হয়)। কিন্তু আদতে উপরে লেখা পাঁচটি গোটা মশলার সংমিশ্রণই পাঁচফোড়ন।

আদতে যে কোনও রান্নার স্বাদ গন্ধ বাড়িয়ে তোলার জন্য মূল উপকরণের মতই সঠিক ফোড়ন খুব জরুরি।

আদতে যে কোনও রান্নার স্বাদ গন্ধ বাড়িয়ে তোলার জন্য মূল উপকরণের মতই সঠিক ফোড়ন খুব জরুরি।

ফোড়নের বৈশিষ্ট্য

আমাদের দৈনন্দিন খাওয়া দাওয়ার মধ্যে কোথায় কোন ফোড়ন ব্যবহৃত হয়, তা প্রথমেই জানা দরকার ৷

ডাল

ডাল মূলত বাড়িতে আমরা খাই মুগ, মুসুর, বিউলি, অড়হর, আর মটর। বাঙালি বাড়িতে এই ডালগুলি সর্বাধিক প্রচলিত৷ এ বার যেমন ভাজা মুগ ডালে ফোড়ন দিতে হবে সাদা জিরে৷ অপর দিকে কাঁচা মুগডালে কিন্তু পাঁচ ফোড়ন৷ মুসুর ডালের সঙ্গী রাঁধুনি ফোড়ন আর কালো জিরে। অন্য দিকে, মটর বা অড়হর ডালের সঙ্গে হরিহর আত্মা হবে সাদা জিরে ফোড়ন। কিন্তু যদি ওই মটরডালই লাউ বা উচ্ছে দিয়ে তেতোর ডাল বানিয়ে খেতে হয়, তখন কিন্তু ফোড়ন বদলে সর্ষে হয়ে যাবে৷

শুকনো লঙ্কা এবং তেজপাতা এগুলিও কিন্তু একপ্রকার ফোড়ন। যে কোনও ডালে শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিলে খুব সুন্দর একটি গন্ধ আসে৷ আর তেজপাতা ব্যবহার হয় ডালের প্রকারভেদে। যেমন মুগ ডালে সাদা জিরের সঙ্গে শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা দুই-ই দিতে হবে। অন্য দিকে বিউলির ডালে কিন্তু তেজপাতার সঙ্গী হবে মৌরি ফোড়ন৷

বিউলির ডালে কিন্তু তেজপাতার সঙ্গী হবে মৌরি ফোড়ন৷

বিউলির ডালে কিন্তু তেজপাতার সঙ্গী হবে মৌরি ফোড়ন৷

নিরামিষ তরকারি

যদি বাঁধাকপি বা ফুলকপির ডালনা তৈরি করা হয়, যার মূল মশলা আদা-টমেটো বাটা, সেখানে ব্যবহার করা হবে সাদা জিরে৷ আবার যখন এই কপি দুটোরই চচ্চড়ি রান্না হবে, তখনই সাদা জিরের জায়গা দখল করবে পাঁচ ফোড়ন৷ কুমড়োর তরকারি বা আলুর তরকারির ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। কুমড়ো-আলু-পটলের ছক্কাতে ব্যবহার করা হবে সাদা জিরে। উল্টো দিকে কুমড়োর চচ্চড়িতে হয় পাঁচ ফোড়ন, নয় সর্ষে ফোড়ন দিতে হবে আর নামানোর সময়ে পড়বে ভাজা মশলা৷

আলুর ক্ষেত্রেও তাই৷ সাধারণ আলুর দম করলে সাদা জিরে ফোড়ন। আবার আলুর চচ্চড়ি করলে তখন হয় কালোজিরে অথবা পাঁচ ফোড়নের ব্যবহার হবে। সাধারণত রবিবারের সকাল খ্যাত লুচির প্রিয় সঙ্গী হিসেবে পরিচিত সাদা আলুর চচ্চড়িতে কালোজিরে ফোড়ন আর হলুদ ধনেপাতা দেওয়া তরকারিতে পাঁচফোড়ন দেওয়া হয়ে থাকে৷

যদি লাউ রান্না হয় তবে সর্ষে ফোড়ন ব্যবহৃত হবে। আবার চাল কুমড়ো হলে সেটাই সাদা জিরে হয়ে যাবে। তেমন ভাবেই মোচার ডালনাতে সাদা জিরে ফোড়ন, উল্টো দিকে মোচার ঘণ্টতে পাঁচ ফোড়ন এবং থোর ঘণ্টতে সর্ষে ফোড়ন ব্যবহার করা হয় ৷

এ বার আসা যাক, আমাদের সবচেয়ে প্রিয় রান্নায়—পোস্ত। আপনি পেঁয়াজ পোস্ত ছাড়া যে কোনও পোস্তই রান্না করুন না কেন, সেটা কপি পোস্ত, বেগুন পোস্ত, ঢেঁড়শ পোস্ত, ঝিঙে পোস্ত— যাই হোক না কেন, পোস্ত রান্নাতে শুধু কাঁচা লঙ্কা দিয়ে পোস্ত বেটে নিলেই চলে। তা ছাড়া আর কিচ্ছু লাগে না ৷

মাছ যদি শুধু টমেটো ধনেপাতা দিয়ে তেল ঝাল বানানো হয়, সে ক্ষেত্রে কালোজিরে ফোড়ন৷

মাছ যদি শুধু টমেটো ধনেপাতা দিয়ে তেল ঝাল বানানো হয়, সে ক্ষেত্রে কালোজিরে ফোড়ন৷

বাঙালি বাড়ির নিরামিষ রান্নায় আগে সর্বাধিক প্রয়োগ ছিল হিঙের। হিং যদিও কোন ফোড়ন নয়। কিন্তু হিং যে কোনও রান্নার স্বাদের সঙ্গে তার অভ্যন্তরীণ গন্ধকে এত উপাদেয় করে দেয় যে, নিরামিষ রান্নায় হিঙের ব্যবহারের রীতি চলতেই থাকে।

মাছ-মাংস

মাছে কী ভাবে কী ফোড়ন দেওয়া হয়?

মাছ যদি শুধু টমেটো ধনেপাতা দিয়ে তেল ঝাল বানানো হয়, সে ক্ষেত্রে কালোজিরে ফোড়ন৷ যদি ধনে, জিরে দিয়ে ঝোল হয় তবে পাঁচফোড়ন৷ যদি পেঁয়াজ-রসুন বা আদা, টমেটো দিয়ে ডালনা বা কালিয়া হয় তবে সাদা জিরে ফোড়ন। আবার যদি সর্ষে দিয়ে ঝাল বা ভাপা হয় তবে কোন ফোড়নই না৷ অপর দিকে মাংস রান্নায় হিসেব মতো কোন ফোড়নই চলে না যদিও আমরা অনেকেই তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা ও গোটা গরম মশলা ব্যবহার করি কষা মাংসের ক্ষেত্রে। যদি ওটা পাতলা স্যুপ হয় তবে ফোড়ন একদম বাদ৷

মুড়িঘণ্টে যেমন ঘিয়ের মধ্যে প্রথমেই তেজপাতা, গোটা গরম মশলা দিতে হয় আবার তার সঙ্গে সাদা জিরেও দেওয়া হয় ৷

বাঙালি বাড়ির নিরামিষ রান্নায় আগে সর্বাধিক প্রয়োগ ছিল হিঙের।

বাঙালি বাড়ির নিরামিষ রান্নায় আগে সর্বাধিক প্রয়োগ ছিল হিঙের।

বাঙালি রান্না এবং অবাঙালি রান্নায় ফোড়নের ব্যবহার আলাদা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই মহারাষ্ট্র বা উত্তর ভারতের দিকে পোহা, উপমা-জাতীয় রান্নায় ব্যবহার করা হয় সর্ষে ফোড়ন। সঙ্গে অবশ্যই কারিপাতা, শুকনো লঙ্কা৷ দক্ষিণ ভারতীয় রান্নাতেও মূলত এই ফোড়নের ব্যবহার ৷

তাই এক এক অঞ্চলে ফোড়নের ব্যবহার আলাদা। কারণ অঞ্চলভেদে ফোড়ন খানিকটা প্রতুলতার উপরও নির্ভরশীল।

কোন কোন রান্নায় পরে ফোড়ন পড়ে

একটা আদর্শ বাঙালি রান্না আর একটি অবাঙালি রান্নার উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যায়।

অনেকেই হয়তো জানেন না, শুক্তো রান্নায় পরে ফোড়ন দিতে হয়। এটা করার কারণ হল তাতে স্বাদ অনেক ভাল হয়। প্রথমে বড়ি ভেজে তুলে নিতে হয়। তার পর উচ্ছে গুলো অল্প ভেজে সব সব্জি ভেজে নিয়ে সব মশলা দিয়ে কষে জলে সেদ্ধ করে, পরে দুধ মিশিয়ে আরও কিছু ক্ষণ ফুটিয়ে শেষে ঘিয়ের মধ্যে শুকনো লঙ্কা ,তেজপাতা আর পাঁচ ফোড়ন দিয়ে বাকিটা মেশাতে হয়। তার পর ভাজা মশলা ছড়িয়ে নামাতে হয় ৷

ঠিক তেমনই ‘তড়কা লাগানো’। অবাঙালি পরিবারে কালি ডাল বা ডাল মাখানি রান্নার শেষে মাখনে শুকনো লঙ্কা আর রসুন কুচির ফোড়ন দেওয়া হয়। এটি সর্বাধিক প্রচলিত পাকিস্তানি রান্নাগুলিতে এবং খানিকটা পঞ্জাবও ৷

তা হলে বুঝতে হবে, একজন সুরাঁধুনির রান্নাঘরে সব রকম গোটা মশলার উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজনীয়। সামান্য ফোড়নের তারতম্যে আপনি হয়ে উঠবেন বন্ধু মহলে সেরা রাঁধুনি। একই রান্না, একই উপকরণে আলাদা আলাদা ফোড়ন ব্যবহার করে দেখবেন, পার্থক্য নিজেই বুঝতে পারবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Traditional bengali recipe Bengali Food Spices
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE