Advertisement
E-Paper

রীতিমতো বিষয়ী, ধরতেন বাজিও

২০০১। মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে স্ট্রং থিয়োরি কনফারেন্স। আমন্ত্রিত হকিং। সেখানে নৈশভোজে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের হইহুল্লোড়। হকিং তাঁর হুইলচেয়ার চালিয়ে সামিল হলেন নাচে! সঙ্গে গান? তখনকার জনপ্রিয় ধুন ‘ছাঁইয়া-ছাঁইয়া’। 

সত্যি, আলবার্ট আইনস্টাইনের পরে বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ সেলেব বা আইকন তো তিনিই। আছেন বটে রিচার্ড ডকিন্স কিংবা স্টিভেন পিংকার-এর মতো হাতে গোনা আর দু’-এক জন, কিন্তু জনপ্রিয়তায় ওঁরা যে হকিং-এর ধারেকাছে আসেন না। ছবি:রয়টার্স।

সত্যি, আলবার্ট আইনস্টাইনের পরে বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ সেলেব বা আইকন তো তিনিই। আছেন বটে রিচার্ড ডকিন্স কিংবা স্টিভেন পিংকার-এর মতো হাতে গোনা আর দু’-এক জন, কিন্তু জনপ্রিয়তায় ওঁরা যে হকিং-এর ধারেকাছে আসেন না। ছবি:রয়টার্স।

পথিক গুহ

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৮ ০৩:৫২
Share
Save

প্রথম দর্শনে বুঝেছিলাম ‘মানুষ’-টা কেমন। স্টিফেন উইলিয়াম হকিং কত বড় বিজ্ঞানী, তা বোঝার বিদ্যে আমার নেই। কিন্তু, তিনি কেমন মানুষ, তা টের পাইয়ে দিয়েছিলেন একটা মাত্র প্রশ্নে।

সেটা ১৯৮৯। ভারত থেকে চার বিজ্ঞান লেখক ব্রিটেনে আমন্ত্রিত। গন্তব্যের তালিকায় কেমব্রিজ। আমার চাই হকিং-এর ইন্টারভিউ। ব্রিটিশ দূতাবাসের প্রচেষ্টায় তার ব্যবস্থা হল। হকিং তখন খ্যাতির শিখরে উঠছেন। ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ নামের একখানি বই লিখে। বেস্টসেলারখানি পড়ে ফেলেছি। আর, খ্যাতির খ্যাতি ছড়ানোর কাজ করি বলে এই আনন্দবাজার-এর রবিবাসরীয় বিভাগে দেড় পৃষ্ঠা জুড়ে প্রবন্ধও লিখে ফেলেছি। ‘মহাকাশের সম্রাট’। আমার সাধ প্রবন্ধখানি ওঁর হাতে তুলে দেব। আর, কলকাতার ফুটপাথ থেকে কেনা ওঁর বইয়ের পেপারব্যাক সংস্করণে ওঁর সই করিয়ে নেব।

পূর্ণ হল না সাধ। কেমব্রিজে ওঁর ঘরে ঢুকে প্রবন্ধটা দিলাম বটে, তবে বইতে সই করানো হল না। দেখলাম ওঁর আঙুল নাড়ানোর ক্ষমতা চলে গিয়েছে। কথা বলেন বিচিত্র কায়দায়। ভয়েস সিন্থেসাইজার-এ। বুড়ো আঙুল টিপে টিপে কম্পিউটারে খোঁজেন এক এক শব্দ। পরপর বসান সেগুলো। বাক্য তৈরি হলে টেপেন সুইচ। যন্ত্র উচ্চারণ করে ‘ওঁর’ কথা।

সঙ্গী সাইকেল

ইন্টারভিউ শুরু করব, তার আগে হকিং-ই প্রশ্ন করলেন আমাকে। আমার হাতে বইখানি দেখে যন্ত্রের খ্যানখ্যানে আওয়াজ পেলাম: ‘‘হোঁয়্যার ডিঁড ইঁউ গেঁট দিঁস বুঁক ফ্রঁম?’’

আমি হতবাক। বুঝলাম বইখানি দেখে হকিং-এর মনে হয়েছে ওটি পাইরেটেড এডিশন। এবং তিনি রয়্যালটি থেকে বঞ্চিত। তাই...। এই হলেন হকিং। বিজ্ঞানী, তবে ঘোরতর বিষয়ী।

অক্সফোর্ডে নৌকাবিহার

চলে গেলেন মানুষটি। বিজ্ঞানের জগতে যেন ইন্দ্রপতন। সত্যি, আলবার্ট আইনস্টাইনের পরে বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ সেলেব বা আইকন তো তিনিই। আছেন বটে রিচার্ড ডকিন্স কিংবা স্টিভেন পিংকার-এর মতো হাতে গোনা আর দু’-এক জন, কিন্তু জনপ্রিয়তায় ওঁরা যে হকিং-এর ধারেকাছে আসেন না।

আরও পড়ুন: কৃষ্ণগহ্বর অত কালো নয়, তিনিই বলেছিলেন

আধুনিক বিজ্ঞানের এই অবিসংবাদী নায়কত্ব কি হকিং নিজেই তৈরি করেননি? নিন্দুকেরা বলবেন, হ্যাঁ, এটা তাঁর হাতে গড়া। আর কোন বিজ্ঞানী ঘনঘন এত মন্তব্য করেন এতশত বিষয়ে? তা সে পরিবেশ দূষণ বা যুদ্ধবিগ্রহে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার প্রশ্নেই হোক, কিংবা ভিন্‌ গ্রহের জীবেদের পৃথিবী ধ্বংস করার ব্যাপারে? আর কোন বিজ্ঞানীকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন হোয়াইট হাউসে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান? কোন বিজ্ঞানীই বা জিরো-গ্র্যাভিটি স্পেসশিপের স্বাদ পেতে চান, অথবা জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ‘বিগ ব্যাং থিয়োরি’-তে স্ব-চরিত্রে আবির্ভূত হওয়ার সাহস দেখান? হ্যাঁ, এ সবই হকিং-এর ইমেজ-বিল্ডিং এক্সারসাইজ।

১৯৯৫-এ বিয়ে এলেইন মেসনকে।

খ্যাতির শুরু? সেই ১৯৮৮ সালে। ওই একখানি বই প্রকাশের সূত্রে। তারই বা কী ইতিহাস! আর এক বিজ্ঞানীর সঙ্গে এর আগে হকিং লিখেছিলেন ‘দি লার্জ-স্কেল স্ট্রাকচার অব স্পেসটাইম।’ পণ্ডিতি কেতাব। বিক্রি হয়নি তেমন। এ দিকে মেয়ের পড়ার খরচ জোগাড় করতে হবে। হকিং তাই এমন বই লিখতে চান, যা বিকোবে হু-হু করে। থাকবে এয়ারপোর্ট স্টলে, জায়গা নেবে জেমস হেডলি চেজ-এর পাশে। ইচ্ছে পূর্ণ হত না, যদি না সে খবর পেতেন ব্যান্টাম বুকস কোম্পানির এডিটর পিটার গাজার্ডি। খবর পেয়ে তিনি অ্যাডভান্স নিয়ে হাজির। বই লেখালেন হকিং-কে দিয়ে। লেখানো মানে যন্ত্রণা। হাজার বার পান্ডুলিপি বদল। পপুলার মার্কেটের কিস্যু বোঝেন না হকিং। গাজার্ডির নিদান: বইয়ে একটা বিজ্ঞানের ফর্মুলা মানে বিক্রি অর্ধেক। হকিং মানলেন নির্দেশ। গোটা বইটায় একটা মাত্র ফর্মুলা। E=mC2। বই ছেপে বেরোল। বুক লঞ্চ পার্টি নিউ ইয়র্ক হারবারের এক স্টিমারে। অথর্ব, প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী, এক বিজ্ঞানী জগৎ সংসারে মানুষের গূঢ় জিজ্ঞাসা নিয়ে একখানি বই লিখেছেন। মিডিয়ায় ফলাও প্রচার। এর চেয়ে ভাল স্টোরি আর কী আছে?

নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে আলাপচারিতায়, ২০০৮

আরও পড়ুন:

বিজ্ঞানের ঈশ্বরকে আমি কাছ থেকে পেয়েছি

মুম্বইয়ের সেই সন্ধ্যা, ছাঁইয়া ছাঁইয়ায় দুলে চলেছেন তিনি...

এক কোটির উপরে বিক্রি হয়েছে বইখানি। বলা হয়, বাইবেল কিংবা শেক্সপিয়র ছাড়া আর কিছুই ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’-কে ছুঁতে পারেনি। কেমন সে বই? হ্যাঁ, বিশেষণ একটা জুটেছে তার। ‘দ্য মোস্ট আনরেড বুক’। বিশ্বরহস্য ব্যাখ্যায় চেষ্টার কসুর করেননি হকিং। তবুও বইখানি ‘কঠিন’। তা হোক, হকিং সেই যে খ্যাতির শিখরে উঠলেন, থেকে গেলেন সেখানেই। ফেমাস ফর বিইং ফেমাস। এক সময়ে এই ব্যাপারটা আইনস্টাইনকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন। সবাই কেন ওঁদের দু’জনকে দেখতে হামলে পড়ে, তা ব্যাখ্যা করে আইনস্টাইনকে চ্যাপলিন বলেছিলেন, ‘‘জনগণ আমার সবটা বুঝতে পারে, আর তোমার কিছুই বোঝে না, সুতরাং আমরা দু’জনেই বিখ্যাত।’’

হকিং কতটা বিখ্যাত, সে প্রশ্ন অবান্তর। যা প্রাসঙ্গিক, তা হল তাঁর জীবনযুদ্ধ। যে রোগ শনাক্ত হওয়ার পরে ডাক্তারবাবুরা বলেছিলেন, আয়ু আর মাত্র কয়েকটা বছর, সেই মানুষটা দেখতে দেখতে কাটালেন প্রায় পাঁচ দশক। স্নায়ুরোগে শরীর অবশ, চলে গিয়েছে বাক্‌শক্তি, বেঁচে থাকা যেন জড়পিণ্ডবৎ। আঙুলের নড়াচড়াও বহু কাল অন্তর্হিত। শেষের বহু বছর কম্পিউটার চালাতেন ভুরুর মাংসপেশি নাড়িয়ে। অথচ মস্তিষ্কটি কী বিস্ময়কর পরিমাণে সচল! সেখানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভূত-ভবিষ্যৎ চিন্তা, দুরূহ-জটিল অঙ্ক কষা। বিন্দুতে সিন্ধু।

আর সেই মানুষটি জীবন-চাঞ্চল্যে ভরপুর। মজা-মস্করায় ডুবে থাকতে চান। কথায় কথায় বাজি ধরেন সতীর্থ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। ১৯৮০-র দশক। বাজি ধরলেন বিজ্ঞানী এবং পরে নোবেলজয়ী কিপ থর্ন-এর সঙ্গে। সিগন্যাস এক্স-১ মৃত নক্ষত্রটি ব্ল্যাক হোল কি-না, সেই প্রশ্নে। থর্ন বললেন, ওটি ব্ল্যাক হোল। হকিং-এর মত, মোটেই না। বাজি? মিয়াঁ-মিয়াঁ রাজি। বাজির পণ? হকিং জিতলে তিনি দু’বছর ধরে পাবেন হাসির পত্রিকা ‘প্রাইভেট আই’। আর থর্ন জিতলে? বাজিতে তিনিই জিতলেন, এবং এক বছর ধরে পেলেন রগরগে সেক্স ম্যাগাজিন ‘পেন্টহাউস’। মাস পয়লায় থর্নের লেটারবক্সে ওই পত্রিকা দেখে তো থর্নের স্ত্রী রেগে কাঁই।

‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ সম্মান বারাক ওবামার, ২০০৯-এ

২০০১। মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে স্ট্রং থিয়োরি কনফারেন্স। আমন্ত্রিত হকিং। সেখানে নৈশভোজে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের হইহুল্লোড়। হকিং তাঁর হুইলচেয়ার চালিয়ে সামিল হলেন নাচে! সঙ্গে গান? তখনকার জনপ্রিয় ধুন ‘ছাঁইয়া-ছাঁইয়া’।

না, হকিং নোবেল প্রাইজ পাননি। পাননি, কারণ জনপ্রিয়তা ওই প্রাইজের নিরিখ নয়। তবে কি হকিং অবিশ্বাস্য প্রতিভার অধিকারী নন? তিনি কি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেননি? হ্যাঁ, তা করেছেন। যেমন, ব্ল্যাক হোল বিষয়ে। ব্ল্যাক হোল সব খেয়ে ফেলে, এমনকী আলোও, এই তার পরিচয়। সে ধারণা ভেঙে চুরমার করেছেন হকিং। বলেছেন, ব্ল্যাক হোল-ও বিকিরণ করে এক ধরনের জ্যোতি। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘হকিং বিকিরণ’। ওই বিকিরণে এক দিন ব্ল্যাক হোলের কর্পূরের মতো উবে যাওয়ার কথা।

ওই বিকিরণ যদি সত্য প্রমাণিত হত, তা হলে হকিং পেতেন নোবেল প্রাইজ। কারণ, শুধু তত্ত্ব আবিষ্কারেই পুরস্কার মেলে না। মেলে সে তত্ত্ব সত্যি প্রমাণ হলে। কত দিন লাগতে পারে ‘হকিং বিকিরণ’ প্রমাণ হতে? একটা ব্ল্যাক হোল উবে যেতে লাগবে ১-এর পরে ৬৭টি ০ বসালে যে সংখ্যা দাঁড়ায়, তত বছর। তত দিন অপেক্ষা না করলে উবে যাবে না ব্ল্যাক হোল।

পাঠক, উপরের অনুচ্ছেদটি পড়ে হাসছেন তো! তা হলে শুনে রাখুন, প্রখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী অশোক সেন ইলাহাবাদে হরিশ্চন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটে বসে কী বলছেন। অশোকের মতে, ‘‘ব্ল্যাক হোল বিষয়ে হকিং-এর এই গবেষণা আমার এবং আমার মতো বহু বিজ্ঞানীকে পথ দেখিয়েছে। ভবিষ্যতেও দেখাবে।’’

ছবি: এএফপি, রয়টার্স

Stephen Hawking Scientist Passed Away স্টিফেন হকিং

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।