Advertisement
E-Paper

অ্যাসপিরিনেই কাবু হতে পারে ক্যানসার! পথ দেখালেন ২ ভারতীয়

ক্যান্সারের ‘অ্যান্সার’টা কি আছে অ্যাসপিরিনেই? অবাক হতে পারেন, সেই অ্যাসপিরিনের হাতেই রয়েছে দুরারোগ্য ক্যান্সারের ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ থামানোর ‘জাদুমন্ত্র’! অ্যাসপিরিনেই হয় ক্যান্সারের ‘কণ্ঠরোধ’?

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:২৪
ক্যানসার মোকাবিলার এত সুলভ ওষুধ যে হাতের কাছেই রয়েছে, এত দিন পর তা আবিষ্কার করলেন দুই ভারতীয়। —ফাইল চিত্র।

ক্যানসার মোকাবিলার এত সুলভ ওষুধ যে হাতের কাছেই রয়েছে, এত দিন পর তা আবিষ্কার করলেন দুই ভারতীয়। —ফাইল চিত্র।

ক্যানসারের ‘অ্যান্সার’টা কি আছে অ্যাসপিরিনেই?

কার্ডিয়াক পেন কমানোর মোক্ষম ওষুধ অ্যাসপিরিনেই ভোঁতা হয়ে যেতে পারে ক্যানসারের ‘অস্ত্র’!

আপনার চমক লাগতেই পারে, তা হলে আর এত দিন ধরে ক্যানসার রোখার হাতিয়ার কেন তন্নতন্ন করে খুঁজে চলেছি আমরা, যখন হাতের কাছেই রয়েছে অ্যাসপিরিন। খুবই পরিচিত নাম। ব্যবহারও বহুল। কার্ডিয়াক পেন কমাতে ডাক্তাররা যদি প্রথম দু’টি ওষুধের নাম খসখস করে লিখে দেন প্রেসক্রিপশনে, তার একটি আইবুপ্রোফেন হলে, অন্যটি অবশ্যই অ্যাসপিরিন।

অবাক হতে পারেন, সেই অ্যাসপিরিনের হাতেই রয়েছে দুরারোগ্য ক্যানসারের ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ থামানোর ‘জাদুমন্ত্র’! অ্যাসপিরিনেই হয় ক্যানসারের ‘কণ্ঠরোধ’?

সাড়া ফেলে দেওয়া এই আবিষ্কারটির নেতৃত্বে রয়েছেন এক জন ভারতীয় বিজ্ঞানী, প্লেটলেট বায়োলজিস্ট বিনোদ বিজয়ন। সহযোগী গবেষকও ভারতীয়। শুভশ্রী প্রধান। চমকে দেওয়া গবেষণাপত্রটি ফেব্রুয়ারির গোড়ায় ছাপা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ক্যানসার প্রিভেনশন রিসার্চ’-এ। যার শিরোনাম- ‘আনলকিং অ্যাসপিরিনস, কেমোপ্রিভেন্টিভ অ্যাক্টিভিটি: রোল অফ ইরিভার্সিবলি ইনহিবিটিং প্লেটলেট সাইক্লোঅক্সিনেজ-ওয়ান’।


কোলোনোস্কোপিতে কোলন ক্যানসারের এই ছবি দেখতে পাওয়া যায় (ডান দিকে)

ক্যানসার রোখার অস্ত্র রয়েছে যার হাতে, সেই অ্যাসপিরিন

দুই ভারতীয় সহ আন্তর্জাতিক গবেষকদলের এই আবিষ্কারে অ্যাসপিরিনের কপালে ‘জামাই আদর’ পাওয়ার রাস্তাটা যে শুধুই খুলে গেল, তাই নয়, কোনও রকমের ক্যানসার চিকিৎসায় এত দিন অ্যাসপিরিনের ব্যবহার চালু না-থাকলেও আমেরিকার শীর্ষ রোগ প্রতিরোধী সংস্থা ‘ইউএস প্রিভেন্টিভ সার্ভিসেস টাস্ক ফোর্স’ও এ বার কোলন ক্যানসার রুখতে অ্যাসপিরিনকে মাঠে নামামোর সুপারিশ করেছে।

ক্যানসার রোখার লড়াইয়ে হঠাৎ অ্যাসপিরিন ‘হিরো’ হয়ে গেল কেন?

আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে মূল গবেষক টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের হেল্‌থ সায়েন্স সেন্টারের ইনটিগ্রেটিভ বায়োলজির অধ্যাপক লেনার্ড লিশেনবার্জার ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘আমাদের রক্তে যে অনুচক্রিকা (প্লেটলেটস) থাকে, তা আসলে দু’টো কাজ করে। রক্ত তঞ্চন বা শরীর থেকে রক্ত বেরনোর কিছু ক্ষণের মধ্যে রক্ত যে জমাট বেঁধে যায় (ক্লটিং), সেই কাজটা করে অনুচক্রিকা। আবার নতুন নতুন রক্তজালিকাও তৈরি করে। আসলে নতুন নতুন রক্তজালিকা তৈরি করেই রক্ত তঞ্চন করায় অনুচক্রিকা। ক্ষতস্থান থেকে যে রক্তটা শরীরের বাইরে বেরিয়ে আসছিল, নতুন নতুন রক্তজালিকা তৈরি করে সেই রক্তটাকেই ওই নতুন রক্তজালিকাগুলিতে পাঠিয়ে দেয় অনুচক্রিকা। এটা যেমন আমাদের পক্ষে খুব কার্যকরী দিক, তেমনই এই প্রক্রিয়া আবার টিউমারের বাড়-বৃদ্ধিরও অত্যন্ত সহায়ক হয়ে ওঠে। যা খুব বিপজ্জনক। আমরা গবেষণায় দেখেছি, ওই টিউমারের বাড়-বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটাকেই রুখে দিতে পারে অ্যাসপিরিন। অনুচক্রিকা যে টিউমার কোষের বাড়-বৃদ্ধি ঘটায়, সেই কাজটা আসলে করতে পারে একটি এনজাইম (যা আদতে একটি প্রোটিন) বা উৎসেচকের মাধ্যমে। সেই এনজাইমটির নাম- ‘সিওএক্স-ওয়ান’ বা, ‘কক্স-ওয়ান’। অ্যাসপিরিন ওই এনজাইমটিকেই একেবারে অকেজো, নিষ্ক্রিয় করে দেয়। যার ফলে রক্তে ঘোরাফেরা করা অনুচক্রিকার সংখ্যা কমে যায়।’’

চেনা, জানা অ্যাসপিরিনকে কি এ বার ‘সুপার হিরো’ বানানো হচ্ছে?


লেনার্ড লিশেনবার্গার (বাঁ দিক থেকে), বিনোদ বিজয়ন ও শুভশ্রী প্রধান

আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে বেলোর কলেজ অফ মেডিসিনের প্লেটলেট বায়োলজির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ভারতীয় গবেষক বিনোদ বিজয়ন টেক্সাস থেকে ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘আমাদের গবেষণায় কয়েকটি পরীক্ষা করা হয়েছে ওষুধের দোকান থেকে নেওয়া অ্যাসপিরিন দিয়ে। পরে আমরা ওই অ্যাসপিরিনের সঙ্গে ‘ফসফ্যাটিডিলকোলিন’ নামে একটি লিপিড অণু মিশিয়ে একটি জটিল জৈব যৌগ বানিয়ে সেটা দিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। পরীক্ষা চালানো হয় একটি ফ্যাট অণু দিয়েও। অ্যাসপিরিনের সঙ্গে মিশিয়ে বানানো ওই জৈব যৌগটির নাম- ‘অ্যাসপিরিন-PC/PL2200’। হিউস্টনের একটি ওষুধ সংস্থা এই যৌগটি বানিয়ে আপাতত অন্ত্রের কয়েকটি জটিল রোগ সারানোর ওষুধ বানাচ্ছে। দেখা গিয়েছে, এই অ্যাসপিরিন-লিপিড জটিল যৌগের ক্ষমতা সাধারণ অ্যাসপিরিনের চেয়ে অনেক বেশি। এটা টিউমারের বাড়-বৃদ্ধিকে উৎসাহ দেয় যে এনজাইম (‘সিওএক্স-ওয়ান’ বা, ‘কক্স-ওয়ান’), তাকে আরও বেশি করে, আরও দ্রুত অকেজো, নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে এই ‘অ্যাসপিরিন-লিপিড’ যৌগটি। এই ভাবেই ‘হিরো’ অ্যাসপিরিনকে ‘সুপার হিরো’ বানিয়েছি আমরা। আসলে অ্যাসপিরিনের মধ্যেই একটা অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে। অনুচক্রিকার যে ‘দুর্বুদ্ধি’র (প্রোনিওপ্লাস্টিক অ্যাকশন) জন্য টিউমার কোষগুলির অত অস্বাভাবিক হারে বাড়-বৃদ্ধি হয়, তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতাটা রয়েছে অ্যাসপিরিনের মধ্যেই। আর সেটা আরও অনেক বেশি রয়েছে সদ্য বানানো ‘অ্যাসপিরিন-লিপিড’ যৌগটির মধ্যে। আমরা ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে নিশ্চিত হয়েছি যে, ‘অ্যাসপিরিন-লিপিড’ যৌগটির ক্যানসার-প্রতিরোধের (কেমোপ্রিভেন্টিভ) অবাক করা ক্ষমতার ফলে সেটা কোলোরেক্টাল ক্যানসার বা অন্যান্য ক্যানসার রোখার খুব ভাল হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।’’

মানুষের ওপর পরীক্ষাটা (হিউম্যান ট্রায়াল) চালানোর প্রস্তুতি কি চলছে?

আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে বেলোর কলেজ অফ মেডিসিনের মলিকিউলার বায়োলজির প্রফেসর ভারতীয় গবেষক শুভশ্রী প্রধান টেক্সাস থেকে ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘মানুষের ওপর পরীক্ষাটা (হিউম্যান ট্রায়াল) হবে খুব তাড়াতাড়ি। তার পর তা বাজারে আসবে, ‘অ্যাসপারটেক’ ব্র্যান্ড নেমে। আর তার তোড়জোড়-প্রস্তুতি জোরকদমে শুরু হয়ে গিয়েছে হিউস্টনের অ্যান্ডারসন ক্যানসার সেন্টারে।’’

আরও পড়ুন- সদ্যোজাতদের জন্ডিস রোখার পথ দেখিয়ে চমক ভারতীয়ের
কৃত্রিম কিডনি বানিয়ে চমক বাঙালির, বাজারে আসতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি

অ্যাসপিরিনের এই আশ্চর্য ক্ষমতা সম্পর্কে কী বলছেন কলকাতার ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা?


কলকাতার দুই অঙ্কোলজিস্ট। গৌতম মুখোপাধ্যায় (বাঁ দিকে) ও সোমনাথ সরকার

শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কনসালট্যান্ট সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট গৌতম মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘টিউমার কোষের বাড়-বৃদ্ধি কমানোর ব্যাপারে অ্যাসপিরিনের যে এই ক্ষমতাটা রয়েছে, তা আমরা আগে জানতে পারিনি, তা নয়। কিন্তু, অ্যাসপিরিনের মতো ওষুধের বেশ কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া (সাইড এফেক্টস) রয়েছে। ওই ওষুধের ফলে শরীরে একটু বেশি রক্তক্ষরণ হয়। কালো পায়খানা হয়। তবে গবেষকরা যে ‘অ্যাসপিরিন-লিপিড’ যৌগটির মধ্যে এই আশ্চর্য ক্ষমতা আরও বেশি করে দেখতে পেয়েছেন, তা একেবারেই নতুন একটি ঘটনা। এখন দেখতে হবে মানুষের ওপর পরীক্ষায় তা কতটা সফল হয়। আর অ্যাসপিরিনের যে অনেক রকমের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে, তা ‘অ্যাসপিরিন-লিপিড’ যৌগটির মধ্যেও থাকবে কি না, থাকলে তা কমানো যায় কি না, গবেষকদের ও ওষুধ সংস্থাগুলিকে সেগুলিও পরীক্ষা করে দেখতে হবে বাজারে ওই ওষুধ আনার আগে।’’

কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের অঙ্কোলজিস্ট সোমনাথ সরকারের কথায়, ‘‘গবেষণাটি বেশ নজরকাড়া। কিন্তু আমরা ডাক্তাররা সব সময়েই চাইব, এটা যাতে মানুষের উপকারে লাগে। ক্যানসার রোখার পথ খুঁজতে প্রচুর গবেষণা চলছে। প্রতিটিরই লক্ষ্য সেই সেই এনজাইমগুলিকে খুঁজে বের করা, যেগুলি বিভিন্ন রকমের ক্যানসারে উৎসাহ জোগায়। বাজারে ইতিমধ্যেই এমন কয়েকটি ওষুধ রয়েছে। যেমন, ‘টাইরোসিন কাইনেজ’। তবে আমার মনে হয়, অ্যাসপিরিন আর কক্স ইনহিবিটর্স নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।’’

ছবি সৌজন্যে: বেলোর কলেজ অফ মেডিসিন, টেক্সাস

Cancer Aspirin Colon Cancer
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy