Advertisement
E-Paper

অস্ত্রোপচার ছাড়াই এ বার বাইপাস!

ছুরি, কাঁটা, ফরসেপ, ট্রে ছাড়াই বাইপাস সার্জারি! অপারেশন থিয়েটারের বাইরে আর উত্তেজনায় প্রহর গুণতে হবে না। দাঁতে নখ কাটতে হবে না টেনশনে। কারণ, আমার-আপনার, আত্মীয়-পরিজনদের বুকে আর কাটাছেঁড়া করতে হবে না। সার্জারির জন্য আর অ্যাপ্রন পরতে হবে না ডাক্তার, নার্সদের। বাইপাস সার্জারি হয়ে যাবে! নিশ্চিন্তে, এক রকম নিখরচায়। প্রায় চোখের পলকেই।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৬ ১১:৪৯
চলছে বাইপাস সার্জারি।

চলছে বাইপাস সার্জারি।

ছুরি, কাঁটা, ফরসেপ, ট্রে ছাড়াই বাইপাস সার্জারি!

অপারেশন থিয়েটারের বাইরে আর উত্তেজনায় প্রহর গুণতে হবে না। দাঁতে নখ কাটতে হবে না টেনশনে। কারণ, আমার-আপনার, আত্মীয়-পরিজনদের বুকে আর কাটাছেঁড়া করতে হবে না। সার্জারির জন্য আর অ্যাপ্রন পরতে হবে না ডাক্তার, নার্সদের। বাইপাস সার্জারি হয়ে যাবে! নিশ্চিন্তে, এক রকম নিখরচায়। প্রায় চোখের পলকেই।

আর সেই বাইপাসটা নিঃশব্দে যে করবে, সেই ‘সার্জেন’-এর নাম কী জানেন? ‘এজিজিএফ-ওয়ান’। আদ্যোপান্ত ‘জিরো জিরো সেভেন’-এর ঢঙে অপারেশন চালানো সেই ‘জেমস বন্ড’ আদতে একটা প্রোটিন। যা শরীরে নতুন নতুন তরতাজা ধমনী জন্মাতে সাহায্য করে। যে ধমনীগুলিতে রক্ত বয়ে চলার সময় বাধা পায় বলে হার্টে রক্ত পৌঁছতে পারে না আর তার ফলে অক্সিজেন পৌঁছতে পারে না হার্টের কোষ, কলাগুলোয়, ওই ‘জেমস বন্ড’ প্রোটিন তার তাক লাগানো ‘বুদ্ধিমত্তা’ দিয়ে সেই ‘বুড়োটে’ হয়ে বা ক্ষয়ে যাওয়া ধমনীগুলোকে খুব দ্রুত সরিয়ে ফেলতে পারে। বলা ভাল, সেই ‘অপদার্থ’ ধমনীগুলোকে তাদের কাজ থেকে ‘বসিয়ে দিতে পারে’। যেমন, ঠিকমতো কাজ করতে না-পারলে অফিসে কোনও কর্মীকে বসিয়ে দেওয়া হয়! আর যার কাজ নেই, তার সাজও নেই! বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মেই অকেজো ধমনীগুলো ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু ধুরন্ধর প্রোটিন ‘এজিজিএফ-ওয়ান’ তো তার অনেক আগেই বানিয়ে ফেলেছে নতুন নতুন তরতাজা ধমনী। যার মধ্যে দিয়ে বাধাহীন ভাবে ঝোড়ো গতিতে রক্ত বয়ে চলতে পারে। অনায়াসে তা পৌঁছতে পারে হার্ট পর্যন্ত। আর হার্টের কোষ, কলাগুলো যে-রক্ত থেকে অবলীলায় শুষে নিতে পারে তার ‘শ্বাসের বাতাস’- অক্সিজেন।

তা হলে আর অপারেশন থিয়েটারে ‘সার্জারি’র দরকার হবে কেন? বাইপাস সার্জারিটা তো নীরবে, নিঃশব্দে করেই ফেলল ‘জেমস বন্ড’ প্রোটিন ‘এজিজিএফ-ওয়ান’।

গল্পকথা নয়। কোনও কল্পকাহিনী নয়। সাড়াজাগানো ওই আবিষ্কারের খবরটি ছাপা হয়েছে বিজ্ঞান-জার্নাল ‘প্লস বায়োলজি’র ১১ অগস্ট সংখ্যায়। মূল গবেষকদের মধ্যে রয়েছেন এক বাঙালি। আমেরিকার ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের জীববিজ্ঞানী সংযুক্তা রায়বর্মণ। ‘অ্যাঞ্জিওজেনিক ফ্যাক্টর এজিজিএফ-ওয়ান অ্যাক্টিভেটস অটোফ্যাগি উইথ অ্যান এসেন্সিয়াল রোল ইন থেরাপিউটিক অ্যাঞ্জিওজেনেসিস ফর হার্ট ডিজিজ’ শীর্ষক ওই গবেষণাপত্রে চিনের হুয়াঝঙ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যার অধ্যাপক শিং কেনেথ ওয়াং লিখেছেন, ‘‘আমরা ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে দেখেছি, ওই প্রোটিন তাদের হৃদরোগ কমিয়ে দিচ্ছে, সারিয়ে দিচ্ছে।’’

এই ধুরন্ধর প্রোটিন সেটা কী ভাবে করছে, জানতে হলে দু’টি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া আমাদের একটু বুঝে নিতে হবে।

একটির নাম- ‘অ্যাঞ্জিওজেনেসিস’। যে ভাবে শরীরে নতুন নতুন তরতাজা ধমনী বা শিরার জন্ম হয়। ‘এজিজিএফ-ওয়ান’ সেই ধুরন্ধর প্রোটিন, যা এই প্রক্রিয়াটির গতি বাড়িয়ে দেয়। মানে, ওই প্রোটিন প্রয়োগ করা হলে বা তার মাত্রা বাড়ানো হলে শরীরে আরও বেশি করে, আরও দ্রুত নতুন নতুন তরতাজা ধমনীর জন্ম হয়।


প্রোটিনের কেরামতি! ‘অটোফ্যাগি’র গতি বেশি (নীচে), ধীর গতি (ওপরে)

দ্বিতীয় শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটির নাম- ‘অটোফ্যাগি’। এটাও একেবারেই স্বাভাবিক একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। ধমনীর যে কোষ, কলাগুলো নষ্ট বা দুর্বল হয়ে গিয়েছে অথবা ক্ষয়ে গিয়েছে, কিংবা যে কোষ, কলাগুলো আর না থাকলেও চলে, ওই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সেগুলোকে ‘বসিয়ে দেয়’, ‘নিষ্কর্মা’ করে দেয়। ধমনীর মূল স্রোতের কাজকর্ম থেকে সেই কোষ, কলাগুলোকে সরিয়ে দেয়। আর বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে আমরা যে ভাবে এখন নানা রকমের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বানাচ্ছি, এমনকী জ্বালানিও বানাচ্ছি, ঠিক তেমন ভাবেই ওই বাতিল হয়ে যাওয়া কোষ, কলাগুলোর দেহাংশ থেকেই নতুন নতুন তরতাজা কোষ, কলা বানানোর উপাদানগুলো জোগাড় করা হয় ‘অটোফ্যাগি’ প্রক্রিয়ায়। গড়ে উঠতে থাকে নতুন কোষ ও কলা ধমনীতে, হৃদপিন্ডে। পুরনোকে বাতিল করে দিয়ে নতুনকে স্বাগত জানানোর এই শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটি একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত। গবেষকরা দেখেছেন, ‘এজিজিএফ-ওয়ান’ প্রোটিন ‘অটোফ্যাগি’র গতিও উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে। এই প্রোটিন ইঁদুরের মতো মানুষের শরীরেও রয়েছে।

‘আগে মারো, তার পর বাড়ো’। গবেষকরা অবাক হয়ে দেখেছেন, আমাদের শরীরও চলে এই একই নিয়মে। যে নষ্ট হয়ে বা ক্ষয়ে গিয়েছে বা বলা ভাল, ‘বখে গিয়েছে’, তাকে ‘বসিয়ে দেওয়া’, অকেজো করে দেওয়ার কাজটা আগে শুরু হয় আমাদের শরীরে। আগে বাতিল করো। তার পর তার বিকল্প নিয়ে এসো। তাই ‘অটোফ্যাগি’র কাজটা শুরু হয় আগে। তার পর কাজে নামে ‘অ্যাঞ্জিওজেনেসিস’। যার বার্তাটা হল, ‘নতুন নিয়ে আসছি। আগে অকেজোদের হঠাও।’

সত্যিই কি ইঁদুর আর আমাদের শরীর অকেজোদের হঠায় আগে?

মার্কিন মুলুকের ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক থেকে গবেষকদলের অন্যতম সদস্য সংযুক্তা রায়বর্মণ বলছেন, ‘‘আমরা দেখেছি, বাতিল করার প্রক্রিয়াটাই শরীরে আগে শুরু হয়। আমাদের ধমনী বা রক্তনালীটা তৈরি হয় এন্ডোথেলিয়াল কোষ দিয়ে। ইঁদুরেরও। কাজটা শুরু করেছিলাম মানুষের রক্তনালীর এন্ডোথেলিয়াল কোষগুলো নিয়ে। শরীরের মধ্যেই থাকা ওই প্রোটিনের মাত্রা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, আমাদের ‘অটোফ্যাগি’ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটা আরও চনমনে হয়ে উঠল। মানে, ক্ষয়ে যাওয়া ‘বখাটে’ কোষ, কলাগুলোকে বাতিল করার কাজটা আরও দ্রুত বেগে হতে থাকল। সেটা বুঝতে পারলাম কোষগুলোর চেহারা আর চরিত্রের পরিবর্তনে। এর পর আমরা ওই প্রোটিনের মাত্রা বাড়ালাম ইঁদুরের শরীরে। তাতে আরও অবাক হয়ে দেখলাম, ‘হার্ট পেশেন্ট’ ইঁদুরগুলোর হৃদযন্ত্রের শুধু এন্ডোথেলিয়াল কোষই নয়, অন্য কোষগুলিতেও ‘অটোফ্যাগি’ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটা কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। মানে, ওই সব কোষেও শুরু হয়ে গিয়েছে পালাবদলের পালা। রং-বদলের যজ্ঞ। জীর্ণ, পুরনোকে বাতিল করার কর্মযজ্ঞ।’’

বাইপাস সার্জারির অআকখ: দেখুন ভিডিও।

কী ভাবে নিশ্চিত হলেন গবেষকরা?

কিন্তু ‘জীর্ণ, পুরাতন’কে বাতিল করার প্রক্রিয়াটাই যে শরীরে আগে শুরু হয়, সে ব্যাপারে কী ভাবে নিশ্চিত হলেন গবেষকরা?

সংযুক্তার কথায়, ‘‘আগে সবুজ আনো (অ্যাঞ্জিওজেনেসিস) নাকি আগে অবুঝ হঠাও (অটোফ্যাগি), কোন কাজটা আগে শুরু হয়, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে এমন কয়েকটি ওষুধ ইঁদুরগুলোর ওপর প্রয়োগ করা হল, যা তাদের শরীরের স্বাভাবিক ‘অটোফ্যাগি’ প্রক্রিয়াটাকে রুখে দেয়। ‘বখাটে’ কোষগুলোকে বাতিল করার কাজটা করতে দেয় না। তখনও কিন্তু ইঁদুরগুলোর শরীরে ‘এজিজিএফ-ওয়ান’ প্রোটিনের মাত্রা ছিল যথেষ্টই বেশি। যা কি না নতুন নতুন তরতাজা ধমনী জন্মাতে বড় ভূমিকা নেয়। প্রশ্নটা উঠল তখনই। পর্যাপ্ত প্রোটিন থাকলেও কেন নতুন তরতাজা ধমনী বা তার নতুন নতুন কোষ, কলা তৈরি হচ্ছে না? কে বাধা দিচ্ছে? বোঝা গেল, আমাদের শরীর নিয়ম মেনে আগের কাজটা আগে করে, তবেই পরের কাজটায় যেতে চায়। আগে বাতিল করো, পরে গড়ে তোলো। তাই ওষুধের বাধায় ‘অটোফ্যাগি’ (বাতিলের প্রক্রিয়া) হয়নি বলে ‘অ্যাঞ্জিওজেনেসিস’ (নতুন ধমনী বানানোর প্রক্রিয়া) হচ্ছিল না ইঁদুরগুলোর দেহে।’’

তবে এখনও অনেকটা পথ হাঁটা বাকি রয়েছে গবেষকদের। এখনও তাঁদের পুরোপুরি দেখা হয়নি, বাতিল করার প্রক্রিয়াটা কতটা বাড়িয়ে তোলে গড়ে তোলার গতি।

জটিল অস্ত্রোপচারের ছুরি, কাঁচিকে ‘বাইপাস’ করেই হয়তো এ বার বাইপাস ‘সার্জারি’ করে দেবে ‘জেমস বন্ড’!

ছবি সৌজন্যে: সংযুক্তা রায়বর্মণ, জীববিজ্ঞানী, ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক।

আরও পড়ুন- চাঁদেও বেসরকারি পুঁজি! পথ দেখাল অনাবাসী ভারতীয়ের সংস্থা

Blood Vessels AGGF-1 Protein Mice Human Bypass Surgery
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy