মাঝরাতে মায়ের চিৎকারে বাবা ঘুম থেকে উঠে দেখেন দেড় বছরের শিশুপুত্রের মাথার সামনে কুণ্ডলী পাকিয়ে সাপ। ছেলেকে রক্ষা করতে বাবা সাপটিকে সরাতে গেলে বাবার হাতে কামড় পড়ে। সেই রাতেই বাবাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কালো রঙের বিষধর সাপ ‘কালাচ’, বেশ কিছু অঞ্চলে কালচিতিও বলা হয়। চিতি সাপের সঙ্গে মিল থাকলেও এরা সাংঘাতিক বিষধর। যে চারটি সাপের কারণে ভারতে সর্বাধিক মৃত্যু হয়, তাদের অন্যতম। পর দিন সকালে আবার মায়ের বিভিন্ন শারীরিক অস্বস্তি শুরু হয়। মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে জানা যায় সাপটি মাকেই কামড়েছিল। ঘটনাটি ঝাড়গ্রাম-সংলগ্ন এক গ্রামের।
এখন বর্ষা শরতে ঢুকে পড়েছে। খালবিল পরিপূর্ণ। জলে-জঙ্গলে এই সরীসৃপের কামড়ে প্রাণহানি প্রায়ই খবরে। এক-একটি সংবাদ আবার অবিশ্বাস্য পর্যায়ের। এই যেমন যে ঘটনা দিয়ে এই লেখার সূচনা।
বিষাক্ত প্রাণী ‘পয়জনাস’ নয়, ‘ভেনোমাস’। যে সমস্ত প্রাণীর কামড়ের জন্য বিষ শরীরে যায় এবং বিষক্রিয়া দেখা যায়, তারা ভেনোমাস। আর যাদের খেয়ে ফেললে তাদের শরীরের সঞ্চিত বিষ আমাদের দেহে আসে, তারা পয়জনাস। আমাদের দেশে পাওয়া জলঢোঁড়ার আত্মীয় গার্টার সাপের (উত্তর আমেরিকায় পাওয়া যায়) যকৃতে সঞ্চিত হয় বিষ, যার কারণে তারা ‘পয়জনাস’। সাপেদের উপরের চোয়ালে চোখের ঠিক পিছনে থাকে তাদের বিষথলি, যা লালাগ্রন্থির পরিবর্তিত রূপ। আর সাপের বিষ হল বিশেষ ভাবে প্রস্তুত করা জুটক্সিন সমৃদ্ধ ‘লালা’। প্রচলিত মতবাদ অনুসারে, প্রায় ১০ কোটি বছর আগে টক্সিকোফেরা সরীসৃপ গ্রুপ থেকে বিষের উৎপত্তি, তার পর বিস্তার। ভারতে পাওয়া ৩০০-র অধিক সাপের মধ্যে মাত্র ৫০টির বেশি বিষধর। মূলত, কেউটে, চন্দ্রবোড়া, ফুরসা ও কালাচের কামড়ে মৃত্যুর হার সর্বাধিক। এদেরকে ‘মহাচার’ বলা হয়। বিষের শ্রেণিবিন্যাস মূলত তাদের ক্ষতিসাধন করার স্থানের উপর হয়। নিউরোটক্সিন (কালাচ, শাখামুঁটি), যা মূলত কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে নষ্ট করে। মায়োটক্সিন (র্যাটল স্নেক) যা মাংসপেশিকে নষ্ট করে। এবং সাইটোটক্সিন, যার মধ্যে কোষপর্দা-ধ্বংসকারী (গোখরো), হৃদযন্ত্রের উপর ক্ষতিসাধনকারী (কোবরা) এবং রক্তকোষকে (চন্দ্রবোড়া) ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা থাকে। সাপের বিষ মূলত প্রোটিন, এনজাইম (ট্রান্সফারেজ, হাইড্রোলেজ ও অক্সিডোরিডাকটেজ) নিয়ে গঠিত। সাপের বিষ বিশ্লেষণ করে এক ডজন থেকে একশো পর্যন্ত যৌগের সন্ধান পাওয়া গেছে। যদিও প্রাপ্ত যৌগের সংখ্যা বাড়লেই সাপ যে বেশি বিষাক্ত— এই ধরনের কোনও সরল সমীকরণ মেলেনি। সাপের বিষ তাদের বয়স, খাবার ও পরিবেশের উপর নির্ভর করে। কিছু ক্ষেত্রে তো একই প্রজাতির বিভিন্ন সাপের বিষথলিতে বিষের তারতম্য হয়। তবে এই বিষ ইমিউনিটি বা অনাক্রমতা তৈরি করে। যেমন, লিবিয়ার আদিম জনজাতি ‘সাইলি’রা সদ্যোজাত শিশুকে সাপের কামড় খাওয়ায়। তাদের বিশ্বাস, এই পদ্ধতিতে শিশু কতটা খাঁটি এবং মায়ের প্রতি বিশ্বস্ত, তার প্রমাণ মেলে। এই পদ্ধতিকে বলে ‘মিথ্রিডাটিজ়ম’—স্বল্প পরিমাণে বিষ দীর্ঘ দিন নিয়ে এক ধরনের অনাক্রমতা তৈরি করা।