চন্দ্রযান-২-এর ল্যান্ডার ‘বিক্রম’।
সেই তুলনায় কি প্রচারের আলোয় আনা হয়েছিল দুই মহিলা মুথাইয়া বনিতা ও রিতু কারিদহালকে? অথচ, তাঁরাই তো ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রাভিযানের দুই প্রধান কারিগর।
এখনও যে সমস্যাগুলি রয়েছে
একটা সময় ছিল, যখন মেয়েদের চাকরি করা, বাইরে একা চলাফেরা করা, নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে চাওয়া, এমনকি সে মা হতে চায় কি না, সেই সিদ্ধান্তগুলি নেওয়ার অধিকার ছিল না। সমাজ তো সেই অন্ধকার অনেকটাই পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে, অন্তত কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো ফুটেছে মুক্তির আলো। তাই বলে কি এখনও সমাজে মহিলাদের নিগ্রহ, নির্যাতন, অপমান, সামাজিক বৈষম্যের মতো প্রবহমান সমস্যাগুলি নেই? আছে, ভীষণ ভাবে আছে।
একই ভাবে বিজ্ঞানীরাও তো সমাজের বাইরে নন। তাই তাঁদের দুনিয়াতেও মহিলারা নানা রকমের বৈষম্যের শিকার হন। ধরুন, কোনও একটি বিজ্ঞান সংস্থায় একটি বিভাগে মিটিং ডাকা হল বিকেল পাঁচটায়। যাতে দিনের বাকি কাজ সেরে সবাই সেখানে যেতে পারেন। এক জন মহিলা জানালেন, তাঁকে সাড়ে পাঁচটায় চলে যেতে হবে। ক্রেশ্ থেকে মেয়েকে আনতে হবে বলে। অনেক জায়গাতেই তাঁকে বক্রোক্তি শুনতে হবে। বলে দেওয়া হবে মিটিংটা খুব জরুরি। না থাকতে পারলে নানা সমস্যা হবে। অথবা কিছুই না বলে, তাঁকে নানা ভাবে অসুবিধের মধ্যে ফেলা হবে।
এই ছবি আমাদের অনেকের কাছেই চেনা। যার জন্য অনেক সময় মহিলাদের পিছিয়ে পড়তে হয় কর্মক্ষেত্রে।
সমস্যা আরও আছে। মহিলাদের অনেক সময় চাকরির ইন্টারভিউতে জিজ্ঞেস করা হয় তাঁরা বিবাহিত কি না। সন্তান আছে কি না, বিবাহিত হলে স্বামী কি করেন? এক শহরে থাকেন কি না, ইত্যাদি। কোনও মহিলা যদি ভদ্র ভাবে বলেন, যে এই প্রশ্নগুলোর সঙ্গে তাঁর কাজের কোনও সম্পর্ক নেই, তাতেও সমস্যা। কমিটির বিশিষ্টরা বিরক্ত হবেন। তাঁরা অনুচিত প্রশ্ন করেছেন, এ কথা তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়ার ফলে রাগটা গিয়ে পরবে সেই মহিলা চাকরিপ্রার্থীর উপরেই।
‘‘আমরা আসলে মহিলাদের ‘মা’, ‘স্ত্রী’ হিসেবেই দেখি। এক জন মানুষ হিসেবে নয়”, বললেন শুভা তোলে।
বিজ্ঞানীদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সময়টা মোটামুটি ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়স। পিএইচডি-র মাঝামাঝি থেকে শেষ, পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা, (বেশির ভাগ ভারতীয় বিদেশে কয়েক বছর কাটান এই সময়), চাকরি জীবনের শুরু থেকে প্রথম প্রোমোশন, সবটাই ছুটে চলা। এই সময়টাতেই মহিলাদের প্রজনন ক্ষমতাটা বেশি থাকে। তাই নিজের ইচ্ছে, পরিবারের চাপ, অনেক কিছু সামলে চলতে হয় তাঁদের। শিশুসন্তানকে বাড়িতে রেখে ৪/৫ দিনের জন্য চলে যাওয়া সম্ভব হয় না বলে এই সময় মহিলারা বাদ পড়ে যান অনেক কনফারেন্স থেকে। অনেক সময় চাকরির জন্য স্বামী, স্ত্রীকে আলাদা থাকতে হয়। সন্তানের ক্ষেত্রে চলে আসে স্বাভাবিকভাবেই নানা সমস্যা। অনেক মহিলা শুধু এই কারণেই চাকরি ছেড়ে দেন বা চাকরির চেষ্টাই করেন না সন্তানের জন্মের পরে।
মহিলারা উঠে আসছেন আগের চেয়ে বেশি
কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক মহিলাদের এই সমস্যার কথা মনে রেখে ২০০৩-এ শুরু করে ব্যক্তিগত কারণে কেরিয়ারে ফাঁক পড়ে যাওয়া মহিলাদের জন্য একটি বিশেষ প্রকল্প। চালু করে কয়েকটি বিশেষ পুরস্কার। গবেষণার রসদ জোগানোর সরকারি ব্যবস্থা রয়েছে গত দশ-বারো বছর ধরে, উপকৃতও হয়েছেন এতে অনেক মহিলা। তবে এখনও অনেক পথ হাঁটতে হবে আমাদের।
বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞান সংস্থায় আজ অবশ্য মহিলাদের আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে। তবে সেটা একেবারেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে। তাঁদের অসামান্য প্রতিভার স্ফূরণে।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি তার ৮৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম এক জন মহিলাকে (অধ্যাপক চন্দ্রিমা সাহা) সভাপতি পদে নির্বাচিত করেছে। এ ছাড়াও রয়েছেন কেন্দ্রীয় বায়োটেকনোলজি মন্ত্রকের সচিব রেণু স্বরূপ, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার উপাচার্য নাজমা আখতার, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অধিকর্তা আন্নাপূর্নি, কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের অধিকর্তা আঞ্জু শেঠ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা সঙ্ঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়।
অবস্থা বদলাচ্ছে...
ভারতে বিজ্ঞানের দুনিয়ায় মহিলাদের নিয়ে আলোচনায় এক সময় শুধুই সমস্যাগুলি তুলে ধরা হত। কিন্তু এখন উঠে আসে সমাধান। তুলে ধরা হয় ‘সাকসেস স্টোরি’। উদ্বুদ্ধ করা হয় মেয়েদের। যাতে আরও বেশি করে মেয়েরা বিজ্ঞানকে বেছে নেয় কেরিয়ার হিসেবে। তাই ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ক্রেশের ব্যবস্থা, মহিলা সহকর্মীদের পারিবারিক দায়িত্বকে সম্মান জানিয়ে প্রয়োজনে তাঁদের কাজ একটু ভাগ করে নেওয়া। সন্ধ্যার পর বা ছুটির দিনে নিতান্তই প্রয়োজন না হলে জরুরি মিটিং না ডাকা। অন্য যে কোনও ক্ষেত্রে কর্মরত মহিলাদের মতো এই সব ক্ষেত্রেও প্রয়োজন পরিবারের সহযোগিতা, সহমর্মিতা।