Advertisement
E-Paper

বৃহস্পতি, শনির ‘দাদাগিরি’ই বাঁচিয়ে চলেছে পৃথিবীকে

লিখছেন সুজন সেনগুপ্ত (জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর)রীতিমতো দাদাগিরি চালাচ্ছে বৃহস্পতি! বরাবরই ‘বড় দাদা’র ভূমিকা পালন করেছে বৃহস্পতি, আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহে প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আর তার সঙ্গে সঙ্গত করে চলেছে গ্যাসে ভরা আরও একটি সুবিশাল গ্রহ- শনি। সে ক্ষেত্রে বলাই যায়, পৃথিবীর ঠিকুজি-কোষ্ঠীতে বরাবরই ‘একাদশে’ রয়েছে বৃহস্পতি! একেবারে তুঙ্গে! কপাল ভালই বলতে হবে পৃথিবীর, তাকে পড়তে হয়নি শনির কোপেও! বরং বৃহস্পতি আর শনি- গ্যাসে ভরা এই দু’টি সুবিশাল গ্রহের দয়া-দাক্ষিণ্যেই বার বার বেঁচে গিয়েছে পৃথিবী। লিখছেন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুজন সেনগুপ্ত।

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১২:৪৪
গ্রহাণুকে বুকে টেনে যে ভাবে পৃথিবীকে বাঁচিয়েছে বৃহস্পতি।

গ্রহাণুকে বুকে টেনে যে ভাবে পৃথিবীকে বাঁচিয়েছে বৃহস্পতি।

রীতিমতো দাদাগিরি চালাচ্ছে বৃহস্পতি!

তবে যুগ যুগ ধরে নানা রকমের দাদাগিরি দেখতে দেখতে দাদগিরি বলতে আমরা যা বুঝি, বৃহস্পতি কখনওই তেমন ‘দাদা’ হয়নি।

বরং বরাবরই ‘বড় দাদা’র ভূমিকা পালন করেছে বৃহস্পতি, আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহে প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আর তার সঙ্গে সঙ্গত করে চলেছে গ্যাসে ভরা আরও একটি সুবিশাল গ্রহ- শনি। সে ক্ষেত্রে বলাই যায়, পৃথিবীর ঠিকুজি-কোষ্ঠীতে বরাবরই ‘একাদশে’ রয়েছে বৃহস্পতি! একেবারে তুঙ্গে! কপাল ভালই বলতে হবে পৃথিবীর, তাকে পড়তে হয়নি শনির কোপেও! বরং বৃহস্পতি আর শনি- গ্যাসে ভরা এই দু’টি সুবিশাল গ্রহের দয়া-দাক্ষিণ্যেই বার বার বেঁচে গিয়েছে পৃথিবী। আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহে প্রাণ টিঁকে থাকতে পেরেছে। তার বিবর্তন সম্ভব হয়েছে। সেই বিবর্তন আরও এগিয়ে যেতে পেরেছে।

আরও পড়ুন-
প্রাণের খোঁজে শনির চাঁদে সাবমেরিন পাঠাচ্ছে নাসা, দেখুন ভিডিও

যে ভাবে গ্রহাণুর পথ বদলে দিয়ে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে চলেছে বৃহস্পতি।

আসলে পৃথিবীর জন্মের সময় আর তার অবস্থানই কপাল খুলে দিয়েছে আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের। বুধ, শুক্র, মঙ্গল আর পৃথিবীর মতো পাথুরে গ্রহগুলো আমাদের এই সৌরমণ্ডলে গড়ে উঠেছে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস বা নেপচুনের মতো গ্যাসে ভরা সুবিশাল গ্রহগুলোর জন্মের অনেক অনেক পরে। পৃথিবীর কপাল ভাল বলতে হবে এই জন্যেও যে, আমাদের সৌরমণ্ডলে গ্যাসে ভরা সুবিশাল গ্রহগুলো সূর্যের চেয়ে রয়েছে অনেক অনেক দূরে। সৌরমণ্ডলের প্রায় শেষ প্রান্তে বা, তার কিনারা ঘেঁষে।

গ্যালারি- দেখুন, কী ভাবে বার বার ধূমকেতুর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বৃহস্পতি

আর বুধ, শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গলের মতো পাথুরে, ছোট গ্রহগুলো রয়েছে সূর্যের অনেক বেশি কাছাকাছি। অন্যান্য সৌরমণ্ডলে এই ঘটনাটা ঘটেনি। ঘটেছে উল্টোটা। ওই সৌরমণ্ডলগুলোতে গ্যাসে ভরা সুবিশাল গ্রহগুলো সূর্যের অনেক বেশি কাছে রয়েছে। আর পাথুরে গ্রহগুলোকে ঠেলে দিয়েছে ওই নক্ষত্রদের চেয়ে অনেক বেশি দূরে। ধন্যি কপাল বটে পৃথিবীর! একমাত্র আমাদের সৌরমণ্ডলেই এই ঘটনাটা ঘটেছে বলে এখনও পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অনুমান। আর তার ফলেই বার বার অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছে পৃথিবী। কোটি কোটি বছর ধরে ধূমকেতু, গ্রহাণু বা উল্কার আঘাত পৃথিবীকে অনেক কম সইতে হয়েছে। তাদের ঝাপটা অতটা সহ্য করতে হয়নি বলে আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহে প্রাণ টিঁকে যেতে পেরেছে। বিবর্তিত হতে পেরেছে। সেটা সম্ভব হয়েছে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস আর নেপচুনের ‘দাদাগিরি’র জন্যই।


ধূমকেতু, গ্রহাণুর আঘাতে বৃহস্পতির গায়ে ‘ক্ষত’।

কী ভাবে, সেটা একটু খোলসা করে বলা যাক।

এই সৌরমণ্ডলের প্রায় শেষ প্রান্তে, ইউরেনাস, নেপচুনের পরেই রয়েছে পাথর আর গ্যাসের ‘রাজ্য্’, যার নাম- ‘ক্যুইপার বেল্ট’। এক সময় গ্রহের তকমা পাওয়া, এখন ‘বামন গ্রহ’ প্লুটো রয়েছে ওই ক্যুইপার বেল্টেই। তার পরেই রয়েছে জমাট গ্যাসের ‘উরট্‌ ক্লাউড’। ওই গ্যাসের মেঘই সৌরমণ্ডলের ‘পাঁচিল’। এই সৌরমণ্ডলের গ্রহগুলো গড়ে ওঠার আগে চাকতির মতো গ্যাস ও পাথরের যে ‘প্রোটো-প্ল্যানেটারি ডিস্ক’ তৈরি হয়েছিল, গ্রহগুলোর জন্মের পর তার যে অংশটুকু পড়ে ছিল, সেটাই গড়ে তুলেছিল ক্যুইপার বেল্ট। সে জন্যই তা দেখতে অনেকটা বেল্ট বা বলয়ের মতো। আর সূর্য জন্মানোর পর ঘন গ্যাসের যে মেঘটুকু পড়ে ছিল, তা দিয়েই গড়ে উঠেছিল ‘উরট্‌ ক্সাউড’। যা দেখতে অনেকটা গোলকের মতো।


ধূমকেতু, গ্রহাণুর আঘাতে বৃহস্পতির গায়ে ‘ক্ষত’।

ধূমকেতু, গ্রহাণু আর উল্কাগুলোর আঁতুড় ঘর ওই ক্যুইপার বেল্ট আর উরট্‌ ক্লাউডই। সেখান থেকে বেরিয়ে, সূর্যকে পাক মারতে মারতে তাদের সামনে পড়ে যায় নেপচুন, ইউরেনাস, শনি আর বৃহস্পতির মতো বড় বড় গ্রহগুলো। ‘হ্যালির ধূমকেতু’র মতো যে ধূমকেতুগুলোকে মোটামুটি অল্প সময়ের ব্যবধানে দেখা যায়, তারা আসে মূলত, ক্যুইপার বেল্ট থেকে। আর ‘হেল বপ’ ও ‘হায়াকুতাকে’র মতো যে ধূমকেতুগুলিকে আমরা কয়েকশো’ বছর পর পর দেখতে পাই, তারা আসে উরট্‌ ক্সাউড থেকে। ওই বড় গ্রহগুলোর অভিকর্ষ বল অত্যন্ত জোরালো হওয়ায় ধেয়ে আসা ধূমকেতু, গ্রহাণু বা উল্কাগুলোকে তারা নিজেদের দিকে টেনে নেয়। আর সে জন্যই কোটি কোটি বছর ধরে প্রথমে নেপচুন, ইউরেনাস আর তার পরে শনি ও বৃহস্পতির ওপর আছড়ে পড়েছে বহু ধূমকেতু, গ্রহাণু বা উল্কা। বড় বড় গ্রহগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। আর এই ভাবেই বুলেটের মতো ধেয়ে আসা ধূমকেতু, গ্রহাণু বা উল্কার সামনে নিজেদের বুক পেতে দিয়ে কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে চলেছে বৃহস্পতি। শনি, ইউরেনাসও। সজোরে পৃথিবীর গায়ে ঘনঘন তাদের ধাক্কা লাগলে বা ঝাপটা এসে পড়লে পৃথিবীতে প্রাণের টিঁকে থাকা সম্ভব হতো না। কারণ, পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসার সময়ে তারা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেত। সেই টুকরোটাকরাগুলো ধুলোবালির যে পুরু চাদরটার জন্ম দিত, তা আমাদের বায়ুমণ্ডলকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলত। তার ফলে, সূর্যের আলো আর পৃথিবীতে পৌঁছতে পারতো না। প্রাণও টিঁকে থাকতে পারতো না।

তবে বৃহস্পতি, শনির কড়া নজর এড়িয়ে যে ধূমকেতু, গ্রহাণুগুলো কোনও দিনই জোরালো ধাক্কা মারেনি পৃথিবীকে, তা নয়। বহু বার ধাক্কা মেরেছে। ৬ কোটি বছর আগে মেসোজোয়িক যুগে ধূমকেতুর এমনই এক জোরালো ধাক্কা সইতে হয়েছিল পৃথিবীকে। যার জেরে ডাইনোসরের মতো দৈত্যাকার প্রাণীরা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। মহাপ্রলয় ঘটেছিল। সমুদ্রের সব জল বাষ্পীভূত হয়ে গিয়েছিল প্রচণ্ড উত্তাপে। এই ধাক্কা এতটাই জোরালো হতে পারে যে, তা কক্ষপথে টাল খাইয়ে দিতে পারে পৃথিবীকেও। তার ফলে পার্থিব ঋতু বদলে যেতে পারে। বদলে যেতে পারে তার দিন-রাতের হিসেবও। দুই ‘দাদা’ বৃহস্পতি আর শনি, এই সবের হাত থেকেই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে চলেছে। প্রাণকে টিঁকে থাকতে সাহায্য করেছে।

পৃথিবীকে তার এখনকার কক্ষপথে ধরে রাখার জন্যও বিস্তর অবদান রয়েছে বৃহস্পতি ও শনির। এই কক্ষপথই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে বাসযোগ্য করেছে। প্রাণের টিঁকে থাকার পক্ষে সহায়ক হয়েছে।

অন্য সৌরমণ্ডলে গ্যাসে ভরা বিশাল গ্রহগুলো তাদের নক্ষত্র্রের অনেক কাছে রয়েছে। ফলে, সেই সব নক্ষত্র থেকে দূরে থাকা ‘হ্যাবিটেব্‌ল জোনে’ যদি পৃথিবীর মতো কোনও বাসযোগ্য গ্রহ থাকার সম্ভাবনা থাকেও, তা হলে সেই সম্ভাবনাকে অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছে তাদের ওপর মুহুর্মুহু ধূমকেতু ও গ্রহাণুর আছড়ে পড়ার ঘটনা। আমাদের সৌরমণ্ডল এ ব্যাপারে একেবারেই অভিনব। কারণ, এখানে উল্টো ঘটনাটা ঘটেছে। আর সেটাই পৃথিবীর বাসযোগ্য হয়ে ওঠার অন্যতম প্রধান কারণ।

তাই বলাই যায়, বৃহস্পতি, শনি যদি না থাকত, তা হলে পৃথিবীকে বাসযোগ্য গ্রহ বলে কি চিনত লোকে!!!

ছবি সৌজন্য: নাসা

jupiter sun orbit saturn earth
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy