আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর, সামরিক ও বিলাসবহুল জাহাজের বন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, শিল্পকেন্দ্র, নবনির্মিত শহর। ৯২ হাজার কোটি টাকা খরচ করে সুদূর নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে, বিশেষত নিকোবর দ্বীপে এই বিপুল প্রকল্পের কাজ অতি দ্রুততার সঙ্গে শুরু করেছে ভারত সরকার। নীতি আয়োগের অনুমোদন পেয়ে দ্বীপের প্রায় ১৬৫০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে এই বিপুল প্রকল্পের সলতে পাকানোর কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। এপ্রিলে গ্রেট নিকোবর দ্বীপ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য দরপত্র ডাকা হয়েছে। আর তার সঙ্গেই শুরু হতে চলেছে স্থানীয় প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রের উপরে এর মারাত্মক প্রভাব।
কারণ, এই বিপুল পরিকাঠামোগত উন্নয়নের খেসারত হিসাবে কাটা হবে কয়েক লক্ষ মহীরুহ। ঘর হারাবে ‘মেগাপোড’ পাখি, যা দেশে শুধু এখানেই মেলে। প্রজননক্ষেত্র হারাবে লেদারব্যাক সি টার্টল। বাসস্থান ও জীবনযাপনের অধিকার হারাবে নিকোবর দ্বীপে বসবাসকারী ‘শম্পেন’ ও ‘নিকোবরি’ উপজাতি।
সরকারি উদ্যোগে এই ন্যায়-নীতিহীন প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে গত শনিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনাসভাতেও উঠে এল, কী ভাবে তা স্থানীয় জনজাতি ছাড়াও সুন্ডাল্যান্ড জীববৈচিত্র্য হটস্পটের উপরে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে চলেছে। এই আলোচনাসভার আয়োজক সিটিজেন্স কালেক্টিভের সদস্য এবং পরিবেশকর্মী কুণাল দেব জানাচ্ছেন, শম্পেন নামে একটি বিচ্ছিন্ন জনজাতির বসবাস নিকোবর দ্বীপে। ২০১১ সালের জনগণনায় তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২২৯ জন। তাদের বাসস্থান অঞ্চল ট্রাইবাল রিজ়ার্ভ এলাকা হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি তা ‘ডিনোটিফাই’ করা হয়েছে। ফলে উন্নয়নের ঠেলায় প্রকৃতির বুকে বাসস্থান ও স্বাধীন জীবনযাপনের অধিকার হারাতে চলেছে তারা। ‘‘এই প্রকল্পের কারণে অচিরেই হয়তো নিজভূমে পরবাসী হয়ে উঠবে শম্পেন জনজাতি। বলা হচ্ছে, জঙ্গল কেটে সাফ করে মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকায় শিবির বানিয়ে শম্পেনদের রাখা হবে। কিন্তু তারা তা মানতে রাজি না হলে? তখন হয়তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে নির্মম ভাবে সরানো হবে তাদের। ওরা জানতেও পারবে না, কেন তাদের থেকে জীবনযাপনের অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।’’ —বলছেন কুণাল।
ওই দ্বীপের বর্তমান জনসংখ্যা মাত্র আট হাজার। উন্নয়ন-কাণ্ডের পরে তা বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে আট লক্ষে! ক্ষুদ্র দ্বীপটি এই বিপুল জনস্ফীতি সামাল দিতে পারবে কিনা, উঠছে সেই প্রশ্নও। বহিরাগতদের ছোঁয়াচ লেগে মৃত্যু হতে পারে যে শম্পেন জনজাতির, সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের আনাগোনা তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর বলেও মনে করছেন অনেকে।
সেই সঙ্গে ওই প্রকল্পের গুঁতোয় নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে ডারউইনের বিবর্তনবাদের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত সুন্ডাল্যান্ড জীববৈচিত্র্য হটস্পটের ভারতীয় অংশটি (নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ)। কী ভাবে? সভার অন্যতম প্রবক্তা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক নারায়ণ ঘোড়াই জানাচ্ছেন, এর জেরে ১৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রায় ১০ লক্ষ ক্রান্তীয় বৃক্ষ কাটা হবে। ফলে ভারসাম্য হারাবে অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র, বাসস্থান হারাবে প্রাচীন মেগাপোড পাখি। গ্যালাথিয়া খাঁড়িতে ডিম পাড়তে আসা বিশালাকার লেদারব্যাক সি টার্টল হারাবে প্রজননক্ষেত্র। নষ্ট হবে ২০০০ প্রবাল প্রাচীর, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী, মাছ। পৃথিবীব্যাপী পরিযায়ী পাখিদের উড়ানপথগুলি ধ্বংস হবে। মানুষের বর্জ্য পদার্থে দূষিত হবে সমুদ্র।
যদিও সরকারি তরফে এই আদিম বনভূমি ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ হিসাবে হরিয়ানায় গাছ লাগানো এবং বিরল পাখির বাসস্থান রয়েছে, এমন গাছকে বাদ দিয়ে অরণ্য নিধনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে তাতে আশার আলো দেখছেন না দেশের পরিবেশবিদ, প্রাণিবিদেরা। অধ্যাপক নারায়ণের কথায়, ‘‘এই প্রকল্প আদৌ কতটা যুক্তিসম্মত, তা নিয়ে সন্দেহ থাকছে। সংসদে প্রশ্নোত্তর হলেও কেউ যথাযথ উত্তর দিতে পারেননি। গ্রিন ট্রাইবুনাল যে ভাবে একে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে, তা অনিয়মেরই নামান্তর। ব্রাজ়িলের আমাজ়ন অরণ্য নিধনের প্রভাব যে ভাবে সারা দুনিয়া টের পাচ্ছে, নিকোবরে অরণ্য নিধনের ফলও অচিরে ভোগ করতে হবে ।’’
আন্দামান-নিকোবরের মতো ভূকম্পপ্রবণ এলাকায় এই বিপুল নির্মাণের ফল কী হতে পারে, তা নিয়ে শঙ্কিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধিকর্তা সুগত হাজরা। চলতি বছরে দেশের নতুন ভূকম্পপ্রবণ মানচিত্রে দেখা গিয়েছে, হিমালয়ের মতো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জও। তাই সুগতের মতে, এমন এলাকায় নির্মাণকাজ করতে গেলে সম্ভাব্য ভূকম্পজনিত বিপর্যয়ের মূল্যায়ন করে এগোনো উচিত। তাই এই প্রকল্পের পুনর্মূল্যায়নের দাবি তুলছেন তিনি। বলছেন, ‘‘২০০৪ সালের ভূমিকম্প ও সুনামির ধাক্কা সয়ে নিয়েছে উপজাতিরা। সেই ভূমিকম্পে প্রায় সমুদ্রগর্ভে চলে গিয়েছে দেশের দক্ষিণতম বিন্দু ইন্দিরা পয়েন্ট। গত ১০ বছরে এখানে ৪৪৪ বার ভূমিকম্প হয়েছে। তাই আন্দামান ট্রেঞ্চের পাশেই এত বড় প্রকল্প দুঃসাহসিক হলেও দেশের পক্ষে হিতকর নয়। বরং বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাড়ছে।’’
তাই সুদূর নিকোবরে বেপরোয়া এই প্রকল্পের আসন্ন বিপদ নিয়ে জনগণকে সচেতন ও জনমত তৈরি করতে চান পরিবেশকর্মীরা। তাঁদের বার্তা, ‘‘মুনাফাবাজদের পথ করে দিতে উন্নয়ন প্রকল্পে হাত দেওয়া কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সরকারের উচিত নয়। জনগণই পারে, এই হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে বিরত করতে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)