প্রায় আট থেকে ১০ কোটি বছর আগের কথা। পৃথিবীর বুকে তখন মানুষ নয়, হেঁটে বেড়াত বিশালাকায় ডাইনোসরেরা। নানা জাতি, প্রজাতি নিয়ে ছিল তাদের বিরাট সংসার। কেউ মাংসাশী, কেউ বা বিশুদ্ধ নিরামিষাশী! লম্বায় ৪০-৪৫ ফুট ছাড়িয়ে গিয়েছিল এক একটি ডাইনোসর। ওজন কয়েক হাজার কিলোগ্রাম তো হবেই! কিন্তু সেই দৈত্যাকার পা নিয়েই মহানন্দে নেচে বেড়াত টাইর্যানোসরাস রেক্স (টি রেক্স)— পৃথিবীর ইতিহাসে হিংস্রতম ডাইনোসরদের মধ্যে অন্যতম। একা একা নয়। একসঙ্গে অনেকে মিলে এক জায়গায় জড়ো হয়ে তারা নাচের ‘আসর’ বসাত। কয়েক বছর আগে আমেরিকার এক প্রান্তে ডাইনোসরদের এ হেন ভাবগতিকের হদিস পেয়ে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। যত দিন যাচ্ছে, তাঁদের সন্দেহ এবং বিস্ময় আরও জোরালো হচ্ছে। প্রকাশ্যে আসছে সময়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্য। বিজ্ঞানীদের বক্তব্যের সপক্ষে মিলছে আরও প্রমাণ। তাঁরা জানতে পেরেছেন, ডাইনোসরদের এই নাচ আসলে তাদের যৌনজীবনের ইঙ্গিত। এ ভাবে পুরুষ ডাইনোসরেরা মেয়েদের মন জয় করত। নাচেই হত বাজিমাত!
ডাইনোসরদের পায়ের ছাপে যৌনজীবনের ইঙ্গিত! —ফাইল চিত্র।
ডাইনোসরদের ইতিহাসের অন্যতম ভিত লুকিয়ে আছে প্রাচীন কলোরাডোতে। বর্তমানে আমেরিকার অন্তর্গত এই প্রদেশকে ডাইনোসর-গবেষকদের স্বর্গরাজ্য বলা যায়। এখানেই আবিষ্কৃত হয়েছে টাইর্যানোসরাস রেক্সদের একগুচ্ছ পায়ের ছাপ। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, কোটি কোটি বছর আগে কলোরাডোর ডেনভার শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার পশ্চিমে গড়ে উঠেছিল টাইর্যানোসরাসদের মিলনক্ষেত্র। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পুরুষরা সেই বিরাট প্রান্তরে জড়ো হয়ে নাচানাচি করত। তাদের নাচের ডাকে ধরা দিতে আসত মেয়েরা। অতিকায় আদিম প্রাণীর সেই আদিম মিলনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে গবেষণায়।
আরও পড়ুন:
কলোরাডোয় কয়েক বছর আগে যখন প্রথম একগুচ্ছ টাইর্যানোসরাস রেক্সের পায়ের ছাপ আবিষ্কৃত হয়েছিল, গবেষকেরা ভেবেছিলেন, কোনও একসময়ে এই প্রজাতির বিশেষ কোনও দল হয়তো নির্দিষ্ট এলাকাটিতে জড়ো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল যৌন মিলন। তার জন্য তারা নাচানাচিও করেছিল বিস্তর। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় ইঙ্গিত, এটি কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় ডাইনোসরদের বিচ্ছিন্ন কোনও আচরণ নয়। কেবল এক বার এই ঘটনা ঘটেনি। বরং বছরের পর বছর ধরে এটাই ছিল টাইর্যানোসরাস রেক্সের যৌনতার অভ্যাস। এ ভাবেই তারা স্ত্রী টাইর্যানোসরাসদের সঙ্গে মিলিত হত। অনেকে এর সঙ্গে ময়ূর বা এই ধরনের কোনও পাখির আচরণের মিল খুঁজে পেয়েছেন। বর্ষাকালে সঙ্গীদের আকৃষ্ট করতে ময়ূর যেমন পেখম মেলে ধরে, তেমনই ডাইনোসরের এই বিশেষ প্রজাতিও নাচানাচি করে মন ভোলানোর চেষ্টা করত।
কলোরাডোর ডাইনোসর রেজে এই বিশেষ অঞ্চলকে বিজ্ঞানীদের একাংশ ডাইনোসরদের ‘বাসা’ বলেও চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁদের মতে, মিলনের মরসুমে এখানে এসে থিতু হত ডাইনসোররেরা। পাখির মতোই ছিল তাদের স্বভাব। মাঝারি আকারের দুই পদ বিশিষ্ট ডাইনোসরের একাধিক জীবাশ্ম এখান থেকে পাওয়া গিয়েছে। প্রাচীন পাথরে মিলেছে ৩৫ থেকে ৫০টি পায়ের ছাপ। শুধু নাচানাচি করে সঙ্গীদের ডাকত টাইর্যানোসরাস রেক্সরা, অনেকে এই তত্ত্ব মানতে নারাজ। তাঁদের মতে, মিলনের সময়ে তারা মুখ দিয়ে নানারকম শব্দ করত। এ ক্ষেত্রেও পাখির সঙ্গে আচরণে মিল রয়েছে।
যে পায়ের ছাপগুলি গবেষকদের নজর কেড়েছে, তার মধ্যে কিছু ছিল বাটির মতো। তবে বেশিরভাগই ছিল লম্বা এবং পাতলা। একই জায়গায় বার বার কারও পা পড়লে যে ধরনের চিহ্ন তৈরি হয়, এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। বাঁ এবং ডান, উভয় পা-ই এখানে পড়েছিল। কিছু পায়ের ছাপ দেখে বোঝা যায়, বালির মধ্যে নখ দিয়ে আঁচড়ানোর সময়ে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরেছিল ডাইনোসরদের পা। একে পুনরাবৃত্তিমূলক নৃত্যের ইঙ্গিত বলে অনেকে মনে করেছেন। ডাইনোসর রিজের জীবাশ্মবিদ্যার পরিচালক অ্যামি অ্যাটওয়াটার বলেন, ‘‘এই আবিষ্কার প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরদের আচরণের এক দুরন্ত ঝলক। ক্রিটেসিয়াস ডাইনোসরদের এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে স্পষ্ট ঘটনা, এবং সেটা আমরা নিজেদের চোখে দেখতে পাচ্ছি!’’
শুধু টাইর্যানোসরাস রেক্স নয়, বিজ্ঞানীরা কেউ কেউ মনে করেন, অরনিথোমিমিড প্রজাতির ডাইনোসরদের মধ্যেও মিলনের মরসুমে এই নাচের রীতি প্রচলিত ছিল। অরনিথোমিমিড আদৌ মাংসাশী নয়। তারা উটপাখির মতো তৃণভোজী। কলোরাডোয় এই ধরনের প্রাচীন জীবাশ্ম সংরক্ষণের বিশেষ বন্দোবস্ত রয়েছে। জীবাশ্মের উপর দিয়ে কেউ যাতে হেঁটে না যান, গবেষণার যাতে কোনও ক্ষতি না-হয়, তার জন্য আলাদা আইনও রয়েছে সে দেশে।