Advertisement
E-Paper

আলো ফেলেই ধরা যাচ্ছে ভেতরের ছবি! এক্স রে, সোনোগ্রাফির দিন ফুরলো?

আলো যে শুধুই অত জোরে ছোটে, তা-ই নয়, কোষ, কলা ফুঁড়ে-ঢুঁড়ে তা অনায়াসে ঢুকেও পড়তে পারে আমাদের শরীরে। এমনটাই জানাচ্ছে সাম্প্রতিক একটি গবেষণার ফলাফল। তা হলে কি এক্স-রে, আলট্রা সোনোগ্রাফিকে পুরোপুরি ‘গুড বাই’ জানানোর দিন এসে গেল?

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ ১৮:৪১
দৃশ্যমান আলো দিয়ে তোলা কোষের ছবি।

দৃশ্যমান আলো দিয়ে তোলা কোষের ছবি।

‘সর্বনাশী আলো, কেন তুই সর্বগ্রাসী হলি?’

কবি আল মাহমুদের এই আক্ষেপ-যন্ত্রণা কি বাড়ত আরও, যদি জানতেন, আলোও পারে ‘মর্মভেদী’ হতে!

আলোর এই ‘মর্ম কথা’ আমাদের জানা ছিল না বছর দশেক আগেও। জানলে কি আর এত খাতির-আদর জুটত রঞ্জন রশ্মির (এক্স-রে) কপালে? আলট্রা সোনোগ্রাফির জন্য পড়ে যেত এত হুড়োহুড়ি?

আলো যে শুধুই অত জোরে ছোটে, তা-ই নয়, কোষ, কলা ফুঁড়ে-ঢুঁড়ে তা অনায়াসে ঢুকেও পড়তে পারে আমাদের শরীরে। এমনটাই জানাচ্ছে সাম্প্রতিক একটি গবেষণার ফলাফল।

তা হলে কি এক্স-রে, আলট্রা সোনোগ্রাফিকে পুরোপুরি ‘গুড বাই’ জানানোর দিন এসে গেল?

‘নেচার’ জার্নালে যাঁর গবেষণাপত্রটি বেরনোর পর রীতিমতো হই চই শুরু হয়ে গিয়েছে বিশ্ব জুড়ে, মার্কিন মুলুকের মিসৌরির সেন্ট লুই শহরে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির সেই বায়ো-মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার লি হাং ওয়াং তাঁর নিবন্ধের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘‘আমরা সব সময় যে আলো খালি চোখে দেখি (Optical Light), তাকে আমাদের শরীরের দশ সেন্টিমিটার ভেতরে ঢোকানোটা দশ বছর আগেও ছিল রীতিমতো দুরূহ ব্যাপার। আর সেই শরীরে ঢোকা আলো দিয়ে ভেতরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কোষ ও কলার ঝকঝকে ছবি (High Resolution Imaging) তোলাটা ছিল একেবারেই কাল্পনিক। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, দৃশ্যমান আলো দিয়েই এ বার আমরা শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ঝকঝকে ছবি তুলতে পারব। এক্স-রে, আলট্রা সোনোগ্রাফির আর দরকার হবে না।’’

দৃশ্যমান আলোয় ধরা পড়া কোষের ছবি।

‘মর্মভেদী’ আলোর কথা প্রথম জানা গিয়েছিল ২০০৭ সালে। নেদারল্যান্ডসের এনশেদে তোয়েন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ অ্যালার্ড মস্কি প্রথম দেখেছিলেন, সাদা রং করা পুরু কাচের স্লাইড ফুঁড়ে স্লাইডের অন্য প্রান্তে অনায়াসেই চলে যেতে পারছে আমাদের চোখে দেখা আলো। ওই স্লাইডে কোনও ফুটো না থাকা সত্ত্বেও। ওই বছরেই ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার শাং হুই ইয়াং মুরগির বুক ফুঁড়ে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন আমাদের চোখে দেখা আলো। আর এখন তো ইঁদুরের কানের কোষ, কলা ফুঁড়েও ঢুকে পড়তে পারছে দৃশ্যমান আলো। তুলছে পারছে ঝকঝকে ছবি। বিজ্ঞানীদের আশা, দৃশ্যমান আলো এ বার আমাদের শরীরের অন্তরে-অন্দরে আরও বেশি করে ঢুকে পড়তে পারবে, খুব শীঘ্রই।

এক্স-রে, আলট্রা সোনোগ্রাফির দিন কি তবে ফুরলো?

সে দিন আর বেশি দূরে নেই। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির বায়ো-মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার লি হাং ওয়াঙের সহযোগী বাঙালী গবেষক তীর্থঙ্কর বসু চৌধুরী ই মেলে আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, ‘‘আমাদের এই আটপৌরে আলো দিয়েই এ বার মস্তিষ্কে ধমনীর অবাঞ্ছিত ফুলে-ফেঁপে ওঠার মতো জটিল অসুখ (Aneurosym) সারিয়ে ফেলা যাবে। আর অস্ত্রোপচার করতে হবে না। কোষ, কলায় ঢুকে শরীরে জন্মানো টিউমারও চুপসে দিতে পারবে আটপৌরে আলোই।’’

আটপৌরে আলো কি তবে বেশি শক্তিশালী এক্স-রে আর আলট্রা সাউন্ডের চেয়ে?

দৃশ্যমান আলোয় ধরা পড়া কোষের ছবি।

তীর্থঙ্কর জানাচ্ছেন, ‘‘অবশ্যই বেশি শক্তিশালী। দৃশ্যমান আলো দিয়ে তোলা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কোষ ও কলার ছবি এক্স-রে ও আলট্রা সাউন্ডের চেয়ে অনেক বেশি ঝকঝকে হবে। কারণ, দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে থাকা ফোটন কণাগুলি শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও কোষ-কলায় থাকা জৈব অণুগুলির (Organic Molecules) সঙ্গে খুব ভাল ভাবে বিক্রিয়া করতে পারে। তার ফলে, ওই জৈব অণুগুলো থেকে প্রতিফলিত দৃশ্যমান আলো শুধুই যে আরও বেশি ঝকঝকে ছবি তুলতে পারবে, তা-ই নয়, কোষ ও কলার অন্তরে-অন্দরে জৈব অণুগুলোর রাসায়নিক পরিবর্তন, কোষ-কলার গঠন ও রূপান্তর, রক্তে গ্লুকোজ ও অক্সিজেনের মাত্রা সম্পর্কেও অনেক বেশি নির্ভুল ভাবে তথ্য তুলে আনতে পারবে।

দেখুন গ্যালারি- আমাদের চেনা আলোয় ধরা পড়া ভেতরের কোষ, কলার ছবি

ফলে, দৃশ্যমান আলো দিয়ে তোলা ছবিগুলো থেকে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কোষ-কলার গঠন, রূপান্তর ও বিবর্তন সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য জানা যাবে। যা এক্স-রে বা আলট্রা সোনোগ্রাফি দিয়ে করা সম্ভব নয়। দৃশ্যমান আলো সে ক্ষেত্রে যেন এক জন দক্ষ রিপোর্টারই!’’

আবার দক্ষ রিপোর্টারের যেমন কিছু কিছু ‘বিহেভিয়েরিরাল প্রবলেমস’ বা ‘আচরণগত সমস্যা’ থাকে, ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে, তেমনই আটপৌরে আলো দিয়ে শরীরের কোষ, কলা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নিখুঁত, ঝকঝকে ছবি তোলার ক্ষেত্রেও রয়েছে কয়েকটি অসুবিধা।

দৃশ্যমান আলো দিয়ে শরীরের কোষ, কলার ছবি তোলার অসুবিধাগুলি কী কী?

তীর্থঙ্কর জানাচ্ছেন, ‘‘কোষ-কলা ফুঁড়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ার পর শরীরের অন্দরে জৈব অণুগুলোর সঙ্গে আটপৌরে আলো বিক্রিয়া করে বলে, সেই সব কোষ ও কলা থেকে ফিরে আসা আলো (প্রতিফলিত) একমুখী না হয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানা দিকে। একে বলে, বিচ্ছুরণ বা, ‘Scattering’। ফলে, তার ঔজ্জ্বল্য (Brightness) অনেকটাই কমে যায়। তাতে ছবির মান খারাপ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এক্স-রে, আলট্রা সোনোগ্রাফির ক্ষেত্রে সেটা হয় না। কারণ, ওই দু’টি তরঙ্গই শরীরের অন্দরে জৈব অণুগুলোর সঙ্গে কোনও বিক্রিয়া করতে পারে না। আবার কখনও কোনও কোনও জৈব অণু পুরোপুরি শুষেও নিতে পারে দৃশ্যমান আলোকে। একে বলে, ‘Absorption’। সে ক্ষেত্রে শরীরের ভেতরে ঢুকে আলোক কণা ফোটন যে সব তথ্য জোগাড় করেছে, তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এক্স-রে, আলট্রা সাউন্ডের ক্ষেত্রে ওই সব সমস্যা নেই।’’

ওই সমস্যাগুলি থেকে কি বেরিয়ে আসার কোনও সম্ভাবনাই নেই?

তীর্থঙ্কর বলছেন, ‘‘আছে বলেই তো বলা হচ্ছে, ‘গুড বাই’ জানানোর দিন এসে গেল এক্স-রে আর আলট্রা সাউন্ডকে। বিচ্ছুরণের সমস্যা মেটানো যেতে পারে। তবে তার জন্য জানতে হবে বিচ্ছুরণের ফলে কী হয় ও কেন হয়। বিচ্ছুরণের ফলে হারিয়ে যাওয়া ফোটন কণাগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনা যায়। যেমন, হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমার শো ফের চালু হয়ে গেলে হল থেকে বেরিয়ে পড়া দর্শকরা আবার বিভিন্ন দিক থেকে এসে হলে ঢুকে পড়েন। এটাকে বলে, ‘Adaptive Optics’।’’

সর্বনাশী আলো বোধহয় সত্যি-সত্যিই এ বার সর্বগ্রাসী হল!!!

visible light optics wave particle
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy