হোর্ডিংটা এ বার অনেকেরই চোখে পড়েছে, মনে ধরেছে।
পুজোর কলকাতার রাজপথ ছেয়ে গিয়েছিল এক ধরনের হোর্ডিংয়ে। দুর্গার নামে শপথ করে সেগুলিতে বলা ছিল কী করব, কী করব না। তার মধ্যেই নজর কেড়েছে একটি— ‘মা দুগ্গার দিব্যি, শব্দবাজি পোড়াব না।’ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ নয়, এই হোর্ডিং দিয়েছিল একটি বাণিজ্যিক সংস্থা। আর তাতেই রাজ্যের পরিবেশপ্রেমী ও পরিবেশকর্মীদের একাংশের প্রশ্ন, সচেতনতার প্রচার ও প্রসারে পর্ষদের উদ্যোগ কোথায়।
বস্তুত, চকোলেট বোমা, দোদোমা, ‘শেল’-এর পিলে-চমকানো, কানফাটানো শব্দ ঠেকাতে মূলত মানুষের সচেতনতাই তাঁদের ভরসা বলে জানাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কর্তৃপক্ষ। খোদ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র রবিবার বলেন, ‘‘আমি আশা করছি, শব্দবাজির দৌরাত্ম্য অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব হবে। সাধারণ মানুষই সচেতন হয়ে শব্দবাজি ব্যবহার করবেন না।’’ আর সেখানেই পরিবেশপ্রেমী ও পরিবেশকর্মীদের একাংশের বক্তব্য, একটি বাণিজ্যিক সংস্থাও যা পারে, আইনি ও আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষমতাবান পর্ষদ তা পারে না।
পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক ও বর্তমানে পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা লজ্জার যে, শব্দবাজি ব্যবহারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে একটি বাণিজ্যিক সংস্থা এগিয়ে আসতে পারে, কিন্তু পর্ষদ ঘুমিয়ে থাকে। অথচ এই দায়িত্বটা পর্ষদের উপরে আইনি ভাবেই ন্যস্ত। তা ছাড়া, দুর্গাপুজোয় বিপুল মানুষের সমাগম হয়। তখন এ রকম প্রচার করলে সুফল পাওয়া যেত।’’
কিন্তু শব্দবাজি রুখতে পুলিশকে নিয়ে অভিযানের বদলে এ বার পর্ষদকে শুধু মানুষের সচেতনতার উপরে নির্ভর করতে হচ্ছে কেন? পরিবেশ ভবন সূত্রে খবর, রাজ্যে শব্দবাজি (যে সব বাজির শব্দমাত্রা ৯০ ডেসিবেলের বেশি) অনুমোদিত নাকি নিষিদ্ধ, সেই বিষয়টি এখনও বিচারাধীন বলে দাবি করে পর্ষদ এ নিয়ে কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করেনি। শব্দবাজির বিরুদ্ধে অভিযানেও নামেনি তারা। পুলিশও বুঝতে পারছে না, কী করা উচিত। এ দিকে, সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির দাবি অনুযায়ী, দেড়শো টনেরও বেশি শব্দবাজি তৈরি হয়ে পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছেছে। প্রায় ৮০ জন খুচরো বিক্রেতা বাজি কিনেছেন। এমনকী, রবিবার দক্ষিণ কলকাতায় বিসর্জনের মিছিলে পুলিশের সামনেই যথেচ্ছ ফেটেছে শব্দবাজি, বেজেছে ডিজেও।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-এর পক্ষে নব দত্ত বলেন, ‘‘এমন নয় যে, পর্ষদের টাকার অভাব। তার পরেও শব্দবাজির বিরুদ্ধে প্রচার করতে পর্ষদের সমস্যা হল কেন, বুঝতে পারছি না।’’
পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণবাবু অবশ্য জানাচ্ছেন, শব্দদূষণ ও গঙ্গা দূষণের বিরুদ্ধে প্রচারমূলক একশোর বেশি ফ্লেক্স তাঁরা বিভিন্ন মণ্ডপে দিয়েছেন। তাঁর কথা থেকেই পরিষ্কার, বড় রাস্তায় হোর্ডিং দিলে জনমানসে যতটা প্রভাব বিস্তার করে, সে রকম প্রচার পর্ষদ এ বার করেনি। নির্দিষ্ট ভাবে শব্দবাজির বিরুদ্ধেও পর্ষদের প্রচার ছিল না। পর্ষদ সূত্রে খবর, হোর্ডিং দিয়ে শব্দদূষণের বিরুদ্ধে প্রচারের পরিকল্পনা হলেও শেষমেশ নানা টালবাহানায় তা কার্যকর করা যায়নি।
পরিবেশকর্মীদের একাংশ বলছেন, জাতীয় পরিবেশ আদালতের একটি সাম্প্রতিক নির্দেশ পর্ষদকে শব্দবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ করে দিলেও পর্ষদ টালবাহানা করছে। ১৬ অক্টোবর জাতীয় পরিবেশ আদালত বেআইনি বাজি প্রস্তুতকারকদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে পর্ষদকে। কিন্তু সে ব্যাপারে পর্ষদের এখনও হেলদোল নেই বলে তাঁদের অভিযোগ।
বিশ্বজিৎবাবুর বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী বাজির প্যাকেটে উৎপাদকের নাম-ঠিকানা লেখা বাধ্যতামূলক। তা না থাকলে ওই বাজি বাজেয়াপ্ত করা যাবে। তালিকা মিলিয়ে যদি দেখা যায় তারা বেআইনি উৎপাদক, তা হলে সেই বাজিও বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এই সুযোগেই বিপুল শব্দবাজি আটক করা যাবে বলে তাঁর অভিমত।
সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায়ও জানাচ্ছেন, উৎপাদিত ৩৫০ টন বাজির প্রায় অর্ধেকই শব্দবাজি। আর তাঁর হিসেবেই রাজ্যের ছোট-বড় ছ’লক্ষ বাজির কারখানার মধ্যে কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন সংস্থার সব রকম প্রয়োজনীয় অনুমতি আছে মাত্র সাত-আটটির। তবে দেড় লক্ষেরও বেশি বাজি প্রস্তুতকারক বিভিন্ন জেলাশাসকের কাছ থেকে অনুমতি পেয়েছিলেন। এ বছর পর্ষদ কোনও বিজ্ঞপ্তি না দেওয়ায় সেই অনুমতি পুনর্নবীকরণ হয়নি।
পরিবেশকর্মী নববাবুর মতে, পর্ষদ সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন ও বড় বড় হোর্ডিং দিয়ে অবিলম্বে শব্দবাজির বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করুক। সেই সঙ্গে যে বাজি কেনা হচ্ছে, তার উৎপাদকদের আইনি বৈধতা আছে কি না, সেটা দেখে নিতে হবে বলে জানিয়ে দিক। কোন কোন উৎপাদকের সব রকম অনুমতি আছে, তার তালিকাও পর্ষদ প্রকাশ করুক বলে দাবি করেছেন তিনি।
এটা করতে পারবেন কি না, পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র এখনই নিশ্চিত নন। তবে তিনি বলেন, ‘‘পরিবেশ আদালতের নির্দেশ এলেই তার কপি কলকাতা ও প্রতিটি জেলার পুলিশকে পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হবে। বুঝিয়েও দেওয়া হবে, কী ধরনের বাজি আটক করতে হবে।’’