Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

রাষ্ট্রকে বেড রুমে ঢোকাতে চাইছেন কেন

বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে কোনও আইন করার কথা ভাবছেই না কেন্দ্রীয় সরকার। জানিয়ে দিয়েছেন মানেকা গাঁধী। নতুন করে শুরু হয়েছে বিতর্ক। এই বিতর্কের প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠল আনন্দবাজার ডট কম। এমন আইনের বিরোধিতা করে লিখলেন কমলেশ্বর বসু।‘ফাঁকা ক্লাসে জোর করেছি ঘাট হয়েছে, চলল এখন ফ্যাচফ্যাচানি রুমাল বেছে’। সেই দিন বেশি দূরে নেই, যখন এই লাইনগুলোর, ক্লিশেত্বর থেকেও, পলিটিকাল ইনকারেক্ট টোনে শিউড়ে উঠব। সে দিন, প্রতিটা চুমুর ফাঁকে, প্রতিটা আঁচড়ের তীব্রতায়, অলিঙ্গনের স্পর্শে, যৌন-রসায়নের পরতে পরতে আমরা সম্মতির গ্রিন সিগনাল খুঁজে বেড়াব। লিখলেন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী কমলেশ্বর বসু।

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৬ ১৩:৩১
Share: Save:

‘ফাঁকা ক্লাসে জোর করেছি ঘাট হয়েছে, চলল এখন ফ্যাচফ্যাচানি রুমাল বেছে’। সেই দিন বেশি দূরে নেই, যখন এই লাইনগুলোর, ক্লিশেত্বর থেকেও, পলিটিকাল ইনকারেক্ট টোনে শিউড়ে উঠব। সে দিন, প্রতিটা চুমুর ফাঁকে, প্রতিটা আঁচড়ের তীব্রতায়, অলিঙ্গনের স্পর্শে, যৌন-রসায়নের পরতে পরতে আমরা সম্মতির গ্রিন সিগনাল খুঁজে বেড়াব। সেই মহান ডিস্টোপিয়ার শুভলগ্নে আমরা এই 'জোর করা' র নাম দেব 'যৌন হয়রানি' আর ফ্যচফ্যাচানি-কে 'মরাল আউটরেজ'। বা ওই রকম গালভরা কিছু।

দুর্ভাগ্যবশত আলোচ্য আইনটি এই ডিস্টোপিয়ার দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মজার ব্যাপার হল, আইনের যেটা মূল ভিত্তি, সেই কনসেন্টের কনসেপ্টটাই যে মারাত্মক ধোঁয়াটে! বহিরাগত দ্বারা ধর্ষণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে। কিন্তু চার দেয়ালের মধ্যে 'সম্মতি'? কে প্রথম কাছে এসেছিলো, কে প্রথম কনসেন্ট দিয়েছিলো? বউ সেক্সের আগে মাথা ধরছে বলে অ্যাসপিরিন চেয়েছিল, এইটা কি প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হবে ? না নেশাসক্ত হয়ে ‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে’ স্বামীকে সম্মতি দিয়ে ফেলেছিল, এইটা ধর্ষণ? না অনিচ্ছুক বউকে স্বামী বেধড়ক পিটিয়ে সেক্স করতে বাধ্য করাটা? হ্যাঁ, এই শেষ ক্ষেত্রে হাতে পায়ে জখমের চিহ্ন দেখিয়ে এগোনো যেতে পারে । কিন্তু এই কেস তো এমনিতেই শারীরীক অত্যাচার-এর আওতায় পড়ত। তাহলে আর আলাদা করে ম্যারিটাল রেপ আইনের প্রয়োজন কী? শুধুই 'সম্মতির' মত এক বিমূর্ত, অলীক ধারণাকে ধরতে চাওয়া? বলাই বাহুল্য, ঠিক এই কারণে, আজকের দিনেও, প্রগতিশীলতার মোড়ক থাকা সত্ত্বেও, বিশ্ব জুড়ে এই আইনের কোন সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নেই। এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশেও ১৩টি রাজ্যে এখনও এটি আধা-আইনি। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক বাড়তি জটিলতা, আর অবশ্যই যথেচ্ছ অপব্যবহারের আশঙ্কা। ৪৯৮এ-র (আইপিসি ধারাগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম কনভিকশন-রেট) সাম্প্রতিক ইতিহাস, এই প্রসঙ্গে একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।

আসলে সামাজিক ন্যায়ের একটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারণা আমাদের মাথার ওপর সেই রেনেসাঁ আমল থেকে ভূতের মত চেপে অছে। সেই ধারণা সমস্ত দেশি ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে প্রগতির পরিপন্থী দাগিয়ে দেয়। অথচ যা আমরা প্রায় ভুলে যাই, পুরুষতন্ত্র হোক বা ধর্মীয় উগ্রতা, বহু সমধান সূত্র লুকিয়ে আছে এই দেশের মাটিতেই। আমরা ভুলে যাই, এখানে আইনি কাঠামোর পাশপাশি সামাজিক আর পারিবারিক বন্ধনের এক সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ আমাদের জীবনের উপর ছায়া বিস্তার করে। আইনি জটিলতা আমাদের দেশে সম্পর্ককে শুধু ধ্বংসই করতে পারে। অন্য দিকে, বন্ধুবান্ধব আত্মীয় পরিজনদের সামাজিক সাপোর্ট সিস্টেম এক ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্ক বাঁচিয়ে তুলতে পারে। বৈবাহিক ধর্ষণের মত এক পারিবারিক সমস্যার ক্ষেত্রেও এই সামাজিক সমাধানটা আমাদের মাথায় রাখা উচিত।

মুশকিলটা হল, সামাজিক মনস্তত্ব থেকে বিবর্তনবাদ, কোন বৈজ্ঞানিক কাঠামো-ই যৌনতার ডায়নামিক্সকে (সে বৈবাহিক হোক, বা বিবাহ-বহির্ভূত) আজও ঠিক মত ধরতে পারে নি। আর এই বোঝার ফাঁকটাই লিবারাল মননে জন্ম দেয় ভয়নক সব দোলাচল আর স্ববিরোধিতার।

এক দিকে প্রাইভেসির সমর্থনে রাষ্ট্রকে বলি দূর হঠো, আবার অন্য দিকে তাকেই আমন্ত্রণ জানায় বেড রুমে, আইনের মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ব্যক্তি-যৌনতার সুক্ষ্ম ওঠা-পড়া মাপার জন্য। এক দিকে বন্ডেজ সেক্সকে গ্রহণ করি, অন্যদিকে বৈবহিক যৌনতাকে আইনের সাদা-কালোর বাইনারিতে বাঁধি। হেন উদারমনা কী ভাবে দেখবেন গন উইথ দ্য উইন্ডের সেই স্কারলেটকে জোর করে সিঁড়ি বেয়ে নিয়ে আসার দৃশ্য। যেখনে স্কারলেটের চোখে, পুরুষ রেট মৃত্যুর মত অন্ধকার আর ভয়াল। স্কারলেট ভয় পাচ্ছে, ব্যথায় গোঁঙাচ্ছে, লাথি মারছে, চিৎকার করছে। আবার পরমুহূর্তেই সেই ভয়ের অন্ধকার ভেঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে অনেকগুলো পরস্পর-বিরোধী অনুভূতির রামধনু। সেখানে ভয়ের পাশাপাশি ফুটে উথছে যৌন উত্তেজনা, আত্ম-সমর্পনের আনন্দ যৌনক্রিয়ায় এই অবধারিত টানাপোড়েন নিয়ে সুজাতা গঙ্গোপাধ্যায়ের এই লাইনগুলি

লড়াই চলে শুম্ভ-নিশুম্ভের,

প্রথম বলে ফুলটি ছিঁড়ে খাব

দ্বিতীয় বলে হাত পাততে শেখ্‌!

পলিটিকাল কারেক্টনেসের তোড়ে, এই দ্বৈতসত্তার একটা অংশকে আমরা সম্পূর্ণ ছেঁটে ফেলছি না তো?

আরও পড়ুন, মন্ত্রী যাই বলুন, সম্মতিহীন যে কোনও যৌন সম্পর্কই আসলে ধর্ষণ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Marital rape sex
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE