Advertisement
E-Paper

প্রান্তিক মেয়ে নন, ওঁরা আত্মবিশ্বাসের ‘মডেল’

বিয়ে সে কিছুতেই করবে না বলে বেঁকে বসেছিল চন্দনা। হতাশ-বিরক্ত শিবু সোরেন কপাল চাপড়ে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘কোন রাজকার্যটা করবি শুনি?

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৮

বিয়ে সে কিছুতেই করবে না বলে বেঁকে বসেছিল চন্দনা। হতাশ-বিরক্ত শিবু সোরেন কপাল চাপড়ে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘কোন রাজকার্যটা করবি শুনি? নাইন পাশ দিলে যা, উচ্চ মাধ্যমিক দিলেও তো তাই! গরিব চাষির মেয়ের ভাগ্যে বিয়ের পিঁড়ি আর বাচ্চা কোলে হাঁড়ি ঠেলাই লেখা আছে।’’

বীরভূমের প্রত্যন্ত উত্তরে শিয়ালকুঠিপাড়া গ্রামের চন্দনা সোরেনের কাছে সেই মূহূর্তে কোনও উত্তর ছিল না। কারণ ঠিক কোন কাজটা সে করতে পারে সেটা তখনও হাতড়ে বেড়াচ্ছিল। ক্লাস টেনেই তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

তিন বছর পরে কাজের দিশাটা পেয়েছে বছর উনিশের চন্দনা। বুঝেছে কোন পথে আসতে পারে কাঙ্খিত স্বাধীনতা, আর্থিক সক্ষমতা।

শান্তিনিকেতন থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে দেবানন্দপুর এলাকা। সেখানকার প্রায় ৮-১০টি গ্রাম থেকে চন্দনার মতো মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কেতাদুরস্ত ব্র্যান্ডেড পোশাকের কারিগর হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। শুধু কারিগর বললে ভুল হবে, তাঁদের তৈরি করা হচ্ছে ছোটখাটো ‘উদ্যোগপতি’ হিসেবেও। তাঁরা নিজেদের তৈরি জিনিসের প্রচার ও বিক্রির যাবতীয় আধুনিক পন্থা শিখছেন।

চন্দনারা এখন শুধু আড়ালে থেকে যাওয়া শিল্পী নন, তাঁরা নিজেদের হাতে তৈরি পোশাকের মডেল! ক্যামেরার সামনে স্বচ্ছন্দে ‘পোজ’ দিচ্ছেন প্রত্যন্ত গ্রামের তফসিলি জাতি-উপজাতির এই তরুণীরা। নামী দোকানের দেওয়ালে, পোশাকের ক্যাটালগে এই গাঢ়-শ্যামলা ‘আর্টিজেন-মডেল’রা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছেন।

ছবিতে ডিজাইনার পোশাকে সাবলীল চন্দনাকে দেখে বিস্মিত চোখে শিবু প্রশ্ন করেছিলেন— ‘‘এটা তুই! এই পোশাকটাও তোর তৈরি? কী করে এমন করলি রে মা?’’

সম্প্রতি হস্তশিল্প ও পোশাক বিপণনকারী কয়েকটি নামী সংস্থা তাদের বিজ্ঞাপনে শিল্পীদের ছবি দিতে শুরু করেছে। এটা পারিশ্রমিকের মতোই শিল্পীদের এক ধরনের স্বীকৃতি। দেবানন্দপুর শিল্প ক্লাস্টারে কাজ করা একটি সংস্থা এর থেকেও কয়েক ধাপ এগিয়ে তথাকথিত ‘গ্রাম্য’ তরুণী শিল্পীদের মডেল হিসেবে তুলে ধরেছে। সংস্থার দুই কর্ণধার সোনালি চক্রবর্তী ও গোপাল পোদ্দারের কথায়, ‘‘মেয়েদের ভিতরের সৃজনীশক্তি, কর্মদক্ষতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ওঁদের ‘আমি’টাকে টেনে বার করতে চেয়েছি। পোশাক তৈরি করে রোজগার করতে পারা ওঁদের একটা উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। এ বার সেই পোশাক পরে দুনিয়ার সামনে মডেল হয়ে আসাটা ওঁদের মারাত্মক আত্মবিশ্বাস দিয়েছে।’’

সাধারণ পোশাকে ওয়ার্কশপে (বাঁ দিক থেকে) শ্রাবণী, জ্যোৎস্না, চন্দনা। (নীচে) মডেলের সাজে। — নিজস্ব চিত্র

দেবানন্দপুরের ওয়ার্কশপে সেলাই মেশিনটা ঘুরিয়ে ঝড়ের গতিতে সেলাই করছিলেন শ্রাবণী, জ্যোৎস্না, রতি, জবা-রা। প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে দর্পশিলা গ্রামে বাড়ি ওঁদের। প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে কাজে আসেন সকাল ৭টার মধ্যে। জ্যোৎস্না বাদ দিয়ে বাকিদের পড়াশোনা কারও ক্লাস এইট, কারও ক্লাস টেন পর্যন্ত। জ্যোৎস্না পুণ্যিদেবী কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। প্রত্যেকেই তাঁদের তৈরি পোশাকের শীতের কালেকশন ‘কোহরা’-র মডেল। টানা চোখ আর এক ঢাল চুলের লম্বা ছিপছিপে শ্রাবণীর মুখে দৃঢ়তা— ‘‘আমরা যে এত কিছু করতে পারি, আমাদেরও যে এই পোশাক পরে ভাল লাগতে পারে সেটাই জানা ছিল না। আগে গরিব, কালো, বেশি পড়াশোনা নেই, গেয়োঁ বলে হীনম্মন্যতায় ডুবে থাকতাম। এখন সাহস করে চোখ তুলে তাকাতে পারি।’’

‘কোহরা’ মানে তো কুয়াশা। কুয়াশার একটা রহস্যময় সৌন্দর্য রয়েছে, বলছিলেন সোনালি। তাই ‘কোহরা কালেকশন’ দিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছে এই ‘মডেল’দের। সব শুনে উচ্ছ্বসিত নারী অধিকারের আন্দোলনের অন্যতম কর্মী শাশ্বতী ঘোষ। বললেন, ‘‘অসাধারণ ভাবনা। যাঁরা শ্রমিক তাঁরা শুধু উচ্চবিত্তদের ব্যবহারের জন্য পোশাক বানাচ্ছেন না। তাঁদের মডেল করা মানে এটা বোঝানো যে, যাঁরা বানাচ্ছেন তাঁরাই সেই পোশাক পরছেন। শ্রেণিগত দেয়াল ভেঙে যাচ্ছে।’’ ফ্যাশন ডিজাইনার কিরণ উত্তম ঘোষও এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বলছেন, ‘‘এই মেয়েরা একদিকে যেমন প্রশিক্ষণ পেয়ে কাজে দক্ষ হচ্ছেন অন্য দিকে নিজেদের পোশাকের মডেল হয়ে ক্ষমতায়নের পথে হাঁটতে শিখছেন। আর এতে মডেলদের আলাদা পারিশ্রমিক দেওয়ার খরচাও বাঁচবে। সেই লভ্যাংশ কারিগরেরাই পেতে পারবেন।’’

এক পা সেলাই মেশিনে, আরেক পা মডেলিংয়ের জগতে রেখে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতে শিখছেন চন্দনারা।

Model Girl Rural
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy