পাওলি দাম। ফাইল চিত্র।
এক বসন্ত দিনে মিঠে রোদ পেরিয়ে ছায়ার বাড়ি পৌঁছে যাকে দেখলাম, তাকে দেখে মনে এল, ‘‘ঠোঁটের কাছে উচ্চারিত শব্দ থেমে যায়, আমি নখাগ্রে দেখাবো প্রেম, ভালোবাসা, বক্ষ চিরে তোমার প্রতিমা। দেয়ালে টাঙ্গানো কোন প্রথাসিদ্ধ দেবীচিত্র নয়, রক্তের ফ্রেমে বাঁধা হৃদয়ের কাচে দেখবে নিজের মুখে ভালোবাসা ছায়া ফেলিয়াছে।’’
ছায়ার নাম পাওলি। কোনও এক কালবেলায় মাধবীলতা তাঁর শরীরে, গন্ধে মিশে সেলুলয়েডে এক মায়া সঞ্চার করেছিল।
যৌথ পরিবারের ছোট আহ্লাদিনী। মা, বাবা কোনও দিন বলেনি, মেয়ে হলে এটা করতে নেই। ইচ্ছেমতো রোদ হয়ে বৃষ্টি হয়ে জ্বলে ওঠার নাম ছিল ছোটবেলা। ‘‘খুব দুষ্টু ছিলাম আমি। কত বার মায়ের লিপস্টিক নষ্ট করেছি।’’ চোখের কোণে ছোটবেলা নিয়ে হাত-পা নেড়ে বলে উঠলেন পাওলি।
আরও পড়ুন: এখনও এ সমাজে মেয়েরা শুধুই ‘মেয়ে’!
আসলে দুষ্টুমি নয়। সৃষ্টির চঞ্চলতা তাঁকে ঘিরে ঘিরে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াত। ভেবেছিলেন তাঁর চেতনায় পান্না সবুজ, চুণি বর্ণময়। দু’হাত ভরে জীবনকে নিতে নিতে ভাবলেন পাইলট হবেন, ‘‘যে সে পাইলট নয়, কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার পাইলট।’’ হাসেন পাওলি। তাঁর হাসি তো আজও প্রান্তরে বিলীন।
আরও পড়ুন: নারীবাদীর প্রেম কেমন, দেখা বাকি
ভাললাগা, ভালবাসাই ছিল অন্য ধাঁচের। পুতুলখেলার চেয়ে মাঠ ছিল প্রিয়। বড় মাঠ, যেখানে নিজেকে মেলে দিয়ে খেলোয়াড় হবেন ভাবতেন।
ইচ্ছেরা ডানা যদিও মেলেনি। মেলে নাই তো! মধ্যবিত্তের জীবন। খেলায় অনেক ঝুঁকি। তার ওপর চাই অনেক অর্থ। কে দেবে?
‘‘বরং পড়াশোনা কর। ওটা করলেই সব হবে।’’ শুনেছিল পাওলি, যেমন আজও মধ্যবিত্তের অজস্র পাওলিরা এ ভাবেই শোনে!
কী বললেন পাওলি:
শুনতে শুনতে জীবন দেখল পাওলি। নাহ! যা ভাবা যায়। যা পেতে চাই, তা হয় না। থমকে থাকে মেয়ে! নিশ্চয়তার জীবন থেকে অনিশ্চয়তার যাত্রা। ভাবেননি অভিনয়ে আসবেন।
‘‘বাবা-মা বলতো আমায়। এমনকী ঠাকুমাও। ভাবতাম, ইস্স্ কখনও না। ওটা তো সবাই করে। যা সবাই করে আমি কেন তা করব? যোগ করলেন পাওলি। ইস্স্, হল ভাগ্যিস! টেলিভিশনে পরিচালক গৌতম ঘোষের ‘কালবেলা’ পাওলিকে স্বীকৃতি দিল। এই পাওয়ার মধ্যেই লড়াইয়ের বীজ লুকিয়ে ছিল। ‘‘আসলে সব আলোর পাশেই তো অন্ধকার দাঁড়িয়ে আছে! লোকে বলল, পাওলি খুব ভাল অভিনেত্রী তবে ‘আর্ট হাউস’ সিনেমাই ওর জায়গা,’’ বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হল তাঁর। কারা যেন পাওলির খোলা আকাশের জানলা-দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিল, ‘‘মূল ধারার ছবি করতে পারবে না...গায়ের রং কালো...,’’ আরও না জানি কত কি! মোদ্দা কথা, মেয়েটিকে আটকানো হোক। থামানো হোক!
থামানো যায় না!
কেউ কিছু বারণ করলে তাঁর জেদ বাড়তে থাকে। আর জেদের মধ্যেই তো জয়ের নির্যাস লুকিয়ে থাকে, যে দেখতে পায় সে-ই পারে আকাশ ছুঁতে।
পাওলির আকাশ কান ফেস্টিভ্যালে উড়েছিল। ‘ছত্রাক’-এর জন্য স্বপ্নের রেড কার্পেট ছুঁয়েছিলেন তিনি। তিনি জয়ী নন, পরাজিত নন, পাহাড়চূড়ায় পৃথিবীকে রেখে তাঁর মানবী যাত্রা শুরু হল।
‘‘প্রচুর কিছু শুনতে হয়েছে আমায় ‘ছত্রাক’ নিয়ে। কেন করলাম? আমি? সমস্ত পৃথিবী সে দিন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল আমার সামনে। আর যেন পথ নেই।’’ পাওলি স্থির। হাল ছাড়েননি তিনি। কাজের মধ্যে দিয়ে বার বার নিজেকে প্রমাণ করেছেন।
‘‘আসলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। মেয়েরা নতুন কিছু, অন্য কিছু পদক্ষেপ করলেই তাঁকে সমাজের কঠিন মুখ দেখতে হবে। হোক! সেখান থেকে জয় ছিনিয়ে নিতে হবে।’’ সকল মেয়ের জন্য কথা বলে উঠল তাঁর ঘাম ঝরা, পরিশ্রমের স্বর।
এই স্বর যেন কিছু বলে গেল আমাদের। মেয়েদের। অশ্রুমোচনের সময় আর নেই। যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, ইচ্ছেমনের ডানায় ভর করে কপালের ঘামে স্বপ্ন দেখার দিন নিয়ে আসি বরং।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy