আকর্ষণ: রাজকোটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেকের অপেক্ষায় ভারতের পৃথ্বী শ। ছবি: টুইটার।
পৃথ্বী শ যখন প্রথম রিজভি স্কুলে আমার কাছে আসে, ও ছিল ক্রিকেটের স্টাম্পের সাইজের। সত্যিই তখন ওকে দেখে মনে হত, এ ছেলে লাল বলে ক্রিকেট খেলবে কী? এর তো দুধ খাওয়ার বয়স যায়নি।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সেই ছেলেই যখন রাজকোট থেকে ফোন করে বলল, ‘‘স্যর কিছু ভাববেন না। আমি একদম তৈরি আছি,’’ সত্যিই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। কত ছোট অবস্থায় ওকে দেখেছি আর এখন টেস্ট অভিষেকের সেই প্রতিক্ষিত লগ্ন উপস্থিত। ফোনে কথা বলার সময় বরাবরের সেই আত্মবিশ্বাসী পৃথ্বীকেই পেলাম। বুধবার আর ফোন করিনি। মঙ্গলবার নিজেই ফোন করে কথা বলেছিল। তখন ওর গলা শুনে কেন জানি না মনে হচ্ছে, রাজকোটে ভাল কিছুই অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।
শুনেছি, পাকিস্তানে বিস্ময় বালক হিসেবে টেস্ট অভিষেকের সময় সচিন তেন্ডুলকরকে দেখে একই রকম কথা মনে হয়েছিল ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিসদের। এ ছেলে খেলবে কী, মুখ থেকে দুধের গন্ধই তো এখনও যায়নি! সেই সফরে নাকে আঘাত লাগার পরেও মাঠ ছেড়ে চলে না গিয়ে দুরন্ত লড়াই করে হাফ সেঞ্চুরি করে সচিন বুঝিয়ে দিয়েছিল, বিশ্ব শাসন করতে ও চলে এসেছে। সচিন তেন্ডুলকরের মতো কিংবদন্তির সঙ্গে কখনও কারও তুলনা করা উচিত নয়। কিন্তু মুম্বই ক্রিকেট সংসারে সচিনের পরে এত আগ্রহ আর কখনও কোনও ক্রিকেটারকে নিয়ে হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না। টেস্ট ক্রিকেটের আকালের দিনে রাজকোটে কত লোক মাঠে আসবে জানি না। কিন্তু মুম্বইয়ের ঘরে ঘরে অনেকের নজর থাকবে টিভি-র পরদায় দেখার জন্য যে, আজাদ ময়দানে ঝড় তুলে উদয় হওয়া মুম্বইয়ের নতুন বিস্ময় বালক অভিষেক টেস্টে কী করে। একটা কথা বলতে পারি। পৃথ্বী লড়াই ছাড়বে না।
পৃথ্বী-নামা
• ১৪ বছর: স্কুলের হয়ে এক ইনিংসে ৫৪৬ রান।
• ১৭ বছর: প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক।
• ১৭ বছর: রঞ্জি এবং দলীপ অভিষেকে সেঞ্চুরি।
• ১৮ বছর: অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে পৃথ্বীর নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন ভারত।
• ১৮ বছর: প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পাঁচটি সেঞ্চুরি। আইপিএল অভিষেক।
• ১৮ বছর, ৩২৯ দিন: টেস্ট অভিষেকের মুখে।
সচিনের আবির্ভাবের মতো একটা হাওয়া পৃথ্বীকে নিয়ে তৈরি হয়েছে দু’টো কারণে। একে তো মুম্বইয়ের স্কুল ক্রিকেটে সচিনের মতোই হুল্লোড় তুলেছিল পৃথ্বী। মুম্বইয়ের স্কুল টুর্নামেন্ট হ্যারিস শিল্ডে আমাদের রিজভি স্প্রিংফিল্ড স্কুলের হয়ে একটি ম্যাচে ৫৪৬ রান করে নতুন রেকর্ড গড়েছিল পৃথ্বী। সে দিন থেকেই ওর পিছনে ছুটছে সংবাদমাধ্যম।
সে দিনও স্কুলের ক্রিকেট কোচ হিসেবে আমি ওই ম্যাচে হাজির ছিলাম। ১৪ বছরের এক কিশোরের ব্যাটে স্ট্রোকের ফুলঝুরি দেখেছিল সে দিন আজাদ ময়দান। দু’দিন ধরে ব্যাট করে ম্যারাথন ইনিংস খেলার ফাঁকে প্রায় ৯০টা বাউন্ডারি মেরেছিল ও। পাঁচটা ওভার বাউন্ডারিও মারে। সত্যলক্ষ জৈনের সঙ্গে ৬১৯ রানের পার্টনারশিপ করেছিল। ইনিংসটাতে সব চেয়ে মুগ্ধ করার মতো ছিল, পৃথ্বীর ব্যাকরণ মেনে খেলা শট। ফ্লিক আর ড্রাইভে সব চেয়ে বেশি রান করেছিল। যে দু’টো শট ওই বয়সের ছেলের থেকে অত নিখুঁত ভাবে দেখব বললে আশাই করিনি। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, এই হ্যারিস শিল্ডেই সচিন তেন্ডুলকর আর বিনোদ কাম্বলির বিশ্বরেকর্ড ছিল।
পৃথ্বী যে কতটা জেদি ক্রিকেটার, তার একটা উদাহরণ দিই। ৫৪৬ রানের রেকর্ড ইনিংসটা খেলার আগেই ওকে বিশেষ ভাবে দু’জনের নাম করতে শুনেছিলাম। সরফরাজ খান আর আরমান জাফর। দ্বিতীয় জন ওয়াসিম জাফরের ভাইপো। ২০০৯ সালে সরফরাজ স্কুল ক্রিকেটে ৪৩৯ করেছিল। দু’বছর পরে সেটাকে টপকে ৪৯৮ করে নতুন রেকর্ড গড়ে আরমান। ওই দু’টো ইনিংসের কথা বলে পৃথ্বী সেই সময়ে বলত, আমি এ রকম কিছু করতে চাই। কিন্তু কিছুতেই করে উঠতে পারছি না। এর পরেই ওই ম্যাচে ৫৪৬ রান করল।
ওর সংকল্পের আর একটা উদাহরণ দিই। এক বার আমাদের প্রথম দলের সাত জন ক্রিকেটার মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার যুব দলের জন্য ট্রায়ালে চলে গিয়েছিল। পৃথ্বী যেতে পারেনি কারণ তখনও ওর বয়স হয়নি। আমরা খুবই সঙ্কটে পড়ে গেলাম কারণ ম্যাচটা ছিল বেশ শক্তিশালী স্কুলের সঙ্গে। পৃথ্বী একমাত্র ভরসা। কিন্তু ম্যাচের আগে ওর ধুম জ্বর। তবু এসে বলল, স্যর, আমি খেলবই। ম্যাচটা ওষুধ খেয়ে শুধু খেললই না, একা জিতিয়ে দিল। প্রতিপক্ষ প্রথম ইনিংসে ১৫৬-তে অলআউট হয়ে যায়। পৃথ্বী জ্বর নিয়ে খেলে একাই করল ১৫৬। প্রথম ইনিংসে বড় ‘লিড’ নিয়ে আমাদের স্কুল জিতল। ওর দায়বদ্ধতা আর রানের খিদে অতুলনীয়। ম্যাচ খেলে এসেও বিশ্লেষণ করবে, কোথায় ভুল হল। পরের দিন ঠিক সময়ে হাজির হয়ে যাবে নেট প্র্যাক্টিসে সেই ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার জন্য।
অনেকটা পথ অতিক্রম করে টেস্ট অভিষেকের দরজায় পৌঁছতে হয়েছে পৃথ্বীকে। দশ বছর বয়সে উত্তর মুম্বই থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের ভিরার থেকে বান্দ্রায় রোজ ঝুলতে ঝুলতে আসতে হত ওকে। প্রায় দু’ঘণ্টা লাগত বান্দ্রায় আসতে। তবু সেই যাত্রার ধকল থেকে সরে যায়নি পৃথ্বী। রোজ আসত যাতে সঠিক জায়গায় প্র্যাক্টিস করে সঠিক লোকদের নজরে পড়তে পারে। আমি পরে শুনেছি, ও ক্রিকেট খেলা শুরু করে দু’বছর বয়স থেকে। আর খুব সম্ভবত পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ওর সিরিয়াস ক্রিকেট খেলা। সব কিছুই করেছে অল্প বয়সে। এবং, সব চেয়ে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হচ্ছে ধারাবাহিক ভাবে সমস্ত বয়সভিত্তিক স্তরে ভাল করে গিয়েছে। যেমন কিশোর বা যুব দলের হয়ে দারুণ সাড়া জাগিয়ে শুরু করেছে, তেমনই রঞ্জি-দলীপে অভিষেকে সেঞ্চুরি করেছে। সমস্ত স্তরে এই ধারাবাহিকতা বড় প্রতিভারই লক্ষণ।
শুরুর দিকে যখন পৃথ্বী আমাদের স্কুলে আসে, তখনকার একটা ঘটনা বলি। আমি ওকে ১২ বছর বয়সিদের নেটে যেতে বললাম। কিন্তু ও সেখানে যাবে না। আমাকে বলল, স্যর, আমাকে ১৬ বছর বয়সিদের নেটে দিন। আমি ধমক দিয়ে বললাম, তুমি আগে ১২-তে যাও। তার পরে ভাল করলে ১৪-তে যাবে। তারও পরে ১৬। শুরুতেই ১৬ নয়। এর পর ১২ বছর বয়সিদের নেটে ও এমন ব্যাট করা শুরু করল যে, আমি বাধ্য হয়ে সোজা ওকে ১৬-দের নেটে পাঠাই।
পৃথ্বীর জীবনে ওর বাবা পঙ্কজ শ-এর অবদান সব চেয়ে বেশি। বাবাই ওর পথপ্রদর্শকের কাজ করেছেন। আমাদের স্কুলে নিয়ে এসে বলেছিলেন, ছেলেকে ক্রিকেটার করতে চাই। তার জন্য যা যা করার দরকার পড়বে, করতে রাজি। সত্যিই কোনও চেষ্টার কসুর রাখেননি তিনি। সামান্য রোজগার সত্ত্বেও পৃথ্বীর ক্রিকেট চাহিদায় কখনও কোনও অভাব রাখেননি। কত ছোট বয়স থেকে লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইংল্যান্ডে খেলতে পাঠিয়েছেন ছেলেকে। টেস্ট অভিষেকের আগে অন্তত সাত-আট বার ইংল্যান্ড সফর হয়ে গিয়েছে পৃথ্বীর। একটা সময়ে সস্তার অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থেকে ইংল্যান্ডে লিগ ক্রিকেট খেলিয়েছেন যাতে ছেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অগ্নিপরীক্ষায় পাশ করতে পারে।
রাজকোটে সেই অগ্নিপরীক্ষার লগ্ন উপস্থিত। অপেক্ষায় মুম্বই-সহ গোটা দেশ এবং বিশ্বের ক্রিকেট মহল!
(লেখক রিজভি স্প্রিংফিল্ডের ক্রিকেট কোচ। পৃথ্বী শ ৫৪৬ রান করে বিশ্বরেকর্ড গড়ার সময়ে তিনিই ওই স্কুলের কোচ ছিলেন এবং মাঠে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন ছাত্রের সংহার। সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুলিখনে জানালেন, নতুন বিস্ময় বালকের উত্থানের রোমাঞ্চকর কাহিনি)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy