আইপিএল মানেই স্বপ্ন পূরণের মঞ্চ। শূন্য থেকে কোটিপতি হয়ে ওঠার সুযোগ। মঙ্গলবার আবু ধাবিতে মিনি-নিলামে এমনই দু’জনকে নিল চেন্নাই সুপার কিংস, যাঁদের নিয়ে ক্রিকেটমহলে এত দিন কোনও মাতামাতি ছিল না। তাঁরা— কার্তিক শর্মা ও প্রশান্ত বীর। দু’জনেই আইপিএল ইতিহাসে সর্বোচ্চ দরের ‘আনক্যাপড’ ক্রিকেটার। অর্থাৎ যাঁরা এখনও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেননি। ৩০ লক্ষের ন্যূনতম মূল্য থেকে ১৪.২০ কোটিতে তাঁদের নিয়েছে সিএসকে। কার্তিক খেলেন রাজস্থানের হয়ে। প্রশান্ত উত্তরপ্রদেশের ক্রিকেটার। দু’জনের মিল এক জায়গায়— তাঁরা ছক্কা হাঁকাতে ভালবাসেন।
ছোটবেলা থেকে কোচেরাও তাঁদের কখনও স্বাভাবিক ক্রিকেট খেলতে বাধা দেননি। কার্তিককে তো রাজস্থান দলের ‘সিক্স হিটিং মেশিন’ বলে ডাকা হয়। সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে পাঁচ ইনিংসে ১৩৩ রান করেছেন। জিতিয়েছেন দু’টি ম্যাচ। ক্রিকেটজীবনে মোট ১২টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তাঁর রান ৩৩৪। স্ট্রাইক রেট ১৬২.৯২। কয়েক মাস আগেই স্থানীয় ৫০ ওভারের ম্যাচে ত্রিশতরান করে চমক দিয়েছিলেন কার্তিক। মঙ্গলবার চেন্নাই সুপার কিংস তাঁকে দলে নেওয়ার পরে কার্তিকের বাড়িতে শুরু হয় উৎসব।
বাবা মনোজ কুমারই তাঁর প্রথম কোচ। রাজস্থানের ভরতপুরে একটি অ্যাকাডেমিতে ছোটবেলায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন কার্তিককে। নিজেও ক্রিকেটারই ছিলেন। ভারতের হয়ে খেলার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর ছেলের মধ্যে প্রতিভার ঝলক দেখেছিলেন। দীপক চাহারের বাবা লোকেন্দ্র সিংহ চাহারের অ্যাকাডেমিতে ছেলেকে পাঠান তিনি। তরুণ কার্তিককে প্রথম দিন দেখেই ভাল লেগে যায় দীপকের বাবার। আনন্দবাজারকে তিনি বলছিলেন, ‘‘ওর কব্জিতে প্রচণ্ড জোর আছে। রঞ্জি ট্রফিতেও শেষ ম্যাচে শতরান করেছে। ওর ব্যাটে বল লাগতে শুরু করলে বোলারদের আর রক্ষে নেই। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে কয়েক দিন আগেই ৩০০ করেছে।’’ যোগ করেন, ‘‘দীপকও ওকে অনেক পরামর্শ দিয়েছে। ও তো কয়েক বছর আগে শুধু ব্যাটসম্যান ছিল। দীপক ওকে কিপিং গ্লাভস উপহার দিয়ে বলেছিল, কিপিং কর। শুধুমাত্র ব্যাটিং করলে এগোনো কঠিন।’’
কার্তিকও ধন্যবাদ জানালেন দীপক ও তাঁর বাবাকে। আনন্দবাজারকে বলছিলেন, ‘‘বিশ্বাস করতে পারছি না আমার জীবনে এটা কী ঘটল! বিকেল থেকে পরিবারের সকলে উৎসব শুরু করে দিয়েছিল। মিষ্টি খাওয়ানো হয় প্রতিবেশীদের। আমার বাবাকে দেখে বুঝতে পেরেছি, কতটা খুশি হয়েছেন।’’ কার্তিক আরও বলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকে বাবা অনেক পরিশ্রম করেছেন। আমরা খুব সাধারণ পরিবারের। ভরতপুর থেকে জয়পুরে খেলতে যেতে হত। প্রত্যেক দিন বাসে করে যাওয়ার সামর্থ্য থাকত না। ভরতপুর জেলা সংস্থা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। রাজস্থান ক্রিকেট সংস্থাকেও ধন্যবাদ। তারাও আর্থিক ভাবে একটা সময় আমাকেসাহায্য করেছে।’’
এক সময় বাসে করে প্রত্যেক দিন যাতায়াতের টাকা ছিল না। সেখান থেকে আজ ১৪.২০ কোটির মালিক। কখনও কল্পনা করেছিলেন? কার্তিকের উত্তর, ‘‘আমি আইপিএল খেলার স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু এত অর্থে চেন্নাই আমাকে নেবে ভাবতে পারিনি। আমি মাহি স্যরের ভক্ত। তাঁর মতোই বড় ছক্কা মারতে চেষ্টা করি। কিপিংয়েও মাহি স্যরই অনুপ্রেরণা। প্রথম বার দেখা করার জন্য মুখিয়ে রয়েছি।’’
মাত্র ১৩ বছরেই রাজস্থানের ক্লাব ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন কার্তিক। পেসারদের বিরুদ্ধেই তিনি বেশি সাবলীল। কার্তিকের কোচ লোকেন্দ্র সিংহ বলছিলেন, ‘‘ছোট থেকেই আগ্রাসী। কোনও ভয়ডর ছিল না ওর মধ্যে। ১৪ বছর বয়সে ক্লাব ক্রিকেটে সিনিয়রদের বিরুদ্ধে ১৮০ রান করেছিল। সে দিন রাজস্থানের নির্বাচকেরা ম্যাচটি দেখতে এসেছিলেন। ওকে দেখে সকলে বিস্মিত হয়ে যায়। আমি নিশ্চিত, ১৪.২০ কোটি টাকারমর্যাদা রাখবে ও।’’
কলকাতা নাইট রাইডার্সেও ট্রায়াল দিয়েছিলেন কার্তিক। ১৮টি ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন ট্রায়ালে। কেকেআরও তাঁর জন্য লড়াই করেছিল। কিন্তু শেষমেশ ছিনিয়ে নেয় সিএসকে। কার্তিক বলছিলেন, ‘‘চেন্নাইয়েই খেলার ইচ্ছে ছিল। কারণ মাহি স্যরের কাছে অনেক মূল্যবান পরামর্শ পাব। ক্রিকেটার হিসেবে আমাকে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।’’
অন্য দিকে প্রশান্ত মাত্র দু’টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ টি-টোয়েন্টি লিগে নয়ডার হয়ে ২২ বলে ৬১ রান করে চমক দেন। ১২টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তাঁর ঝুলিতে ৯ উইকেট। বাঁ-হাতে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বাঁ-হাতি স্পিনারও। রবীন্দ্র জাডেজার স্থান পূরণ করার জন্য প্রশান্তকে নেওয়া হল না তো? নিলামে বিশেষজ্ঞ হিসেবে থাকা অনিল কুম্বলে টিভি-তে বলেছেন, ‘‘অতিরিক্ত অর্থে কেনা হয়েছে। দু’টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছে। এতটা অর্থের চাপ সামলানো কঠিন।’’
প্রশান্ত যদিও চাপ অনুভব করছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘সিএসকে-তে ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলাম। সেখানেই আমাকে দেখে ওদের পছন্দ হয়। সত্যি বলতে বড় মঞ্চে খেলার অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, সিএসকের জার্সিতে খারাপ খেলব না। মাহি স্যর আমার আদর্শ। ছোটবেলা থেকেই চেয়েছি সিএসকের হয়ে খেলতে। উইকেটের পিছনে মাহি স্যর থাকলে আশা করি, অসুবিধেহবে না।’’
দুই তরুণ ক্রিকেটারকে বড় অর্থে নিয়ে চমক দিয়েছে সিএসকে। আইপিএলেও কি ধোনির দল চমক দেবে? তা সময়ই বলবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)