২০০৮ সালের ১১ অগস্ট। ভারতের প্রথম শুটার হিসেবে বেজিং অলিম্পিক্সে ব্যক্তিগত বিভাগে সোনা জিতেছিলেন অভিনব বিন্দ্রা।
সোনায় বাঁধানো সেই মুহূর্ত কোটি কোটি ভারতবাসীর মতো টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছিলেন আসানসোলের রুপেশ কুমার শ’ও। সেই বছরেরই মার্চে তাঁর ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছে আদরের সন্তান। প্রিয় তারকার নামে ছেলের নামও রেখেছিলন অভিনব। স্বপ্ন, এক দিন অলিম্পিক্সের পোডিয়ামে উঠতে দেখবেন ছেলেকেও।
সেই স্বপ্নপূরণ হবে কি না সময় বলবে। তবে বৃহস্পতিবার কাজ়াখস্তানে আয়োজিত এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে জোড়া সোনা পেয়েছে আসানসোলের ছেলে। ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের ব্যক্তিগত বিভাগে এবং এই ইভেন্টেরই দলগত বিভাগে। ২০০৮ সালে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলেই দেশকে সোনা দিয়েছিলেন অভিনব বিন্দ্রা।
ভারতের শুটিং আকাশে অবশ্য বিন্দ্রার আদর্শ নিয়ে বড় হওয়া অভিনব শ নামটি নতুন নয়। বয়স মাত্র ১৭। কিন্তু এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪-তে। রাজ্য স্তর মিলিয়ে সেই সংখ্যা বয়সকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। তবে জোড়া সোনা পাওয়ার পরে আর পাঁচটা কিশোরের মতো আনন্দ-উচ্ছ্বাস নেই। যখন কাজ়াখস্তানে দুপুরে ওয়টস্যাপ কলে ধরা হল, সবেমাত্র হোটেলে ফিরেছেন। একেবারে স্বাভাবিক গলা, বিন্দুমাত্র আবেগ বা উচ্ছ্বাস নেই। আন্তর্জাতিক মঞ্চে এ রকম একটা সাফল্যের অনুভূতি কেমন? এক কথায় উত্তর এল, “খুব ভাল লাগছে।” ব্যস, এটুকু! চেষ্টা করেও অনুভূতির কথা আর কিছুই বলানো গেল না।
অবশ্য আবেগ না থাকাটাই স্বাভাবিক। অভিনবর বাবা রুপেশ বলছিলেন, “ছোট থেকেই ও খুব অন্তর্মুখী স্বভাবের। নিজের জগত নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অবসর সময়ে দাবার বোর্ডে মুখ গুঁজে থাকে।” কৈশোরে এত সাফল্যের পরেও মাটিতে পা থাকার রহস্যও ফাঁস করলেন রুপেশ। “ছোট থেকেই বুঝিয়েছি, জীবনে চড়াই-উতরাই আসবে। তা নিয়ে আবেগপ্রবণ হবে না। লক্ষ্য থেকে সরে গেলে চলবে না,” বক্তব্য রুপেশের।
অভিভাবকেরা তো অনেক কিছুই বলেন। কেউ কেউ এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বার করে দেন। কিন্তু সেই তালিকায় পড়ে না অভিনব। বাবার কথা তাঁর কাছে বেদবাক্যের মতো। এই প্রশ্ন করতেই হেসে বলে ওঠে, “বাবা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে। নিজের শুটার হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক কারণে সেই স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। বাবার স্বপ্নপূরণ করার পরেই থামব। আমার লক্ষ্য অলিম্পিক্স। অভিনব স্যরের মতোই ভারতকে গর্বিত করতে চাই।”
আরও একটি চমকপ্রদ তথ্যের কথাও শুনিয়েছেন রুপেশ। মাত্র ছয় মাস বয়সে ছেলেকে সাঁতারের জন্য সুইমিং পুলে নিয়ে যেতেন। দেড় বছর বয়সে একাই সাঁতার কাটতে শিখে যায় অভিনব। যে বয়সে শিশুরা হয়তো ভাল করে কথা বলতে শেখে না, সেই বয়স থেকেই এমন ভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যেন ফিটনেস কোনও দিন অভীষ্ট লক্ষ্যের পথে না অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি ক্যারাটেও শিখিয়েছেন। আসানসোলের রাইফেল ক্লাবে সাড়ে সাত বছর বয়সেই ভর্তি হয় অভিনব। বাবাই ছিলেন তাঁর প্রথম শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক।
প্রাথমিক শিক্ষা পাওয়ার পরে অভিনব মাত্র ১০ বছর বয়সে ভর্তি হয় অলিম্পিয়ান জয়দীপ কর্মকারের অ্যাকাডেমিতে। সেখানে থাকতেই ২০১৮ সালে ত্রিবান্দ্রমে জাতীয় শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে কনিষ্ঠতম হিসেবে জোড়া সোনা জিতে নতুন নজিরও গড়ে। আনন্দবাজারকে জয়দীপ বলছিলেন, “ওর মধ্যে একটা আলাদা ব্যাপার আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছিলাম। সেটা হল মনঃসংযোগ। সকলেই জানে, শুটিংয়ে মনঃসংযোগ কতটা জরুরি। সেটা ওর মধ্যে ভরপুর রয়েছে। এটা ওর জন্মগত প্রতিভা। তবে শুধু তো প্রতিভা দিয়ে বেশিদূর এগোনো যায় না। তার সঙ্গে রয়েছে কঠোর পরিশ্রমও।”
বৃহস্পতিবার এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে দলগত বিভাগে নারাইন প্রণব ও হিমাংশুর সঙ্গে অভিনব মোট স্কোর করে ১৮৯০.১। যা এশীয় পর্যায়ের পাশাপাশি জুনিয়রদের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও বিশ্ব রেকর্ড। ব্যক্তিগত বিভাগে অভিনব ২৫০.৪ স্কোর করে সোনা জেতে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরে মাত্র ০.১ পয়েন্টের ব্যবধানে রুপো পায় দক্ষিণ কোরিয়ার নামজাদা শুটার হুন সেও লি।
২০২২ সালে প্রথম বার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জুনিয়র শুটিং বিশ্বকাপে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে রুপো পায় অভিনব। তার পরের বছরই অবশ্য পদকের রং বদলায়। বিশ্বকাপে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল মিক্সড বিভাগে আসে সোনা। সেই বছরই জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল মিক্সড ও ছেলেদের দলগত বিভাগে জোড়া সোনা পায় অভিনব।
তবে নিজের আদর্শ শুটারের সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি বলে আক্ষেপ রয়েছে অভিনবর। তার আশা, বিন্দ্রাই কোনও এক দিন পদক পরিয়ে দেবেন। সেই প্রহরের দিকে তাকিয়েই দিন গুনছে ভক্ত অভিনব।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)