Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
একান্ত সাক্ষাৎকারে শ্রীসন্ত: ইডেনকে ভালবাসি, আর এক বার অন্তত ওখানে নামতে চাই

বয়স কোনও বাধা নয়, লি-কে দেখে শিখেছি

তাঁর ওপর থেকে আজীবন নির্বাসনের শাস্তি তুলে নিতে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছে কেরল হাইকোর্ট। সেই রায় শোনার পর থেকেই জীবন বদলে গিয়েছে প্রাক্তন ভারতীয় পেসারের। আদালত, আইনজীবী, ফিল্মের প্রচার, চ্যারিটির কাজ সব সামলে সময় বার করাই এখন কঠিন তাঁর পক্ষে। সেই ব্যস্ততার মধ্যেই বৃহস্পতিবার কোচি থেকে মোবাইলে আনন্দবাজার-কে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন শান্তাকুমারন শ্রীসন্ত।রায় শোনার পর থেকেই জীবন বদলে গিয়েছে প্রাক্তন ভারতীয় পেসারের। আদালত, আইনজীবী, ফিল্মের প্রচার, চ্যারিটির কাজ সব সামলে সময় বার করাই এখন কঠিন তাঁর পক্ষে।

স্বপ্ন: ভারতীয় দলে প্রত্যাবর্তনের আশায় শ্রীসন্ত। ফাইল চিত্র

স্বপ্ন: ভারতীয় দলে প্রত্যাবর্তনের আশায় শ্রীসন্ত। ফাইল চিত্র

কৌশিক দাশ
শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৭ ০৩:৪৬
Share: Save:

প্রশ্ন: কেরল হাইকোর্টের রায়টা প্রথম যখন শুনলেন, মনের মধ্যে কী হচ্ছিল?

শ্রীসন্ত: মনে হল, যেন নতুন একটা জীবন পেলাম। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমাকে আবার একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমার সত্যিকারের জীবনটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।

প্র: আদালতের এই রায়কে কী বলবেন? জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক সিদ্ধান্ত?

শ্রীসন্ত: অবশ্যই। বললাম না, আমার জীবন আবার নতুন করে ফিরিয়ে দিয়েছে মহামান্য আদালত। আমি ক্রিকেট নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। সেই সুযোগটা আবার পাচ্ছি।

প্র: কিন্তু এই মুহূর্তে আপনার বয়স ৩৪। আপনি কি সত্যিই আশা করেন আবার প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে ফিরতে পারবেন?

শ্রীসন্ত: কেন নয়? আমি সব সময় মনে করি, খেলায় বয়সটা একটা সংখ্যা মাত্র। আপনি যদি ফিট থাকেন, আপনি যদি পারফর্ম করতে পারেন, তা হলে আপনাকে কেউ আটকাতে পারবে না। বয়সটা কোনও বাধা হতে পারে না।

প্র: কিন্তু তাও আপনার অবস্থাটা তো খুব চ্যালেঞ্জিং। এখান থেকে নিজেকে উদ্দীপিত করবেন কী ভাবে?

শ্রীসন্ত: কেন, আমার সামনে কি উদাহরণ কম আছে? আপনাদের কলকাতার ছেলে লিয়েন্ডার পেজই তো আছে। ও তো দেখিয়ে দিয়েছে ৪৪ বছর বয়সেও গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা যায়। এ ছাড়া আরও উদাহরণ আছে। যারা এখনও মাঠে নেমে নিজেদের সেরাটা দিচ্ছে। এরাই আমার প্রেরণা। এরাই আরও পরিশ্রম করতে উদ্বুদ্ধ করছে।

প্র: আদালত আপনার পক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড তো এই রায় চ্যালেঞ্জ করতে পারে?

শ্রীসন্ত: আমি সত্যিই আশা করছি, হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাবে ভারতীয় বোর্ড। আমি বোর্ডকর্তাদের একটা কথাই বলব, দয়া করে ব্যক্তিগত লড়াইয়ের পর্যায়ে ব্যাপারটা নিয়ে যাবেন না। আমার রুটি-রুজি ফিরে পাওয়ার রাস্তাটা বন্ধ করে দেবেন না। আমাকে যারা ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনেন, তাঁরা খুব ভাল করেই জানেন, এই চার বছরে আমার কী অবস্থা গিয়েছে। আমার শুধু একটাই প্রার্থনা। আমার রুটি-রুজির ওপর কোপ মারবেন না।

প্র: আপনার জীবনে ৭ তারিখের এই খবরটাই কি সবচেয়ে আনন্দদায়ক?

শ্রীসন্ত: নিঃসন্দেহে। এর চেয়ে ভাল খবর আর কোনও দিন পাইনি।

প্র: আপনি ভারতের হয়ে টেস্ট খেলেছেন, ওয়ান ডে খেলেছেন। দু’টো বিশ্বকাপ জিতেছেন। তাও বলবেন, এটাই সেরা খবর?

শ্রীসন্ত: হ্যাঁ, বলব। কারণ এই খবরটা পাওয়ার পরে আমার সামনে বন্ধ দরজাটা আবার খুলে গিয়েছে। আমার বাচ্চারা, আমার স্ত্রী, আমার বাবা-মা, সবাই আবার আমাকে মাঠে দেখতে পাবে। এর চেয়ে ভাল খবর আর কী হতে পারে। আশা করছি, আমি আবার সুযোগ পাব, নিজেকে একজন দারুণ ক্রিকেটার হিসেবে প্রমাণ করার। একশো টেস্ট উইকেট পেতে আমার আর ১৩টা উইকেট দরকার। আশা করি, জীবনে সুযোগ আসবে ওই ১৩টা উইকেট নেওয়ার। আর শুধু ১৩ বলছি কেন, আমি ভারতের হয়ে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি উইকেট পেতে চাই।

আরও পড়ুন: সীতা-বন্দির বন দেখে নামছে ভারত

প্র: মহম্মদ আজহারউদ্দিন বলেছেন, শ্রীসন্তের ব্যাপারটা বোর্ডের ঠিক মতো সামলানো উচিত ছিল। বলেছেন, শ্রীসন্তের মতো দুর্দান্ত বোলারের ওপর যদি ঠিক মতো নজর দেওয়া হতো তা হলে ও আরও কার্যকর হতো।

শ্রীসন্ত: অবশ্যই। আমার পাশে অনেক কিংবদন্তি ক্রিকেটারই দাঁড়িয়েছেন। যাঁদের খেলা দেখে আমি বড় হয়েছি, তাঁরা যখন আপনার হয়ে ভাল কথা বলেন, তখন তো আপনি অনুপ্রাণিত হবেনই। কিন্তু পাশপাশি আবার এমন ক্রিকেটারও আছে, যারা শুধু শুধু আপনাকে আক্রমণ করে। তখন খুব খারাপ লাগে।

প্র: কাদের কথা বলছেন আপনি?

শ্রীসন্ত: আমি দু’জনের কথা বলব। সঞ্জয় মঞ্জরেকর এবং আকাশ চোপড়া। আকাশ আগে আমাকে নিয়ে অনেক রকম কথা বলেছে। এ বার আদালতের রায় শোনার পরে মঞ্জরেকর আমার ব্যাপারটা নিয়ে অহেতুক মন্তব্য করেছেন।

(৭ অগস্ট রায় বেরোনোর পরে সঞ্জয় মঞ্জরেকর টুইট করেন, ‘বোর্ড যখন ম্যাচ গড়াপেটার জন্য কাউকে সাসপেন্ড করে, তখন নিশ্চয়ই তাদের হাতে অনেক কিছু থাকে। তা হলে ধরে নিতে হবে শাস্তি ওঠার রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করার মতোও যথেষ্ট কারণ আছে বোর্ডের হাতে।)

প্র: মঞ্জরেকরের বক্তব্য নিয়ে আপনি কী বলবেন?

শ্রীসন্ত: মঞ্জরেকর যে এ রকম নীচে নামতে পারেন, আমি ভাবতে পারিনি। আমি শুধু বলব, ব্যাপারটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেবেন না। মহামান্য বিচারকেরা কী রায় দিয়েছেন, সেটা দেখুন। এই মঞ্জরেকর, আকাশ চোপড়াদের কাছে কী প্রমাণ আছে আমার বিরুদ্ধে। আমাকে যারা চেনে, তারা জানে আমি কখনও ম্যাচ গড়াপেটার মতো নোংড়া কাজ করব না। তবে এক জন মঞ্জরেকর, কী এক জন চোপড়া কী বলছেন, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

প্র: আপনার ক্রিকেটের মূল স্রোতে ফিরে আসার রাস্তাটা কী হবে?

শ্রীসন্ত: আমাকে আবার ক্লাব ক্রিকেট থেকে শুরু করতে হবে। আমি নিয়মিত ট্রেনিং করছি। কেরল ক্রিকেট সংস্থা আমার সঙ্গে আছে। ডাভ হোয়াটমোর স্যার কেরল ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত। অতীতে আমি অনেক সাহায্য পেয়েছি হোয়াটমোর স্যারের কাছ থেকে। ওঁর সঙ্গে কাজ করার জন্য মুখিয়ে আছি।

প্র: আপনি কি স্কটিশ লিগে খেলার পরিকল্পনা নিয়েছেন?

শ্রীসন্ত: স্কটিশ লিগে এখনও গোটা তিন-চারেক ম্যাচ পড়ে আছে। ওখানে খেলতে পারলে তো ভালই হয়। আমি এনওসি চেয়েছি। সিমিং কন্ডিশনে বল করতে পারলে আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়বে। তার পর ওখান থেকে এসে কেরলের হয়ে রঞ্জি খেলতে চাই।

প্র: কিন্তু বোর্ড যদি এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করে আদালতে যায়, তা হলে কী করবেন? শোনা যাচ্ছে বোর্ড সে রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

শ্রীসন্ত: আমি এখনও জানি না, বোর্ড কী করবে। আশা করব, আমার প্রতি আর কোনও বিরূপ মনোভাব ওরা দেখাবে না। কিন্তু বিসিসিআই যদি এই মামলা উচ্চ আদালতে টেনে নিয়ে যেতে চায় তবে আমিও আমার মতো করে লড়ব। লড়াই ছাড়ার কোনও প্রশ্নই নেই। দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবই।

প্র: আপনি এই মুহূর্তে কী স্বপ্ন দেখছেন?

শ্রীসন্ত: দেখছি, আবার ভারতীয় দলের জার্সি পড়ে বল হাতে দৌড় শুরু করছি। দেখছি, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সিরিজ জিতে ফিরছি। দেখছি, ২০১৯ বিশ্বকাপে দেশের হয়ে মাঠে নামছি। আমি জানি, অনেকেই বলবে এগুলো ঘটলে অলৌকিক ব্যাপার হবে। তবে আমি কিন্তু অলৌকিকে বিশ্বাস রাখি।

প্র: আপনি আগে বলেছিলেন, বিনোদ রাইকে চিঠি লিখে খেলতে দেওয়ার অনুরোধ করবেন। সেটা কী করেছেন?

শ্রীসন্ত: আমি ইতিমধ্যেই বিনোদ রাইকে ই-মেল করেছি, চিঠি লিখেছি। সচিবকেও মেল করেছি। আমি এখন জবাবের অপেক্ষায় আছি। বুধবার অ্যাসোসিয়েশনকেও চিঠি দিয়েছি।

প্র: ক্রিকেটের বাইরে আসি। আপনি তো রূপোলি পরদার নায়ক এখন। ব্যাপারটা কতটা উপভোগ করছেন?

শ্রীসন্ত: আপনারা ভুল ভাবছেন। আমি কখনওই তারকা হব বলে ফিল্ম লাইনে আসিনি। আমি এসেছিলাম বাঁচার লড়াই লড়তে। আমার পরিবারের জন্য রুটি-রুজি জোগার করতে। আমার কাছ থেকে যখন ক্রিকেটটা কেড়ে নেওয়া হল, আমার সামনে আয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি পূজা ভট্ট ম্যামের কাছে কৃতজ্ঞ, আমাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমার এই লড়াইয়ে আমি বেশ কিছু চ্যানেলকেও পাশে পেয়েছি। আমি একটা মালায়ালাম মুভি করেছি। একটা বলিউড ফিল্ম করছি। তার পরে একটা কন্নড় ফিল্ম। ব্যস। আর কোনও ছবিতে সই করিনি। এ বার ফোকাস থাকবে শুধুই ক্রিকেটে।

প্র: শেষ প্রশ্ন। আপনাকে মানুষ কী ভাবে মনে রাখবে?

শ্রীসন্ত: মনে রাখবে এমন একটা ছেলে হিসেবে যে হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই ছাড়েনি। যে চেয়েছে, সব সময় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে। যে চেয়েছে, মাঠে নেমে সব সময় নিজের সেরাটা দিতে।

প্রশ্ন: অনেক ধন্যবাদ শ্রীসন্ত...

শ্রীসন্ত: (থামিয়ে দিয়ে) আমি আপনাদের কাগজের মাধ্যমে কলকাতার মানুষকে একটা কথা বলতে চাই। আমি ইডেনে অনেক ম্যাচ খেলেছি। ওই মাঠটাকে খুব ভালবাসি। আমি আর একবার ওখানে ফিরতে চাই। কলকাতার মানুষকে বলতে চাই, আমি কিন্তু ক্রিকেটকে কোনও দিন ঠকাইনি। আপনারা প্লিজ, প্লিজ শ্রীসন্তের জন্য প্রার্থনা করবেন। যাতে আমি লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE