লেসলি ক্লডিয়াস, কেশব দত্ত, গুরবক্স সিংহ, বীরবাহাদুর ছেত্রী, ভরত ছেত্রীর মতো আঠারো জন হকি অলিম্পিয়ানের বেড়ে ওঠা এই রাজ্যে।
এশিয়াড, অলিম্পিক্স মিলিয়ে অন্তত চল্লিশটি পদক আছে বাংলার বিভিন্ন হকি তারকার ক্যাবিনেটে। এর মধ্যে সোনা, রূপো-সহ কুড়িটিরও বেশি অলিম্পিক্সেরই পদক।
দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যের প্রতিযোগিতা বেটন কাপ হইহই করে হত ময়দানে। ধ্যানচাঁদ থেকে অশোককুমার— এঁদের খেলা দেখতে উপচে পড়ত মানুষ।
সেই বাংলারই হকি সংস্থার দরজায় তালা পড়ে গেল। সংস্থার পাঁচ জন কর্মীকে বৃহস্পতিবার রাতে বের করে দিয়ে তালা লাগিয়ে দিলেন বেঙ্গল হকি সংস্থার (বিএইচএ) কর্তারা। সংস্থার ১১০ বছরের ইতিহাসে যা কখনও হয়নি। কর্মীদের বলে দেওয়া হয়, ‘‘সংস্থার মাইনে দেওয়ার টাকা নেই। তাই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে অফিস। এক মাসের মাইনে নিয়ে বাড়ি চলে যান। কাল থেকে আসতে হবে না।’’ সাতাশ-আঠাশ বছর ধরে সংস্থার কাজ করছেন যে পাঁচ কর্মী সেই রবি বিশ্বাস, চিন্ময় মুখোপাধ্যায়, শুভাশিস সেনগুপ্ত, নিতাই কর্মকার, ভজন সরকাররা শুক্রবার অফিসে এসে দেখলেন দরজায় তালা। গেটের সামনে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে গেলেন পঞ্চাশ-ষাটোর্দ্ধ বয়সি ওই কর্মীরা।
আরও পড়ুন: অদ্ভুত শর্তে শামিকে পাচ্ছেন মনোজেরা
কী হয়েছিল বৃহস্পতিবার রাতে ডেকার্স লেনের বি এইচ এ অফিসে? সাতাশ বছর ধরে বিএইচএতে কাজ করছেন শুভাশিস সেনগুপ্ত। বললেন, ‘‘অক্টোবরের মাইনে পাইনি এখনও। সেটা বারবার চাইছিলাম সচিবের কাছে। সংসার চালাতে পারছিলাম না। বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ-ই সহসচিব খালিদ হোসেন কিছু লোকজনকে নিয়ে অফিসে ঢুকে একটা চিঠিতে সই করতে বলেন। আমরা বলি এটা কী? ওরা জানায়, কাল থেকে আসতে হবে না। এক মাসের টাকা নিয়ে বাড়ি চলে যা। আমি, রবি দা, চিন্ময়দাও প্রতিবাদ করি।’’ সঙ্গে হুগলির শুভাশিস যোগ করেন, ‘‘ওঁরা বলল টাকা নেই। মাইনে দিতে পারব না। আমরা বললাম টাকা আনার দায়িত্ব তো আপনাদের। আমরা চিঠি নিইনি। পাঁচ জনের দু’জন নিয়েছে।’’ যে দু’জন চিঠি নিয়েছেন তাঁদের একজন ভজন সরকার। বলছিলেন, ‘‘আমার কাজ ছিল বিভিন্ন ক্লাবে চিঠি দিয়ে বেড়ানো। সেটা করতাম। সচিব ঠিক করে দিয়েছিলেন দু’টোয় আসতে হবে। আটটা পর্যন্ত থাকতে হবে। সেটাই তো করতাম।’’ যে চিঠি ভজনকে ধরানো হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, সময় মতো অফিসে না আসা, বারবার বলা সত্ত্বেও কম্পিউটর না শেখা, গা ছাড়া মনোভাব-সহ নানা অভিযোগ আনা হয়েছে কর্মীদের বিরুদ্ধে। বিওএ সচিব স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ওদের বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও ঠিক সময় অফিসে আসত না। কাজ করত না। তিন বার চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাতেও শোনেনি। বাধ্য হয়েই সবাই মিলে ওদের লালকার্ড দেখিয়েছি। মাইনেও দিয়ে দেব।’’ কিন্তু সংস্থার অফিস তালা বন্ধ কেন? শুক্রবার কেন সেখানে গিয়ে কোনও কর্তার দেখা পাওয়া গেল না? সচিবের মন্তব্য, ‘‘সব নতুন করে শুরু করব। টাকা আসছে। অফিসও খুলব দ্রুত।’’ কিন্তু ঘটনা হল, বিওএ, মোহনবাগান, বক্সিং-সহ বহু ক্রীড়া সংস্থার পদে বসে থাকা স্বপনবাবু হকির জন্য সময়ই দিতে পারেন না।
এমনিতে রাজ্য হকির হাল খুব খারাপ। বলা যায় তলানিতে। আর্থিক অবস্থাও সঙ্গিন। ছয় বছর আগে জমানো সংস্থার সাইত্রিশ লাখ টাকা এসে দাঁড়িয়েছে তিরিশ হাজারে। কর্মীদের বেতন দিতে মাসে লাগে ৩৬ হাজার আটশো আট টাকা। সেই টাকাই নেই। টাকার অভাবে গত বছর বেটন কাপও হয়নি। ৬৫ টি ক্লাব, ছয়টি জেলা নিয়ে চারটি ডিভিশনের লিগ চলে চূড়ান্ত অগোছালভাবে। তিন হাজার নথিভুক্ত হকি খেলোয়াড়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে। যুবভারতীতে জায়গা পেয়েও কৃত্রিম ঘাসের মাঠ তৈরি করতে পারেনি বিএইচও। ক্রীড়া দফতর সেই জমি ফেরৎ নিয়ে নিয়েছে।
আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছয় বছর কোনও নির্বাচন হয়নি সংস্থায়। বিরক্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট-সহ বহু কর্তা পদত্যাগ করেছেন। বলা যায়, কমিটির অর্দ্ধেক সদস্যই নেই। ফলে ডামাডোল তুঙ্গে। প্রাক্তন হকি খেলোয়াড় ও জাতীয় আম্পায়ার বাসু ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘বারবার বলেও নির্বাচন করানো যাচ্ছে না। ক্ষমতার জোরে তা আটকে রাখা হয়েছে। সংস্থার দরজা তো বন্ধ হবেই। চল্লিশ বছর হকির সঙ্গে জড়িয়ে আমি। এ রকম অন্ধকার অবস্থা বা ডামাডোল কখনও দেখিনি।’’ আর এক ক্লাব কর্তা ও জাতীয় খেলোয়াড় ইস্তিয়াক হোসেন জাইদি আবার বললেন, ‘‘সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে চলছে সংস্থা। নির্বাচন না করে ক্ষমতা দখল করে রাখা হয়েছে। কোনও নিয়মই নেই এখন হকিতে।’’ ময়দানের হকির পরিচিত কর্তা বাসু বা ইস্তিয়াক একথা বললেও অলিম্পিয়ান ও প্রাক্তন সচিব গুরবক্স সিংহ এ সব নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। বললেন, ‘‘আমি অনেক আগেই পদত্যাগ করেছি। বহুদিন ওখানে যাই না। কী হয়েছে না জেনে বলতে পারব না।’’