Advertisement
E-Paper

দৌড় আর ধ্যানকে অস্ত্র করে উদয় নতুন তারার

ক্রিকেট একই সঙ্গে হর্ষ আর বিষাদ নিয়ে উপস্থিত হতে পারে, তাঁর থেকে ভাল আর কে জানে! মায়াঙ্ক আগরওয়ালের জীবনটাই তো আশা-হতাশার মোচড়ে ভরা। ঘরোয়া ক্রিকেটে ঝুড়ি ঝুড়ি রান করেও জাতীয় দলে সুযোগ হবে না।

সুমিত ঘোষ 

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৪:০৯

এই ভারতীয় দলে তাঁর সব চেয়ে ভাল বন্ধু? কে এল রাহুল। যাঁকে সরিয়ে তিনি ওপেনার হিসেবে টেস্ট অভিষেক ঘটাতে নামলেন!

ক্রিকেট একই সঙ্গে হর্ষ আর বিষাদ নিয়ে উপস্থিত হতে পারে, তাঁর থেকে ভাল আর কে জানে! মায়াঙ্ক আগরওয়ালের জীবনটাই তো আশা-হতাশার মোচড়ে ভরা। ঘরোয়া ক্রিকেটে ঝুড়ি ঝুড়ি রান করেও জাতীয় দলে সুযোগ হবে না। অনেক বেশি নাচানাচি হবে নতুন বিস্ময় প্রতিভা পৃথ্বী শ-কে নিয়ে। তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন, তাঁর চেয়ে কম রান করেও পৃথ্বীর টেস্ট অভিষেক হয়ে যাচ্ছে। আর তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে স্কোয়াডে এসেও খেলার সুযোগ পাচ্ছেন না। অস্ট্রেলিয়া সফরের জন্য টেস্ট দল ঘোষণা হল। পৃথ্বী থাকলেন, মায়াঙ্ক কোনও পরীক্ষায় বসার সুযোগ না পেয়েই বাদ। কোথা থেকে আবার মুরলী বিজয়কে ফিরিয়ে আনা হল।

ভাগ্য যাঁর সহায় হয় না, তাঁর সামনেই হঠাৎ করে ভাগ্যের দরজা খুলে গেল। চোট-আঘাত এবং ওপেনারদের অফ ফর্ম তাঁকে রাতারাতি উড়িয়ে এনে মেলবোর্নের বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচের মতো স্মরণীয় মঞ্চে অভিষেক ঘটিয়ে দিল। আর মায়াঙ্ক সেই সুযোগকে সান্টা ক্লজ়ের উপহারে পরিণত করলেন সাহসী ওপেনারের ভূমিকায় উদয় হয়ে।

বক্সিং ডে-তে লাঞ্চের আশেপাশে সময়ে সম্প্রচারকারী চ্যানেল ‘জুম’ করেছিল ভারতীয় ড্রেসিংরুমের উপরে। প্যাড পরে বসে আছেন বিরাট কোহালি। দারুণ মেজাজে তিনি। চোখেমুখে উদ্বেগের ছাপ নেই। পাশে বসে আছেন ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গার। অনেক দিন পরে ভারত অধিনায়ককে দেখে মনে হচ্ছে না, অপেক্ষা করছেন যে, কখন আমাকে নামতে হবে! বরং ক্রিজে চেতেশ্বর পূজারা এবং মায়াঙ্ক আগরওয়ালের ব্যাটিং বেশ আশ্বস্ত একটা পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে।

মায়াঙ্কের কথাবার্তা শুনে যদিও মনে হল, অস্ট্রেলীয় পেসারদের চেয়েও বিষাক্ত বোলারকে খেলতে হয়েছে তাঁকে— অভিষেকের আবেগ। কত বসন্ত ধরে অপেক্ষা করেছেন এই মুহূর্তটার জন্য। শেষ পর্যন্ত ২৯৫ নম্বর টেস্ট ক্যাপ হাতে পেয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। ‘‘আবেগ সামলে মনঃসংযোগ করা মোটেও সহজ ছিল না। অস্বীকার করব না, শুরুতে সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু নিজেকে বোঝানোর দরকার ছিল যে, সব কিছুকে সরিয়ে রেখে শুধু খেলার উপরে মনঃসংযোগ করতে হবে। নিজেকে বলেছিলাম, একটা পরিকল্পনা নিয়ে তুমি ক্রিজে এসেছ। সেটাকে ধরে রেখে এগিয়ে যাও।’’ কর্নাটকের ২৬ বছর বয়সি যে ভাবে শুরু করেন, তাতেই একটা প্রত্যয়ের ছাপ লক্ষ করা যায়। দ্রুতই ২৩ বলে ২১ রানে পৌঁছে যান তিনি। অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক টিম পেন আক্রমণে নিয়ে এলেন নেথান লায়নকে। এই সিরিজে তাঁদের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। মায়াঙ্ক তাঁকে প্রথম ওভারেই এমন কভার ড্রাইভ মারলেন যে, বিরাট কোহালির কব্জি ব্যবহারের সঙ্গে তুলনা শুরু হয়ে গেল। কোহালির মতোই অনেক বেশি ‘বটমহ্যান্ড’ অর্থাৎ ডান হাত ব্যবহার করে ব্যাট করেন মায়াঙ্ক।

অস্ট্রেলীয় পেসাররা যদিও তাঁর প্রতিজ্ঞাকে দুমড়ে দেওয়ার চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি। বিশেষ করে প্যাট কামিন্স আক্রমণে আসার পরে পাঁজর আর শরীর লক্ষ করে বাউন্সার-বৃষ্টি চালিয়ে গেলেন। মায়াঙ্ক দু’তিন বার চোখ বন্ধ করে ফেলে শরীরে আঘাত পেলেন। কিন্তু নির্ভীক যোদ্ধার মতো এক বারও আঘাতের জায়গায় হাত বোলাতে দেখা গেল না। তাঁর সাহস নিয়ে কোনও দিনই কারও সন্দেহ ছিল না। এক বার প্রথম শ্রেণির একটি ম্যাচে খেলতে নামার আগে বাঁশের কোনায় লেগে চোখের নীচে কেটে যায়। সবাই তাঁকে বিশ্রাম নিতে বলেছিল। মায়াঙ্ক শোনেননি। ওই অবস্থাতেই ম্যাচ খেলেন এবং রানও করেন। আরও উদাহরণ আছে। গত মরসুম তাঁর জীবনকে পাল্টে দিয়ে যায়। কিন্তু প্রথম দু’টি ম্যাচে রান করতে পারেননি। কর্নাটকের নির্বাচকেরা ভেবেছিলেন বসিয়ে দেবেন। তাঁর হয়ে লড়াই করেন অধিনায়ক বিনয় কুমার। ভুল লোককে যে সমর্থন করেননি অধিনায়ক, তা প্রমাণ করে দেন মায়াঙ্ক। তৃতীয় ম্যাচেই করেন ৩০৪ নট আউট। গোটা মরসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রেকর্ড ২২৩২ রান।

কামিন্সদের গোলাগুলি সামলে ১৬১ বলে ৭৬ অবশ্যই বক্সিং ডে আবহে লেটার মার্কস নিয়ে পাশ করার সমান। মায়াঙ্ক খুশি তবে সন্তুষ্ট নন। দিনের খেলা শেষে সাংবাদিকদের সামনে এসে বলে দিলেন, ‘‘আমি নিশ্চয়ই এই রানটা পেয়ে খুশি। এর চেয়ে কম পাওয়ার চেয়ে এই রানটা পাওয়া ভাল। তবে আরও থাকতে পারতাম। ভাল লাগত যদি নট আউট থেকে দিনটা শেষ করতে পারতাম।’’ কথাবার্তায় স্পষ্ট ইঙ্গিত, অভিষেকেই সেঞ্চুরি করা তারকাদের উজ্জ্বল গ্রহে ঢুকে পড়ার সামনে এসেও স্বপ্নভঙ্গ হওয়াটা খোঁচা দিচ্ছে। মায়াঙ্ক মনে রাখতে পারেন তাঁর রাজ্যের কিংবদন্তির কথা। লর্ডসে অভিষেকে পাঁচ রানের জন্য সেঞ্চুরি পাননি রাহুল দ্রাবিড়। কিন্তু শেষ করেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে। ভারতীয় ‘এ’ দলের সদস্য হিসেবে কোচ দ্রাবিড়ের অধীনেই বিকশিত হয়েছে তাঁর ব্যাটিং প্রতিভা। মায়াঙ্ক প্রসঙ্গে এই ভারতীয় দলের হে়ড কোচ রবি শাস্ত্রীর কথাও বলতে হবে। বরাবর তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে সফল হয়েছেন অধিনায়ক ও কোচ শাস্ত্রী। সাইরাজ বাহুতুলেদের তরুণ মুম্বই দলকে নিয়ে রঞ্জি ফাইনালে বাংলাকে হারিয়েছিলেন। এখানেও মায়াঙ্ককে দিয়ে ওপেন করানোর পিছনে শাস্ত্রীর বরাবরের সেই তারুণ্য নীতি।

মায়াঙ্ক ভারতের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেন ২০১০ সালে। তার পরের বছরে আইপিএলে সুযোগ পান। কিন্তু ক্রিকেটের ক্রোড়পতি লিগে এখনও সে ভাবে নিজেকে দাঁড় করাতে পারেননি। অথচ, তাঁকে একটা সময়ে সাদা বলের ব্যাটসম্যান বলে চিহ্নিত করে ফেলা হয়েছিল। কেউ কেউ এমনও বলেন যে, নতুন বীরেন্দ্র সহবাগ। নজফগড়ের নবাবের মতোই দ্রুত রান করতে ভালবাসেন। যদিও সহবাগীয় ঝড় এ দিন দেখা যায়নি।

মায়াঙ্কের সম্পর্কে একটা অভিযোগ প্রায়ই শোনা যেত কয়েক বছর আগেও। তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করতে চান না। শরীরে জমে থাকা মেদ খুব একটা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করছিল না পণ্ডিতদের মধ্যে। কিন্তু গত দু’বছর ধরে ফিটনেস নিয়ে খেটেছেন তিনি। পুরনো আমলের ‘লং ডিসট্যান্স রানিং’ তাঁর ফিটনেস ধরে রাখার প্রধান মন্ত্র। সঙ্গে বাবার কাছ থেকে শেখা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এক বিশেষ ধ্যান।

কামিন্সদের আগুনে গতির সামনে ধৈর্য ধরে পড়ে থাকার মনোভাবটা হয়তো ধ্যান করা থেকেই পাওয়া। শত ঝাঁকুনিতেও যা সহজে টলেনি। কে এল রাহুলকে দেখা গেল সকালেই মায়াঙ্ককে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইট করেছেন। সব কিছু ঠিকঠাক চললে, বিজয়-রাহুলের পরিবর্ত হিসেবে আগামী দিনে দেখা যাবে নতুন প্রজন্মের দুই ওপেনারকে। পৃথ্বী শ এবং মায়াঙ্ক আগরওয়াল।

এক জন তাঁর বিস্ময় প্রতিভা দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছেন, অন্য জনের পৃথিবী নিঃশব্দ লড়াইয়ের। এক জন তরতর করে উঠে আসছেন, অন্য জনের ক্রিকেট যাত্রা চলছে ধাপে ধাপে। বিনোদ কাম্বলির সেই পুরনো উক্তি মনে পড়ে যাবে, ‘‘সচিন উঠছে এলিভেটরে। আমি সিঁড়ি বেয়ে।’’

ভারতীয় ক্রিকেট চাইবে, পুরনো জুটির মতো এক জন কিংবদন্তি হয়ে উঠলে অন্য জন যেন হারিয়ে না যান। প্রার্থনা করবে, নতুন প্রজন্মের সচিন-কাম্বলি বাইশ গজে দীর্ঘজীবী হোন!

Test Cricket Border Gavaskar Trophy 2018 India Australia Mayank Agarwal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy