Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
স্বর্ণযুগকে মনে করিয়ে হাউসফুল কলকাতা লিগ, গলা ফাটাচ্ছেন মহিলারাও

গানের আসর আর গোলের মালায় ভিড় ফিরল ফুটবলে

দুই প্রধানের মাঠে গেলে এ রকম আবেগের খোঁজ পাওয়া যায় অজস্র। কিন্তু বিদেশি ফুটবলের ঢঙে ময়দানে হঠাৎ-ই যে ঢুকে পড়েছে এক নব্য গান-সংস্কৃতি। যার জেরে গ্যালারি মানেই বিশ্রী খিস্তি-খেউর, ইট, জলের বোতল ছোঁড়া- এই ধারণা বদলে যাচ্ছে ক্রমশ।

হাউসফুল: এ বারের স্থানীয় ফুটবলের ভরা গ্যালারির ছবি। ইস্টবেঙ্গল হোক কী মোহনবাগান, দুই প্রধানের মাঠে উপচে পড়া ভিড়। ফাইল চিত্র

হাউসফুল: এ বারের স্থানীয় ফুটবলের ভরা গ্যালারির ছবি। ইস্টবেঙ্গল হোক কী মোহনবাগান, দুই প্রধানের মাঠে উপচে পড়া ভিড়। ফাইল চিত্র

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০২:২৪
Share: Save:

লেসলি ক্লডিয়াস সরণী দিয়ে জোরে হাঁটতে থাকা স্ত্রী-কে রীতিমতো ধমকাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। ‘‘একটা শাড়ি বাছতে আধ ঘণ্টা! কোন শাড়িটা পরে মাঠে আসবে রাতে ঠিক করে রাখতে পার না? টিকিট পাব কি না কে জানে?’’ গড়িয়ার রাস্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার ওই কর্মীর স্ত্রী মৃদু ভাবে বললেন, ‘‘কী করব! চারটে লাল-হলুদ শাড়ি। আগের পাঁচ গোলের ম্যাচটায় কোনটা পরে এসেছিলাম মনে করতে পারছিলাম না। সেটা খুঁজতে গিয়েই দেরি।’’ সঙ্গী স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন গৌতম মুখোপাধ্যায়। গত চৌদ্দ বছর যিনি এভাবেই খেলা দেখছেন।

দুই প্রধানের মাঠে গেলে এ রকম আবেগের খোঁজ পাওয়া যায় অজস্র। কিন্তু বিদেশি ফুটবলের ঢঙে ময়দানে হঠাৎ-ই যে ঢুকে পড়েছে এক নব্য গান-সংস্কৃতি। যার জেরে গ্যালারি মানেই বিশ্রী খিস্তি-খেউর, ইট, জলের বোতল ছোঁড়া- এই ধারণা বদলে যাচ্ছে ক্রমশ। অপেশাদার ক্লাব কর্তারা আলাদা বাথরুম-সহ ন্যুনতম স্বাচ্ছন্দের ব্যবস্থা করেননি। তা সত্ত্বেও প্রচুর মহিলা-দর্শক মাঠে আসছেন। স্বামী-প্রেমিক-বন্ধুর হাত ধরে। সত্তর-আশি-নব্বইয়ের স্মৃতি উসকে এ বার কলকাতা লিগে উপচে পড়ছে দর্শক। দুই মাঠেই। মোহনবাগানের বাইশ হাজারের বা ইস্টবেঙ্গলের উনিশ হাজারের গ্যালারি—কানায় কানায় পূর্ণ। টিকিট কাউন্টারে সর্পিল লাইন, ঘোড়সওয়ার পুলিশের দৌড়োদৌড়ি। এসব তো হারিয়েই গিয়েছিল গত দেড় দশক। মহমেডান ময়দানে খেললে ষোলোকলা পূর্ণ হত। প্রাক্তন ফুটবলার বা কর্তারা সবাই একমত তিন প্রধান জিতছে এবং প্রচুর গোল করছে বলেই সমর্থকরা ফের ময়দানমুখী। শুক্রবার পর্যন্ত তিন প্রধান ১৩ ম্যাচে ৪৫ গোল করেছে। যা অবিশ্বাস্য। গড় এ বার সাড়ে তিনের কাছাকাছি। তিন প্রধানই গড়ে তিন থেকে পাঁচ গোল করেছে প্রতি ম্যাচে। গত বছর এগারো দলের পুরো লিগে হয়েছিল ৫৫ ম্যাচ। গোল হয়েছিল ১৩৮। গড় ছিল ২.৫০। ফারাকটা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। মাঠ ভর্তি করে এসে যা চেটেপুটে দেখছেন সমর্থকরা।

আরও পড়ুন: ধোনির অর্ধেকও এখনও শেষ হয়নি, হুঁশিয়ারি শাস্ত্রীর

ইস্টবেঙ্গল মাঠে ম্যাচ শুরুর অনেক আগেই শুরু হয়ে যাচ্ছে গান। এঁরা ‘লাল-হলুদ আলট্রাস’। সায়ন সরকার নামে একজন হ্যান্ড মাইকে নিয়ে সুর তুলে ছেড়ে দিচ্ছেন, ‘ও-ও, ই-স্ট-বে-ঙ্গ-ল’। পরক্ষণে তাতে হাজারো গলা মিলছে, ‘‘এ-গি-য়ে চলো, আমরা তোমার সাথে আছি।’’ ম্যাচের সময় টিম গোল করলেও গান গাইতে থাকেন ওঁরা, পিছিয়ে পড়লে সাহস জোগান। কথা বলে জানা গেল, জার্মানির বরুসিয়া ডর্টমুন্ড বা গালাতাসারের গ্যালারির উচ্ছ্বাসকে প্রিয় ক্লাবে আনতে চান ওঁরা।

পরিবর্তন: কোনও মাঠেই মহিলাদের জন্য নেই সুব্যবস্থা। কর্তারা ভেবেও দেখেন না। তবু ফুটবল মাঠে আসছেন বাংলার মেয়েরা। কলকাতা ফুটবল লিগে প্রিয় ক্লাবের জন্য তাঁদের গলা ফাটাতেও দেখা যাচ্ছে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

ইডেনের দিক থেকে মোহনবাগান মাঠকে রাতের আলোয় মায়াবি মনে হয়। সেখান থেকেও প্রতি ম্যাচের আগে ভেসে আসে গান, ‘আমাদের সূর্য মেরুন, নাড়ির যোগ সবুজ ঘাসে,’ অথবা ‘সবুজ-মেরুন, সবুজ-মেরুন, পালতোলা নৌকা ছুঁটছে দারুন’। মাইক নিয়ে শুরুটা করেন কোলাঘাটের এক প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক শুভজিৎ সরকার। তাঁর সঙ্গে গলা মেলে কয়েক হাজার। এঁরা ‘মেরিনার্স বেস ক্যাম্প’-এর সদস্য। যাঁদের থিম, ‘গ্যালারি মুভমেন্ট’।

গানের সঙ্গে ওড়ে লাল বা সবুজ আবির। তুবড়ির মতো ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায় আকাশের দিকে। সে দিন মোহনবাগান মাঠে উড়ল হিন্দু, মুসলিম, শিখ আর ক্রিশ্চানদের ধর্মীয় প্রতীক আঁকা পতাকা। গঙ্গাপাড়ের ক্লাবে সবাই স্বাগত বোঝাতেই এই উদ্যোগ। ইস্টবেঙ্গল মাঠ দেখা গেল, মুহূর্তে গ্যলারির চেহারা হয়ে যাচ্ছে বাড়ির মেঝের মোজাইকের মতো, যাঁর রং লাল-হলুদ। লাল-হলুদ বিশ্ব বা স্বপ্নের মোহন তরীর মতো প্রচুর ফ্যান ক্লাব আছে দুই প্রধানের। তারা নানা সামাজিক কাজ করে। গ্যালারির গানের দল ‘আলট্রাস’ বা ‘বেস ক্যাম্পে’-এর সঙ্গে তাদের কাজের কোনও মিল নেই। এঁরা গ্যালারিতে গান গায়। উৎসব করে নানা কায়দায়। নানা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ রাখে নিজেদের মধ্যে।

‘‘অমল দা-র (দত্ত) ডায়মন্ড সিস্টেমের সময় যে ভিড়টা হতো সেটাই তো দেখছি এখন। মাঠে যত লোক, বাইরে তত। দশ টাকার টিকিট একশো টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমাদের খেলার সময় এটা হত,’’ বলছিলেন সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সবুজ-মেরুন জার্সিতে সারা জীবন খেলা সত্যজিতের আরও মন্তব্য, ‘‘খেলাটা ভাল হচ্ছে। প্রচুর গোল হচ্ছে বলেই এত ভিড়। মোহনবাগান মাঠে রাতে ম্যাচ হওয়ায় বেশি ভিড় হচ্ছে অন্য মাঠের তুলনায়। ’’

শত্রু শিবিরের সত্যজিতের সঙ্গে একমত মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যও। ‘‘ময়দানে ফুটবল হলে কী হয় সেটা বোঝা যাচ্ছে। বহুদিন মাঠে এত ভিড় দেখিনি। সাত-আট-নয়ের দশকের এরকম ভিড় হতো। দারুণ লাগছে গ্যালারির দৃশ্য। গান করছে। পিছিয়ে পড়লেও উৎসাহ দিচ্ছে। গালাগালি করছে না। সব চেয়ে বড় কথা গোল দেখতে মাঠে আসে সবাই। সেটা হচ্ছে প্রচুর। খোঁজ নিয়ে দেখলাম অনেক বছর তিন প্রধান একসঙ্গে এত গোল করেনি। এভাবে টানা ম্যাচ জেতেনি।’’ বলছিলেন আই লিগ জেতা কোচ। কেন হঠাৎ এই আগ্রহ? ‘‘আইএসএল আর আই লিগের ঝামেলাটা ভাল ভাবে নেননি সমর্থকরা। তারা যে প্রিয় ক্লাবের পাশে, সেটা দেখাতে চাইছেন মাঠে এসে। ক্লাব নিয়ে আবেগটা কাজ করছে।’’ ব্যাখ্যা দিলেন দু’দশকের বেশি ময়দান কাঁপানো ডিফেন্ডার।

গান আছে। আছে আবির। ফিরে এসেছে সেই আবেগ। ফুটবল জ্বরে ফের আক্রান্ত ময়দান। মনে হচ্ছে কলকাতা ফুটবলের যেন পুর্নজন্ম ঘটেছে এ বার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE