আইপিএলে অশ্বিনের মাঁকড়ীয় ভঙ্গিতে আউট করা দেখতে পারেননি। ক্রিকেটের দায়িত্ব থেকে ছুটি নিয়ে কয়েক দিন ধরে নানা দেশে সফর করছিলেন। এই মুহূর্তে কয়েক দিনের জন্য এসেছেন ভারতে।
কিন্তু কোর্টনি অ্যান্ড্রু ওয়ালশের কোনও রিপিট টেলিকাস্ট বা ভিডিয়ো দেখার দরকার নেই। তিনি এখনও বলে দিচ্ছেন, ‘‘খেলায় সবার উপরে থাকবে খেলোয়াড়ি মনোভাব। এখনও ক্রিকেট খেললে আমি সেই খেলোয়াড়ি মনোভাব দেখিয়েই খেলতাম। এর কোনও নড়চড় হতে দিতাম না।’’
যদি কেউ ভুলে গিয়ে থাকেন, তবে মনে করিয়ে দেওয়া যাক। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে পাকিস্তানে ইমরান খানের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ ওভারের শেষ বলে অশ্বিনের মতোই মাঁকড়ীয় ভঙ্গিতে আউট করার সুযোগ পেয়েছিলেন ওয়ালশ। মাঁকড়ীয় ভঙ্গি হচ্ছে, বোলার বল করতে গিয়ে যদি দেখে নন-স্ট্রাইকার প্রান্তের ব্যাটসম্যান ক্রিজ ছেড়ে এগিয়ে গিয়েছে, তা হলে তাকে রান আউট করে দিতে পারে। এমন আউট আইনসিদ্ধ হলেও খেলোয়াড়ি মনোভাবের বিরোধী বলে মত রয়েছে। আউটের ভঙ্গির নাম মাঁকড়ীয় কারণ ১৯৪৭ সালে অস্ট্রেলিয়াতে ভারতের প্রয়াত অলরাউন্ডার বিনু মাঁকড় এ রকম আউট করেছিলেন। সেটাই এমন রান আউটের প্রথম উদাহরণ।
ওয়ালশ সুযোগ পেয়েও ঠিক এই আউটটা করতে চাননি এবং সেটাও বিশ্বকাপের মতো সেরা প্রতিযোগিতায়। এবং কোন রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে? না, শেষ বলে জিততে পাকিস্তানের দরকার ২ রান। তাঁর হাতে বল। ব্যাট করছেন আব্দুল কাদির। ওভারের চতুর্থ বলে ছক্কা মেরে দিয়েছিলেন কাদির। পঞ্চম বলে কাদির এবং সেলিম জাফর আরও ২ রান নেন। লাহৌরের গদ্দাফিতে গোটা গ্যালারি চাইছে পাকিস্তানের জয়।
সে রকম একটা আবহে শেষ বলটা করার ঠিক আগের মুহূর্তে ওয়ালশ দেখলেন, নন-স্ট্রাইকার সেলিম জাফর ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলটা না করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সেটাই ছিল পাকিস্তানের শেষ উইকেট এবং মাঁকড়ীয় ভঙ্গিতে জাফরকে রান আউট করে দিলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে যায়। ওয়ালশ তা করতে চাননি। ফিরে গেলেন রান-আপে। শেষ বলটা আবার দৌড়ে এসে করলেন এবং প্রয়োজনীয় রান তুলে নিয়ে জিতে যায় পাকিস্তান। ওই হারের ফলে ১৯৮৭ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেমিফাইনালে যাওয়াই কার্যত আটকে গেল।
বত্রিশ বছর পরে ক্রিকেট অনেক পাল্টে গিয়েছে। পাল্টায়নি ওয়ালশের দর্শন। রবিবারও তিনি ফোনে আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘এখনও এতটুকু আক্ষেপ নেই। বরাবর বিশ্বাস করেছি, অসৎ ভাবে বা অখেলোয়াড়ি মনোভাব দেখিয়ে খেলার মাঠে জয় করা যায় না। এখনও তাই মনে করি।’’ তার পরেই যোগ করলেন, ‘‘লাহৌরে সে দিন শেষ বলে সেলিম জাফরকে রান আউট করিনি বলে অনুশোচনা হয় না। এখনও মনে করি, ঠিক কাজ করেছিলাম।’’ তাঁর দর্শন— ‘‘জেতার জন্য খেলব তবে খেলোয়াড়ি মনোভাব বিসর্জন দিয়ে নয়।’’
ওয়ালশ কৃতজ্ঞ তাঁর অধিনায়ক ভিভিয়ান রিচার্ডসের কাছেও। সেই বিশ্বকাপে ভিভই ছিলেন তাঁদের নেতা। আউট করার সুযোগ পেয়েও তা না করায় ম্যাচ হারার জন্য অধিনায়কের উষ্মার সামনে পড়তে পারতেন। কিন্তু ভিভ তাঁকে কিছুই বলেননি। ‘‘ড্রেসিংরুমে ফেরার পরে বিষণ্ণ ছিলাম। আমিই শেষ ওভারটা করছিলাম। ম্যাচটা হেরে গেলাম। তার উপর এই ঘটনা। কিন্তু অধিনায়ক পিঠে হাত রেখে সমর্থন করায় খুব শান্তি পেয়েছিলাম। গোটা টিম আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল সে দিন।’’ এটাই ছিল পুরনো আমলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যারা নির্মম ছিল, চার আগুনে ফাস্ট বোলার নিয়ে ব্যাটসম্যানকে আক্রমণ করে গিয়েছে, কিন্তু কখনও ক্রিকেটীয় সহবত হারায়নি।
সেই ওয়ালশকেই দেখতে হয়েছিল, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তরুণ ক্রিকেটার মাঁকড়ীয় আউট করছেন। জীবনের সব চেয়ে দুঃখের দিন ছিল সেটা। খুব ব্যথিত হয়েছিলেন দেখে যে, ‘‘এত অল্প বয়স থেকে কী ভাবে খেলোয়াড়ি মনোভাব বিসর্জন দিয়েও জিততে বুক কাঁপছে না আমার দেশের ছেলেদের।’’ তিন বছর আগে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ওয়ালশের দেশের কিমো পল মাঁকড়ীয় ভঙ্গিতে আউট করে দেন জ়িম্বাবোয়ের শেষ ব্যাটসম্যানকে। সেই শেষ ওভারে জ়িম্বাবোয়ের জেতার জন্য দরকার ছিল তিন রান। মাঁকড়ীয় ভঙ্গিতে আউট করে ম্যাচ জিতে শেষ আটে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
জস বাটলারকে মাঁকড়ীয় ভঙ্গিতে অশ্বিনের আউট করা কি দেখলেন? জিজ্ঞেস করায় ওয়ালশ বললেন, ‘‘আমি দেখতে পারিনি ট্র্যাভেল করছিলাম বলে। তবে অন্যদের মুখে শুনেছি খুব বিতর্ক হয়েছে এটা নিয়ে।’’ কেউ কেউ অশ্বিনের পাশেও দাঁড়াচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, এমন আউট ক্রিকেট আইনের বহির্ভূত নয়। ব্যাটসম্যানই বা কেন অন্যায় সুবিধে নেবে ক্রিজ থেকে বেরিয়ে গিয়ে? তবে অনেকের পাল্টা বক্তব্য, অন্তত এক বার সাবধান না করে এই ধরনের আউট করলে তা অখেলোয়াড়ি মনোভাবেরই প্রকাশ হয়ে দাঁড়ায়। ওয়ালশ যেমন বিশ্বকাপের শেষ বলেও জাফরকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আউট করেননি।
অশ্বিনের নাম করে কিছু বলতে চাইলেন না। শান্ত গলায় বলে দিলেন, ‘‘আমি খেলোয়াড়ি মনোভাব নিয়েই ক্রিকেট মাঠে খেলার চেষ্টা করেছি। সেটাই দেখতে চাইব।’’ সেই চিরাচরিত কোর্টনি ‘জেন্টলম্যান’ ওয়ালশ। শান্ত অথচ দৃপ্ত। খেলার মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর সৌজন্যকে তাঁর মতো সুন্দর ভাবে আর কেউ মেশাতে পারেনি যে!