ক্রিস ওকসের বল কভারে মেরে দৌড়ানোর সময় এক বার মুষ্টিবদ্ধ হাতে চিৎকার করলেন। তার পর হেলমেট খুললেন শুভমন গিল। সকলে ভেবেছিলেন, দেখা যাবে সেই পরিচিত উল্লাস। শতরানের পর হেলমেট খুলে দর্শকদের দিকে ‘বাও’ (মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন) করবেন শুভমন। কিন্তু কোথায় কী? এই প্রথম সেই পরিচিত উল্লাস দেখা গেল না। প্রথমে ব্যাট উঁচিয়ে ধরলেন। তার পর ব্যাটে চুমু খেলেন। সব শেষে চোখ বন্ধ করে ব্যাট আকাশের দিকে তুলে ধরলেন। উপরওয়ালাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন শুধু। মুখে হাসি নেই। শতরানের উল্লাস নেই। দেখে বোঝা যাচ্ছে, এই ইনিংস খেলতে নামার আগে কতটা চাপে ছিলেন তিনি। সেই চাপের মুখে এই শতরান বাকি সব শতরানের থেকে আলাদা। বুঝিয়ে দিলেন শুভমন। তবে চাপ কি পুরোটা কাটল? আউট হওয়ার পর যে ভাবে মাথা নিচু করে তিনি ফিরে গেলেন, তাতে বোঝা গেল এখনও চাপেই রয়েছেন ভারত অধিনায়ক।
অধিনায়ক হিসাবে প্রথম টেস্ট সিরিজ়। ব্যাটে রান থাকলেও জিততে পারছিল না দল। দুটো ম্যাচে জয়ের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। এই টেস্ট হারলেই সিরিজ় হারতে হবে। মাত্র চার টেস্টেই তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। জল্পনা ছড়াচ্ছে যে কোচ গৌতম গম্ভীরের চাপে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না শুভমন। শেষ তিন ইনিংসে রান না থাকায় চাপ আরও বেড়েছিল শুভমনের উপর।
শতরানের পর ব্যাটে চুমু খাওয়ার আগে শুভমন গিল। ছবি: পিটিআই।
এই পাহাড়প্রমাণ চাপের মুখে শনিবার তিনি যখন ব্যাট করতে নামলেন তখন ভারতের স্কোর শূন্য রানে ২ উইকেট। ৩১১ রান পিছিয়ে থেকে নেমে প্রথম ওভারেই ফিরে গিয়েছেন যশস্বী জয়সওয়াল ও সাই সুদর্শন। ইনিংসের ব্যবধানে ম্যাচ ও সেইসঙ্গে সিরিজ় হারের ভ্রুকুটি। কিন্তু এই শুভমন যেন অন্য ধাতুতে গড়া। অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর দায়বদ্ধতা আরও বেড়েছে তাঁর। তাড়াহুড়ো করলেন না শুভমন। লোকেশ রাহুলের সঙ্গে জুটি বাঁধলেন। সেই জুটি চতুর্থ দিন দুটো সেশন খেলে দিল। দিনের শেষে যখন শুভমন ও রাহুল মাঠ ছাড়ছেন তখন নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন ভারতীয় সমর্থকেরা।
তবে লড়াই তখনও কঠিন ছিল। কারণ, আরও একটা দিনের খেলা বাকি। রবিবার সকালে বৃষ্টি হয়েছে ম্যাঞ্চেস্টারে। ফলে সারা দিন আবহাওয়া মেঘলা থাকবে। তার উপর দিনের প্রথম স্পেলেই রাহুলকে আউট করে দিয়েছেন বেন স্টোকস। ফলে শুভমনের দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছিল। সেই দায়িত্ব সামলানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। ধৈর্য ধরে খেলেছেন। উইকেট কামড়ে পড়ে থেকেছেন। শতরান করেছেন। তাঁর এই শতরান জবাব সেই সমালোচকদের, যাঁরা বলেছিলেন, চাপের মুখে তিনি রান করতে পারেন না। শুভমন দেখিয়েছেন, দলের প্রয়োজনে নিজের স্বাভাবিক আক্রমণাত্মক খেলা বদলে ফেলতে পারেন তিনি।
তবে শতরানের পর বেশি ক্ষণ খেলতে পারেননি ভারত অধিনায়ক। জফ্রা আর্চারের একটা বাইরের দিকে যাওয়া বলে খোঁচা মারতে গিয়ে আউট হয়েছেন। গোটা ইনিংস জুড়ে অফ স্টাম্পের বাইরের অনেক বল তিনি ছেড়েছেন। কিন্তু শতরানের পর তা মারার লোভ সামলাতে পারেননি। এর আগেও তাঁর ক্যাচ দু’বার পড়েছে। এক বার লিয়াম ডসন ও এক বার ওলি পোপের হাত থেকে ক্যাচ পড়েছে। তৃতীয় বার আর সুযোগ পাননি শুভমন। তিনি আউট হওয়ার পর গোটা ম্যাঞ্চেস্টারের গ্যালারি উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছে। কিন্তু শুভমন সে দিকে তাকাননি। মাথা নিচু করে তিনি ফিরে গিয়েছেন সাজঘরে। তাঁকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, নিজের পায়েই কুড়ুল মেরেছেন। মনে মনে ভাবছিলেন, আর্চারের বলটা ছাড়তে পারতেন। আর কয়েক মিনিট পরেই মধ্যাহ্নভোজের বিরতি হত। তা হলে আবার নামতে পারতেন। মুহূর্তের ভুল ফিরতে হয়েছে তাঁকে। মনের মধ্যে আবার বাসা বেঁধেছে হারের আশঙ্কা। যে আশঙ্কা অনেকটাই কমিয়ছিলেন তিনি। শুভমন ফিরতেই আবার তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন:
শুভমন আউট হওয়ার পর ধারাভাষ্যকারেরা তাঁর ইনিংসের প্রশংসা করছিলেন। তাঁর লড়াইয়ের প্রশংসা করছিলেন। কিন্তু শুভমনের ইনিংস দেখলে বোঝা যাবে, বার বার সমস্যা হয়েছে তাঁর। ম্যাঞ্চেস্টারের এই উইকেটে ব্যাটারদের সবচেয়ে সমস্যায় ফেলেছে অসমান বাউন্স। যেখানে বল পড়ে বুকের উচ্চতায় উঠছে, সেখানেই বল পড়ে হাঁটুর নীচে আসছে। এই অসমান বাউন্স সবচেয়ে ভাল কাজে লাগিয়েছেন স্টোকস। ডানহাতি শুভমন ও রাহুলের জন্য তিনি একটা কোণ তৈরি করেছেন। পাশাপাশি সিমে বল ফেলেননি স্টোকস। ফলে তাঁর কোন বল লাফাবে, আর কোন বল বসবে তা বোঝা মুশকিল হচ্ছিল। সেই ফাঁদেই আউট হয়েছেন রাহুল। সমস্যায় পড়েছেন শুভমনও।
ইংরেজ পেসারদের বেশ কিছু বল শুভমনের ব্যাট ঘেঁষে বেরিয়েছে। অফ স্টাম্পের বাইরে জোরালো শট খেলতে গিয়ে কয়েক বার হাওয়ায় খেলেছেন তিনি। তাঁর ভাগ্য ভাল যে দু’বার ক্যাচ পড়েছে। ইংল্যান্ডের ফিল্ডিংয়ের যা মান, তাতে এই সুযোগ সকলে পান না। রবিবার ভারত অধিনায়ককে সবচেয়ে সমস্যায় ফেলেছেন ইংরেজ অধিনায়ক। স্টোকসের একটা বল লাফিয়ে তাঁর ডান হাতের আঙুলে লেগেছে। তার পর সেই বল গিয়ে লেগেছে হেলমেটে। যন্ত্রণায় কাতরেছেন তিনি। ফিজিয়োর চিকিৎসার পরেও দেখা যাচ্ছিল, গ্লাভস পরতে কষ্ট হচ্ছে। সেই অবস্থাতেও খেলেছেন তিনি। সামনের পায়ে ডিফেন্স করেছেন। ভয় পাননি। একের পর এক গোলা সামলে শতরান করেছেন। এই সিরিজ়ে এর আগে আরও তিনটে শতরান করেছেন শুভমন। তার মধ্যে একটা দ্বিশতরান। কিন্তু তার থেকে এই শতরানের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ, এই ইনিংসের পরিস্থিতি আলাদা, গুরুত্ব আলাদা। টেস্ট বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমেছিলেন তিনি। নিজের সবটা দিয়ে লড়েছেন ভারত অধিনায়ক।
২৩৮ বলে ১০৩ রান করে শুভমন যখন ফিরছেন, তখন তাঁর চোখে-মুখে হতাশা। কারণ, তিনি জানেন, লড়াই শেষ করতে পারেননি। তিনি জানেন, এই পিচে আরও দুটো সেশন খেলা সহজ নয়। জানেন, তিনি আউট হওয়ায় ইংল্যান্ড আবার জয়ের গন্ধ পেতে শুরু করেছে। ভারত এই টেস্ট বাঁচাতে পারবে কি না, তার জবাব পরের কয়েক ঘণ্টায় পাওয়া যাবে। কিন্তু শুভমনের এই ইনিংস জবাব দিয়েছে অনেক সমালোচনার। কতটা চাপের মুখে তিনি খেলতে নেমেছিলেন, তার প্রমাণ দিয়েছে শতরানের পর শুভমনের উচ্ছ্বাসহীন মুখ।