ক্রিকেটার হিসেবে দেশের জার্সি গায়ে ওঠেনি। কোচ হিসেবে মাথায় বসল বিশ্বসেরার তাজ। ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের পরে শিশুর মতো মাঠে লুটিয়ে পড়লেন। অপ্রাপ্তির আঁধার থেকে বিশ্বকাপ জয়ের উৎসবে গা ভাসালেন। রোহিত শর্মার ভঙ্গিতে জাতীয় পতাকা গাঁথেন পিচে। তিনি— অমল মুজুমদার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১১ হাজারের বেশি রান করেও অবহেলিত। কোচ হিসেবে প্রথম কিস্তিতেই বাজিমাত। বিশ্বকাপ জিতে আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন হরমনপ্রীত কৌরদের কোচ।
প্রশ্ন: ক্রিকেটার হিসেবে ভারতীয় দলে খেলার সুযোগ হয়নি। ১১ হাজারের উপরে রান করেও দরজা খোলেনি জাতীয় দলের। এ বার কোচ হয়ে বিশ্বকাপ জয়। আক্ষেপ কি মিটল?
অমল মুজুমদার: আক্ষেপ ছিলই না। ভারতীয় দলে সুযোগ না পেলেও মুম্বইয়ের হয়ে আটটি রঞ্জি ট্রফি জিতেছি। বিশ্বকাপ জয়ের মতো প্রাপ্তি আর কিছুতে কি হতে পারে? তাও আবার ঘরের মাঠে নিজের শহর মুম্বইয়ে। সত্যি বলতে বলার কোনও ভাষা নেই। অনেক অপ্রাপ্তি মিটিয়ে দিল এই বিশ্বকাপ জয়।
প্রশ্ন: অধিনায়ক হিসেবে রঞ্জি ট্রফি জয়। কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়। অমল মুজুমদার কি জানতেন তাঁর ভাগ্যের চাকা এই ভাবে ঘুরতে চলেছে?
অমল: অধিনায়ক হিসেবে রঞ্জি জয়ের গুরুত্বও কম নয়। তবে বিশ্বকাপ জয়ের ধারে কাছে আসে না। ভাগ্যের চাকা ঘুরবে কি না, জানতাম না। কাজের প্রতি সৎ ছিলাম। ভারতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনও ছুটি নিইনি। বাড়িতে থাকলেও দলের উন্নতির জন্য কাজ করে গিয়েছি। নতুন নতুন পরিকল্পনা সাজিয়েছি। কোন ক্রিকেটারের কী প্রয়োজন, কোথায় অসুবিধা হচ্ছে, সব জানতে চেয়েছি। বিশ্বকাপ তো এক দিনে আসে না। এর পেছনে অনেকের অবদান রয়েছে। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফল। এই যে সকলের মুখে হাসি দেখছেন, এত উৎসব দেখছেন, এটা পাওয়ার জন্য অনেক চোখের জল ফেলতে হয়েছে।
প্রশ্ন: বিশ্বকাপ জয়ের নেপথ্যে কাদের অবদান সব চেয়ে বেশি?
অমল: প্রত্যেকের! কোনও এক জনের অবদানকে বড় করে দেখতে চাই না। প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে বোঝাপড়াই আমাদের শক্তি। ঐক্যবদ্ধ দল গড়তে পেরেছি। তবে হরমনপ্রীতের নেতৃত্বের ধরন অন্য রকম। সকলের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। স্মৃতি মন্ধানার ধারাবাহিকতাও এই দলের জন্য খুব জরুরি ছিল। প্রতীকা এবং ওর ওপেনিং জুটি ভয়ডরহীন ক্রিকেট উপহার দিয়েছে। নক-আউটের আগে প্রতীকা চোট পাওয়ার পরেও আমরা কেউ ভয় পেয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিইনি। জেমিমা রডরিগ্স শুরুর দিকে ছন্দে ছিল না। একটি ম্যাচে ওকে আমরা দলে নিতে পারিনি। সেমিফাইনালে ওর ইনিংসের পরেই মন বলছিল কাপ আসতে চলেছে। ব্যাট ও বলে দীপ্তির দাপট কখনও ভোলা সম্ভব নয়। আর রিচা তো রয়েইছে। ইংল্যান্ড ম্যাচ ছাড়া প্রত্যেক ম্যাচে শেষের দিকে বিধ্বংসী ইনিংস খেলেছে। প্রত্যেকে ওর উপরে ভরসা করত। রান কম উঠলেও কেউ ভয় পেত না। জানত, রিচা আছে। বাঁ-হাতি স্পিনার শ্রী চরণী ক’দিনই বা ক্রিকেট খেলছে? কিন্তু ওর ১০টি ওভার আমাদের কাছে মুক্তোর মতো ছিল। রেণুকা সিংহ, অমনজ্যোত, ক্রান্তি প্রত্যেকে এই দলটির শক্তি।
প্রশ্ন: আর শেফালি বর্মা? তিনিই তো ফাইনালের নায়ক! শেফালির উপস্থিতি কতটা সাহায্য করল?
অমল: ওর হাতে জাদু আছে। কলকাতা নাইট রাইডার্স চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে রিঙ্কু সিংহ বলেছিল, ‘ঈশ্বরের পরিকল্পনা’। শেফালিও আমাদের কাছে সে রকমই অদ্ভুত এক চমক। ও এ রকমই ভয়ডরহীন ক্রিকেটার। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছে। বড় ম্যাচের চাপ ওকে ছুঁতে পারে না। রান পাওয়ার পরে ইনিংসের মাঝে হরমনপ্রীতকে বলেছিলাম শেফালিকে বোলিংও দিস। রান পেয়েছে, আত্মবিশ্বাস কাজে লাগতে পারে। দিনটি ওরই ছিল। প্রথম ওভারেই বড় উইকেট তুলে নিয়েছিল। একটি বিশ্বকাপ জিততে গেলে অনেক ছোট ছোট ঘটনা স্মৃতি হিসেবে থেকে যায়। শেফালিও সে রকমই এক অভাবনীয় স্মৃতি।
প্রশ্ন: হরমনপ্রীত শেষ ক্যাচটি নেওয়ার পরে কী রকম অনুভূতি হয়েছিল?
অমল: হাত-পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম পাঁচ মিনিট থরথর করে কেঁপেছি। দর্শকদের গর্জনে হারিয়ে গিয়েছিলাম। জীবনে বারবার তো এই মুহূর্ত আসে না। কী ভাবে এই জয় উদ্যাপন করব, জানতাম না। আমি খুব একটা আবেগে ভাসি না। কিন্তু তখন চোখের জল আটকে রাখতে পারিনি।
প্রশ্ন: এই বিশ্বকাপ জয় কি মেয়েদের ক্রিকেটকে আরও উন্নতিরপথ দেখাবে?
অমল: নবজাগরণ হল। এ বার থেকে আরও বেশি মেয়েরা ক্রিকেট খেলতে চাইবে। কেউ বাধা দিলেই উদাহরণ দেবে হরমনপ্রীতদের। এটাই তো দেখতে চেয়েছিলাম।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)