বিরাট কোহলি নেই। রোহিত শর্মা নেই। ভারতের টেস্ট দল এ বার নতুন যুগে পা রাখছে। দুই সিনিয়র ক্রিকেটারের পরামর্শ পাবেন না শুভমন গিল, লোকেশ রাহুল, জসপ্রীত বুমরাহেরা। যুগ পরিবর্তন শুরু হচ্ছে ২০২৫-২৭ টেস্ট বিশ্বকাপ চক্র দিয়েই। সামলাতে পারবে ভারতের তরুণ ব্রিগেড? যা দেখা যাচ্ছে আখেরে লাভ হবে ভারতীয় ক্রিকেটেরই।
পরিবর্ত হিসাবে কারা তৈরি
কোহলি এবং রোহিতের অনুপস্থিতি কি সমস্যায় ফেলবে গৌতম গম্ভীরের দলকে? বিশেষ করে ইংল্যান্ডের মাটিতে পাঁচ টেস্টের সিরিজ়ে কঠিন পরীক্ষা দিতে হতে পারে ভারতীয় দলকে। কোহলি-রোহিতের জায়গা নেওয়ার জন্য বেশ কয়েক জন তরুণ ভারতীয় ক্রিকেটার তৈরি। সাই সুদর্শন, অভিমন্যু ঈশ্বরণ, সরফরাজ় খান, নীতীশ কুমার রেড্ডি, দেবদত্ত পাড়িক্কাল, করুণ নায়ারের মতো ব্যাটারেরা আছেন। টেস্ট দলে অনিয়মিত হলেও শ্রেয়স আয়ারের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটার আছেন। উইকেটরক্ষক-ব্যাটার ধ্রুব জুরেল, ঈশান কিশনও আন্তর্জাতিক স্তরে পরীক্ষিত। যাঁরা বিশেষজ্ঞ ব্যাটার হিসাবেও স্বচ্ছন্দ। দু’টি জায়গার জন্য লড়াইয়ে আছেন সাত-আট জন ক্রিকেটার। প্রতিযোগিতা তীব্র। হালকা ভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।
কোহলির পারফরম্যান্স
শেষ কয়েক বছরে কোহলির টেস্ট পারফরম্যান্স কেমন ছিল দেখা যাক। ২০২১ সালে ১১টি টেস্ট খেলে করেন ৫৩৬ রান। গড় ২৮.২১। সর্বোচ্চ ৭২। অর্ধশতরান চারটি। ২০২২ সালে ছ’টি টেস্টে করেন ২৬৫ রান। গড় ২৬.৫০। সর্বোচ্চ ৭৯। অর্ধশতরান একটি। ২০২৩ সালে আটটি টেস্টে তাঁর সংগ্রহ ৬৭১ রান। গড় ৫৫.৯১। শতরান দু’টি। অর্ধশতরান দু’টি। ২০২৪ সালে কোহলি টেস্ট খেলেন ১০টি। করেন ৪১৭ রান। গড় ২৪.৫২। সর্বোচ্চ অপরাজিত ১০০। একটি করে শতরান এবং অর্ধশতরান করেন। ২০২৫ সালে একটি টেস্ট খেলে করেছেন ২৩ রান। গড় ১১.৫। সর্বোচ্চ ১৭। অর্থাৎ, ২০২৩ সাল ছাড়া কোনও পরিসংখ্যানই কোহলিসুলভ নয়।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
রোহিতের পারফরম্যান্স
এ বার দেখা যাক এই সময়ে রোহিতের পারফরম্যান্স কেমন ছিল টেস্ট ক্রিকেটে। ২০২১ সালে ১১টি টেস্টে করেন ৯০৬ রান। গড় ৪৭.৬৮। সর্বোচ্চ ১৬১। শতরান দু’টি। অর্ধশতরান চারটি। ২০২২ সালে দু’টি টেস্ট খেলে করেন ৯০ রান। গড় ৩০। সর্বোচ্চ ৪৬। ২০২৩ সালে রোহিত খেলেন আটটি টেস্ট। করেন ৫৪৫ রান। গড় ৪১.৯২। সর্বোচ্চ ১২০। দু’টি করে শতরান এবং অর্ধশতরান করেন। ২০২৪ সালে ১৪টি টেস্টে করেন ৬১৯ রান। গড় ২৪.৭৬। সর্বোচ্চ ১৩১। দু’টি করে শতরান এবং অর্ধশতরান করেছেন। ২০২৫ সালে কোনও টেস্ট খেলেননি। রোহিতের পারফরম্যান্স গ্রাফও ক্রমশ নেমেছে।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
গত বছর নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে তিন টেস্টের সিরিজ় এবং অস্ট্রেলিয়া সফরে পাঁচ টেস্টের সিরিজ়ে কোহলি এবং রোহিতের পারফরম্যান্স হতাশ করেছে ক্রিকেটপ্রেমীদের। বিক্ষিপ্ত ভাবে দু’-একটি ভাল ইনিংস খেললেও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি কেউ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হতাশ করেছেন। দলকে চাপে ফেলে দিয়েছেন। তাঁদের প্রথম একাদশ থেকে বাদ দেওয়ার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে। প্রাক্তন ক্রিকেটারদের একাংশও হতাশা লুকিয়ে রাখেননি দুই সিনিয়র ব্যাটারকে নিয়ে। বার বার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ কোহলি-রোহিতের পরিবর্তে তরুণ ক্রিকেটারদের সুযোগ দেওয়ার দাবি উঠেছে।
কোহলির খারাপ সময় পাশে দাঁড়িয়েছেন রোহিত। আবার রোহিত নিজের খারাপ সময়ে পাশে পেয়েছেন কোহলিকে। কেউই কারও ফর্মে না থাকাকে গুরুত্ব দিতে চাননি। দল থেকে বাদ দেওয়ার কথাও ভাবেননি কেউ। চেতেশ্বর পুজারা এবং অজিঙ্ক রাহানেকে যত সহজে ভারতীয় টেস্ট দল থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল, কোহলি-রোহিতের ক্ষেত্রে তা করা যায়নি। তবে ঠিক সময়ে সরে দাঁড়ালেন নিজেরাই।
বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, রোহিত এবং কোহলির মতো বড় মাপের ক্রিকেটারদের অভাব পূরণ হতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে ভারতীয় দলে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ডন ব্র্যাডম্যান থেকে সচিন তেন্ডুলকর সবাই অবসর নিয়েছেন। সকলকেই এক দিন না এক দিন অবসর নিতে হয়। এটাই নিয়ম। কিন্তু এই সব খেলোয়াড়ের অভাব পূরণ সহজে হয় না। তেমনই রোহিত, কোহলির অভাব পূরণ হতেও সময় লাগবে। অনেক ভাল তরুণ ক্রিকেটার রয়েছে আমাদের। কিন্তু অভিজ্ঞতা প্রয়োজন।’’
বাংলার আর এক প্রাক্তন ক্রিকেটার সৌরাশিস লাহিড়ি রোহিত-কোহলির অবসরকে স্বাভাবিক ভাবেই দেখতে চান। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই দু’জন নিজেদের এমন একটা উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, তাতে মানুষের প্রত্যাশা থাকেই। তবে সবাইকেই একটা সময় থামতে হয়। ওরাও চায় একটা নির্দিষ্ট মান ধরে রাখতে। দু’জনেই নিশ্চয়ই মনে করেছে, এটাই অবসর নেওয়ার সঠিক সময়। অবসরটা একদম ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে ওদের মাঠে থাকা আর না থাকার মধ্যে একটা পার্থক্য থাকবেই। যারা সুযোগ পাবে, তাদের কাজটাও সহজ হবে না।’’
ভারতীয় দলের প্রাক্তন কোচ রাহুল দ্রাবিড় দুই সিনিয়রকে বাদ দিয়ে দল গঠনের কথা ভাবেননি কখনও। গম্ভীর কড়া ধাঁচের মানুষ। গত অস্ট্রেলিয়া সফরে কোহলি একটি শতরান করায় এক রকম বেঁচে যান। কোপ পড়ে রোহিতের উপর। সে সময় অধিনায়কের সঙ্গে তীব্র মতান্তর হয় গম্ভীরের। সিরিজ়ের শেষ টেস্ট থেকে রোহিত নিজেকে সরিয়ে নেন। দল দেশে ফেরার পর গম্ভীরের পরামর্শ মেনে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড জানিয়ে দেয়, আন্তর্জাতিক সূচি না থাকলে জাতীয় দলের সব ক্রিকেটারের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা বাধ্যতামূলক। বোর্ডের কড়া অবস্থানের সামনে কোহলি ২০১২ সালের পর এবং রোহিত ২০১৪ সালের পর প্রথম রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ খেলতে বাধ্য হন। রঞ্জি ট্রফিতে ব্যর্থ হন দু’জনেই।
আইপিএলে কোহলি ভাল খেললেও রোহিতের বলার মতো পারফরম্যান্স তিনটি। কোহলি ১১টি ম্যাচে ৬৩.১৩ গড়ে ৫০৫ রান করেছেন। সাতটি অর্ধশতরান তাঁর। রোহিত ১১টি ম্যাচে ৩০ গড়ে ৩০০ রান করেছেন। তিনটি অর্ধশতরান রোহিতের। দু’জনেই গত বছর বিশ্বকাপ জয়ের পর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছেন। তা ছাড়া এই পারফরম্যান্স দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটকে বিচার করা যায় না।
লাল বলের ক্রিকেটে দিনের পর দিন প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছিলেন না কোহলি এবং রোহিত। অনেকটা অতীত সাফল্যের জোরে দলে জায়গা ধরে রাখছিলেন। আবার ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁদের এমন এক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, যে সরাসরি বাদ দেওয়াও যাচ্ছিল না। অথচ প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন তরুণ ক্রিকেটারেরা। এ বার সেই বাধা সরল। অন্তত পারফরম্যান্সের নিরিখে ভারতীয় দলের শক্তিক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা তেমন নেই। শুভমন, শ্রেয়স, রাহুল, বুমরাহদের অভিজ্ঞতা খুব কম নয়। চোট সারিয়ে ফিরে এসেছেন মহম্মদ শামি। থাকছেন রবীন্দ্র জাডেজা, অক্ষর পটেল, কুলদীপ যাদবও। টেস্ট ক্রিকেট থেকে কোহলি-রোহিতের অবসর ঘিরে ক্রিকেটপ্রেমীদের খারাপ লাগা থাকতে পারে। ব্যাটিং অর্ডারের ওপেনিংয়ে রোহিত আর চার নম্বরে কোহলি একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এ বার নতুন অভ্যাস তৈরির সময়। সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ, বীরেন্দ্র সহবাগের অবসরের পরও মানিয়ে নিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট। এ বারও নেবে। কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয়। লাভই হল ভারতীয় ক্রিকেটের।