E-Paper

হাল ছাড়িস না, আকাশকে ফোনে বার্তা মুকেশের

লর্ডসে ভারতের হারের পরে আকাশকে ফোনে সেই প্রাণশক্তিই দিয়েছেন বাংলার মুকেশ কুমার। ভারত ‘এ’-র হয়ে দু’জনেই ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলেন। আকাশকে রেখে দেওয়া হয় ভারতের মূল দলের সঙ্গে। মুকেশ ফিরে আসেন দেশে।

ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত 

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৫ ০৫:৫২
জুটি: ম্যাঞ্চেস্টার জয় করার শপথ সিরাজ, আকাশের।

জুটি: ম্যাঞ্চেস্টার জয় করার শপথ সিরাজ, আকাশের। —ফাইল চিত্র।

এজবাস্টনে ভারতের প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক হয়ে উঠেছিলেন দুই পেসার। আকাশ দীপ ও মহম্মদ সিরাজ। তাঁদের চোখে ছিল একটাই স্বপ্ন, লর্ডস জয় করার। কিন্তু স্টাম্পের দিকে গড়িয়ে আসা একটি বলের স্পর্শে আঁধার নেমেছিল ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে। আঘাত পেয়েছিলেন তাঁরাও। নীরব যোদ্ধার মতো যাঁরা চেষ্টা করে গিয়েছিলেন ভারতকে জেতাতে।

তাঁদেরই মধ্যে অন্যতম বাংলার আকাশ দীপ। এজবাস্টনে ১০ উইকেট পেলেও লর্ডসে তাঁর শিকার মাত্র একটি। আকাশের বলে সুইপ করতে গিয়ে স্টাম্প ছিটকে গিয়েছিল হ্যারি ব্রুকের। তাঁকে দ্রুত ফিরিয়ে ভারতের সামনে সহজ রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিলেন বাংলার পেসার। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ক্রিজ় কামড়ে পড়ে থেকেও ভারতকে জেতাতে পারেননি মহম্মদ সিরাজ ও রবীন্দ্র জাডেজা। সারা বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীরা যদিও তাঁদের অদম্য লড়াইকে বাহবা দিয়েছেন। তবুও প্রিয় বন্ধুর কাছ থেকে সাহস জোগানো বার্তা না পেলে কি আর স্বমেজাজেফেরা যায়?

লর্ডসে ভারতের হারের পরে আকাশকে ফোনে সেই প্রাণশক্তিই দিয়েছেন বাংলার মুকেশ কুমার। ভারত ‘এ’-র হয়ে দু’জনেই ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলেন। আকাশকে রেখে দেওয়া হয় ভারতের মূল দলের সঙ্গে। মুকেশ ফিরে আসেন দেশে। তা নিয়ে দু’জনের সম্পর্কে চিড় ধরেনি। বন্ধুর সাফল্যের পরেও যেমন অভিনন্দন জানিয়েছেন, তেমনই ব্যর্থতার দিনেও সাহস জুগিয়ে চলেছেন মুকেশ। বলছিলেন, ‘‘আকাশ জেতার জন্য মরিয়া হয়ে থাকে। তা যে কোনও ম্যাচই হোক। ক্লাব ক্রিকেট, ঘরোয়া ক্রিকেট অথবা টেস্ট। ওর একটাই লক্ষ্য, দলকে জেতানো। তাই ব্যর্থ হলেই আকাশের মন খারাপ হয়ে যায়।’’ যোগ করেন, ‘‘এজবাস্টনে ১০ উইকেট পাওয়ার পরে অনেকটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে লর্ডসে গিয়েছিল। প্রথম ইনিংসে উইকেট পায়নি। দ্বিতীয় ইনিংসেহ্যারি ব্রুককে আউট করেছিল। দলকে জেতাতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছিল। ওকে বোঝালাম, ভেঙে পড়ার কোনও কারণই নেই। উইকেট সব সময় ভাগ্যে থাকে না।’’

মুকেশ ব্যাখ্যা করেন, ‘‘আমাদের কাজ জায়গায় বল করে যাওয়া। ওকে সেটাই বোঝাই। ব্যাটসম্যান ভুল করবেই। ধৈর্য ধরে থাকতে হবে।’’ আরও বলেন, ‘‘ফোনে অনেক কথাই হয়েছে। ভাইয়ের (আকাশ) মন বড্ড খারাপ। বললাম, লন্ডনে ভারতীয় রেস্তরাঁয় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া কর। ভাল করে শহরটা ঘোর। আনন্দ কর। মাথা ঠান্ডা রেখে ক্রিকেটে ফের।’’

রাজ্য স্তর থেকে আকাশের সঙ্গে খেলছেন মুকেশ। ধীরে ধীরে বন্ধুকে উন্নতি করতে দেখেছেন। হঠাৎ কী ভাবে এত পরিবর্তন এল আকাশের মধ্যে? মুকেশ বলেন, ‘‘কোনও রকেট সায়েন্স নেই। নিয়মিত ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছে। অনুশীলনে কখনও অনীহা দেখতে পাইনি। চলতি প্রজন্মের পেসাররা প্রস্তুতিতে খুব একটা বল করতে চায় না। আকাশ কিন্তু টানা ছয়-সাত জন ব্যাটসম্যানকে বল করে। কোনও সমস্যা হলে আমাকে জিজ্ঞেস করে। যতটা সম্ভব আমিও বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।’’

চলতি ইংল্যান্ড সফরে কী পরামর্শ দিলেন বন্ধুকে? মুকেশের উত্তর, ‘‘ওখানে বোলিং কোচ আছেন। যশপ্রীত বুমরা আছেন। আমি কী আর বলব? শুধু বলেছি, হাল ছাড়িস না। ভাল থাকিস। আনন্দ করে খেল। দেশকে জিতিয়ে ফের। তোর জন্য আমরা এমনিতেই গর্বিত।’’

মুকেশের এই বার্তা নিঃসন্দেহে তরতাজা করে তুলবে আকাশকে। ম্যাঞ্চেস্টারের আবহাওয়া ঠান্ডা। পিচও এতটা শুষ্ক হবে না। পেসারদের সাফল্য পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

আকাশকে তরতাজা হতে সাহায্য করলেন মুকেশ। কিন্তু মহম্মদ সিরাজ কী ভাবে ভুলবেন, ব্যাটের মাঝখান দিয়ে ডিফেন্ড করেও বল গড়িয়ে গিয়ে স্টাম্পে লাগতে পারে? গাছ থেকে ফল ঝরে পড়ার মতোই আচমকা পড়ে যায় বেল। থমকে যান সিরাজ। অজান্তেই চোখের কোণ ভিজে যায় তাঁর। মাথা নিচু করে বসে পড়েছিলেন ভারতীয় পেসার। তাঁকে টেনে তোলেন জ়াক ক্রলি ও জো রুট।

হায়দরাবাদের ফার্স্ট ল্যান্সারের মাঠে সিরাজের দাদা ও বন্ধুরা একসঙ্গে বসে দেখছিলেন লর্ডস টেস্টে পঞ্চম দিনের খেলা। সিরাজ আউট হয়েছেন, বিশ্বাসই হচ্ছিল না তাঁর দাদার। প্রিয় বন্ধু মহম্মদ শাফি (সিরাজ ডাকেন শারু) বলছিলেন, ‘‘সত্যি ভাবিনি ও আউট হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল ইংল্যান্ড হয়তো মজা করছে। বেলটা যে শেষ মুহূর্তে পড়ে যাবে, কেউআশাই করেনি।’’

মঙ্গলবারই শাফিকে ভিডিয়ো কল করেছিলেন সিরাজ। কী বললেন তাঁর প্রিয় বন্ধু? শাফি বলছিলেন, ‘‘৩০ মিনিট কথা হল ওর সঙ্গে। প্রত্যেক বন্ধুর সঙ্গে ও কথা বলেছে। ওর মন খুব খারাপ। চেষ্টা করছিলাম ওর আউট নিয়ে কথা না বলতে কিন্তু ও নিজেই সেই প্রসঙ্গ টেনে আনল। চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি।’’ যোগ করেন, ‘‘সেই রাতে ও ডিনারও করেনি। রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। মন মেজাজ খুব খারাপ ছিল।’’

বন্ধুর মন ভাল করতে কী করলেন শাফি? তাঁর উত্তর, ‘‘আমাদের এখানে টেনিস বলের প্রতিযোগিতা চলছে। যে মাঠে সিরাজ খেলে বড় হয়েছে, সেখানেই আমরা খেলছি। ওকে ভিডিয়ো কলে রেখে আমাদের ম্যাচ দেখাচ্ছিলাম।’’ যোগ করেন, ‘‘ছোটবেলা থেকে এই মাঠেই আমাদের সঙ্গে খেলত। টেনিস বলের ক্রিকেটে ও কিন্তু অসাধারণ ব্যাটসম্যান। তিন বার ছয় ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ড আছে। রিভার্স সুইপেও ছক্কা হাঁকাতে পারে। আমাদের খেলা দেখিয়ে ওকে সেই দিনগুলোর কথা মনে করানোর চেষ্টা করছিলাম। কিছুটা মন ভাল হয়েছিল। আসলে ও দলকে জেতাতে না পারলে খুব ভেঙে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই খুব আবেগপ্রবণ ছেলে। ওকে শান্ত করার এটাই একমাত্র উপায় ছিল। হায়দরাবাদি বিরিয়ানি তো আর পাঠাতে পারতাম না। যতটা সম্ভব ওর মন ভাল করার চেষ্টা করেছি।’’

শেষ ম্যাচে জফ্রা আর্চারের একটি বাউন্সারে হাতে আঘাত পেয়েছিলেন সিরাজ। তাঁর বন্ধু জানিয়েছেন, ব্যথার জায়গায় কালশিটে পড়ে গিয়েছে। বরফ দিয়ে ফোলা ভাব কমাতে হয়েছে। বন্ধুকে কথা দিয়েছেন, ভারতকে সিরিজ় জিতিয়ে ফিরবেন। শাফি বলছিলেন, ‘‘এই হারের যন্ত্রণা ভোলাতে পারে ম্যাঞ্চেস্টারে জয়। ভারতের ক্রিকেটপ্রেমীদের সকলেই বদলার অপেক্ষায় আছেন। সিরাজ কথা দিয়েছে, পরের ম্যাচে হতাশ করবে না। গম্ভীর স্যর, বুমরা ভাই ওকে সান্ত্বনা দিয়েছে। ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস যুগিয়েছেন রবি শাস্ত্রী স্যর। ওর লড়াইয়ের সাক্ষী সারা বিশ্ব। দুর্ভাগ্যজনক একটি উইকেট সব লড়াইয়ে জল ঢেলে দিল।’’

সিরাজ বাড়ি ফিরলে কোথায় ঘুরতে যাবেন, ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছেন তাঁর বন্ধুরা। আরও এক বন্ধু আয়াজ় আয়ান বলছিলেন, ‘‘বিদেশ থেকে এলে প্রত্যেক বারই আমাদের শাদাব-এর বিরিয়ানি খাওয়াতে নিয়ে যায়। এ বারও সে রকমই পরিকল্পনা আছে। তবে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঘুরতে যাওয়ার। উত্তর ভারতের কোনও জায়গায় যাওয়া যেতে পারে। তবে সব কিছুই নির্ভর করছে ভারতের জয়ের উপরে। দেশ যদি হেরে যায়, ও আর কারও কথা শুনবে না। দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকবে।’’

ক্রিকেটারেরা মনে হয় এ রকম আবেগপ্রবণই হন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

India vs England 2025 India-England Test Series Mohammed Siraj Akash Deep Indian Cricket team Lords Test

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy