১৭ মে, ২০২৪। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে লখনউ সুপার জায়ান্টসের কাছে হারের পর চোখে জল নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন হার্দিক পাণ্ড্য। সে বারই নিজের পুরনো দলে ফিরেছিলেন তিনি। অধিনায়ক হয়েছিলেন। কিন্তু হার্দিক হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি, তাঁর দলের সমর্থকদের কাছে এ ভাবে বিদ্রুপের শিকার হতে হবে তাঁকে। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে হার্দিকের বিরুদ্ধে পোস্টার পড়েছিল। রোহিত শর্মাকে অধিনায়কত্ব থেকে সরানোর দায় নিতে হয়েছিল তাঁকে। তার উপর দলকে প্লে-অফে তুলতে পারেননি তিনি। সকলের নীচে শেষ করেছিল মুম্বই। সেই ব্যর্থতার দায়ও নিয়েছিলেন হার্দিকই।
২১ মে, ২০২৫। ৩৬৯ দিন পরে বদলে গেল ছবিটা। যে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে তিনি চোখের জল ফেলেছিলেন সেখানেই বীরের সম্মান পেলেন হার্দিক। দিল্লিকে হারিয়ে মুম্বইয়ের ক্রিকেটারের যখন উল্লাস করছেন, তখন হার্দিকের নামে জয়ধ্বনি উঠল ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। এত দিন ধরে এই আওয়াজটাই তো শুনতে চেয়েছিলেন তিনি। অবশেষে শুনলেন। চার বছরের ব্যর্থতা কাটিয়ে আরও এক বার প্লে-অফে উঠল মুম্বই। আরও এক বার ট্রফি জয়ের সুযোগ তাঁদের সামনে। নেতা হার্দিকের কাঁধেই সাফল্য এল পাঁচ বারের আইপিএল চ্যাম্পিয়নদের। ৩৬৯ দিন পর সেই ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামেই ‘শাপমুক্তি’ হল হার্দিকের। খেলা শেষে ওয়াংখেড়ের দর্শকদের হাতজোড় করে প্রণাম করলেন মুম্বইয়ের অধিনায়ক।
গত বার ব্যর্থ হওয়ার পর এ বার নিলাম কাজে লাগিয়েছে মুম্বই। কুইন্টন ডি’কক, ঈশান কিশন, টিম ডেভিড, জফ্রা আর্চারদের ছেড়ে দিয়ে রায়ান রিকেলটন, উইল জ্যাকস, ট্রেন্ট বোল্ট, দীপক চহরদের নিয়েছে তারা। দল নির্বাচনের ক্ষেত্রেও হার্দিকের ভূমিকা ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, প্রতিটি জায়গায় বিশেষজ্ঞদের নিতে। বিশেষ করে দলের বোলিং আক্রমণকে ঢেলে সাজিয়েছে মুম্বই। নতুন বলে বোল্ট ও চহর, মাঝের ওভারে মিচেল স্যান্টনার, কর্ণ শর্মা, জ্যাকসের স্পিন, ডেথ ওভারে জসপ্রীত বুমরাহ। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে ভেঙে পড়েছে একের পর এক ব্যাটিং আক্রমণ।
তার পরেও শুরুটা ভাল হয়নি মুম্বইয়ের। প্রথম পাঁচ ম্যাচে মাত্র একটি জিতেছিল মুম্বই। দেখে মনে হচ্ছিল, আরও এক বার ব্যর্থতার দায় পড়বে হার্দিকের কাঁধে। কিন্তু ভয় পাননি হার্দিক। নিজের পরিকল্পনা থেকে সরেননি তিনি। এই মরসুমে রোহিতের মতো ক্রিকেটারকে শুধু ব্যাটিংয়েই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। বেশির ভাগ ম্যাচে তাঁকে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলানো হয়েছে। রোহিত নিজেও জানিয়েছেন, বোলিং পরিকল্পনায় তাঁকে রাখা হয় না। অর্থাৎ, হার্দিক বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনিই শেষ কথা। হার-জিত সব দায় তাঁর। এই সাহস ক’জন দেখাতে পারে। দলে পাঁচ বারের চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ডাগ আউটে বসিয়ে রাখার সাহস ক’জন দেখাতে পারেন। হার্দিক পেরেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, রোহিতের ফিল্ডিং দলকে সমস্যায় ফেলতে পারে। সেই সিদ্ধান্তের পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।
এ বারের আইপিএলে ব্যাটার হার্দিককে বিশেষ দেখা যায়নি। ন’টি ইনিংসে ১৬১ রান করেছেন তিনি। গড় ২৩। স্ট্রাইক রেট ১৬১। শুরুর দিকে কয়েকটি ম্যাচে ভাল খেললেও বেশির ভাগ ম্যাচেই আক্রমণাত্মক ইনিংস খেলার চেষ্টা করেছেন তিনি। আউট হলেও ধরন বদলাননি। দলকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন হার্দিক। তা হল ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলার বার্তা। ফলের চিন্তা না করে নিজেদের কাজ করে যাওয়ার বার্তা।
আরও পড়ুন:
এ বারের আইপিএল দেখেছে অধিনায়ক হার্দিককে। এক বার জয়ের স্বাদ পাওয়ার পরে আর পিছনে তাকাননি তিনি। তাঁকে সাহায্য করেছে বুমরাহের দলে ফেরা। তিনি ফিরতেই দলের ভারসাম্য ঠিক হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি সূর্যকুমার যাদব, তিলক বর্মা, নমন ধীরের মতো পুরনো সৈন্যদের পেয়েছেন হার্দিক। এক বার ছন্দ পাওয়ার পরে মুম্বইকে আর থামানো যায়নি। তার নেপথ্যে বড় কৃতিত্ব হার্দিকের অধিনায়কত্বের। নইলে আইপিএলে অপরিচিত কর্বিন বশের মতো ক্রিকেটারকেও দরকারে খেলাতে ভয় পাননি তিনি। আবার যে ম্যাচে দরকার পড়েছে সেই ম্যাচে কর্ণকে ব্যবহার করেছেন। ফিল্ডিং সাজানো থেকে শুরু করে সঠিক সময়ে সঠিক বোলারকে দিয়ে বল করানো, সব করেছেন হার্দিক। পিচ বুঝে প্রথম একাদশ নির্বাচন করেছেন। ফলে দ্রুত উইকেট হোক বা মন্থর, সমস্যা হয়নি তাঁর।
বুধবার দিল্লির বিরুদ্ধেও একটা সময় সমস্যায় ছিল মুম্বই। মন্থর উইকেটে রান তুলতে সমস্যা হচ্ছিল। হার্দিক নিজেও মাত্র ৩ রানে আউট হয়ে যান। কিন্তু দলের সতীর্থদের উপর ভরসা রয়েছে তাঁর। তাই রান না উঠলেও মুখের হাসি কমেনি হার্দিকের। সেই হাসি চওড়া করেছেন সূর্যকুমার ও নমন। শেষ দু’ওভারে ৪৮ রান করেছেন। যেখানে দেখে মনে হচ্ছিল ১৬০ রান হবে না, সেখানে ১৮০ রান করেছে মুম্বই। সূর্য ৪৩ বলে ৭৩ ও নমন ৮ বলে ২৪ রান করে অপরাজিত থেকেছেন। বিরতিতে সূর্য জানান, ১৫ রান বেশি করেছেন তাঁরা। আদতে দেখা গেল, ১৫ নয়, অনেক বেশি রান করে ফেলেছেন তাঁরা।
হার্দিকও জানতেন, প্রথমার্ধেই খেলা জিতে গিয়েছেন তাঁরা। তার পরেও দিল্লিকে কোনও সুযোগ দেননি। এই ম্যাচে স্যান্টনারকে খেলানোর সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক তা ম্যাচে বোঝা গিয়েছে। চার ওভারে মাত্র ১১ রান দিয়ে ৩ উইকেট নিয়েছেন তিনি। গতির হেরফের করে জাদু দেখিয়েছেন নিউ জ়িল্যান্ডের এই অলরাউন্ডার। পিচে স্পিন ভাল হচ্ছে দেখে কর্ণকেও খেলিয়ে দিয়েছেন হার্দিক। আর বোল্ট, চহর, বুমরাহ নিজের কাজ করেছেন। এক বারও মনে হয়নি রান তাড়া করতে পারবে দিল্লি। যে দিল্লিকে হারিয়ে নিজেদের জয়ের রথ চালাতে শুরু করেছিল মুম্বই, সেই দিল্লিকে হারিয়েই প্লে-অফ নিশ্চিত করেছে তারা। ৩৬৯ দিন আগের চোখের জল মুছে হাসিমুখে ওয়াংখেড়ে ছেড়েছেন অধিনায়ক হার্দিক।