গত কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দাপট দেখাচ্ছে আফগানিস্তান। এশিয়া থেকে নতুন শক্তি হিসাবে উঠে এসেছে তারা। লড়াকু মনোভাব, হার-না-মানা লড়াই এবং ক্রিকেটবিশ্বের ‘দৈত্য’ দেশগুলিকে হারিয়েছে তারা। সেই সঙ্গে জন্ম দিয়েছে একের পর এক প্রতিভাবান ক্রিকেটারের। সেই তালিকায় নতুন সংযোজন ইব্রাহিম জ়াদরান। ইংল্যান্ডের তারকা বোলারদের পিটিয়ে যিনি বুধবার ১৭৭ রান করেছেন। তবে জ়াদরানকে ‘নতুন’ বললে ভুল হবে। তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে গত দু’বছর ধরেই। ভারতের মাটিতে এক দিনের বিশ্বকাপে একাধিক স্মরণীয় ইনিংস রয়েছে তাঁর।
এখনও পর্যন্ত কোনও আন্তর্জাতিক ট্রফি জেতেনি আফগানিস্তান। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে যে ভাবে একের পর এক ক্রিকেটার উঠে এসেছেন কোনও পরিকাঠামো ছাড়াই, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। জ়াদরান নিজেই ছোটবেলায় কাবুলের রাস্তায় ক্রিকেট খেলেছেন। তার পর নির্বাচকদের নজরে পড়ে যাওয়া, বয়সভিত্তিক দল থেকে শুরু করে জাতীয় দলে খেলা, সুযোগ পেয়ে একের পর এক স্মরণীয় ইনিংস— ২৩ বছর বয়স হলেও কম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেননি তিনি। আফগানিস্তান দলেও বড় ক্রিকেটারের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু তারকাদের ভিড়েও নিজের জন্য আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন জ়াদরান।
আফগানিস্তানের খোস্তে জন্ম জ়াদরানের। বরাবরই এই এলাকা অশান্ত থাকে। গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক লড়াই, জঙ্গি হামলা এই এলাকায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ক্রিকেটীয় পরিকাঠামো থাকার কথাই নয়। ভাল মানের জীবনযাপনের আশায় জ়াদরানের ছোটবেলাতেই তাঁর পরিবার চলে গিয়েছিল কাবুলে। সেখানেই রাস্তায় রাস্তায় স্থানীয় বাচ্চাদের সঙ্গে খেলে বড় হয়েছেন জ়াদরান।
প্রতিভা কোনও দিনই চাপা থাকে না। জ়াদরানের ক্ষেত্রেও তা হয়নি। স্থানীয় প্রতিযোগিতা থেকেই নজর কাড়তে শুরু করেছিলেন তিনি। ব্যাটিংয়ে তাঁর প্রতিভা দেখে স্থানীয় কোচ এবং নির্বাচকেরাই তাঁকে পরামর্শ দেন ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়ার জন্য। বাড়ি থেকেও একটু আপত্তি থাকলেও খুব বেশি বাধা আসেনি। জ়াদরান মনের সুখেই ক্রিকেট খেলতে থাকেন।
ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা থেকে উত্থানের শুরু। ২০১৭ সালে লিস্ট এ ক্রিকেটে অভিষেক হয় জ়াদরানের। তার পর থেকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সে বছরই অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পান। দু’বছর পরেই দেশের জার্সিতে খেলার সুযোগ চলে আসে। টেস্টে অভিষেক হয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তার পর থেকেই তিনি সব ফরম্যাটে আফগানিস্তান দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
২০২০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেছিলেন জ়াদরান। ২৪০ রান করে প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন। ২০২২-এর জুনে এক দিনের ক্রিকেটে জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে প্রথম শতরান করেন। দ্বিতীয় শতরান করেন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে তাদেরই দেশে। সেই দ্বিপাক্ষিক সিরিজ়েই তৃতীয় এক দিনের শতরান আসে তাঁর। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১৬২ রান করে গোটা বিশ্বের নজর কেড়ে নেন। সেটাই এত দিন এক দিনের ক্রিকেটে কোনও আফগান ক্রিকেটারের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান ছিল। বুধবার জ়াদরান নিজের নজির নিজেই ভেঙেছেন। ২০২২-এ তিনি আইসিসির বিচারে সেরা উঠতি প্রতিভা হিসাবে বিবেচিত হয়েছিলেন।
জ়াদরানের জীবনের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত নিঃসন্দেহে ২০২৩-এর এক দিনের বিশ্বকাপ। সে বার আফগানিস্তান শেষ করেছিল ছয়ে। আর একটি ম্যাচ জিতলেই হয়তো সেমিফাইনালে উঠে যেত। আফগানিস্তানের সেই স্মরণীয় যাত্রার অন্যতম কান্ডারি ছিলেন জ়াদরান। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁর ম্যাচ জেতানো ৮৭ রান এখনও সমর্থকদের মুখে মুখে ঘোরে।
সেই ইনিংসের পর ম্যাচের সেরার পুরস্কার উৎসর্গ করেছিলেন সেই আফগান মানুষদের, যাদের জোর করে নিজের দেশে ফেরত পাঠিয়েছিল পাকিস্তান। জ়াদরানের সেই ব্যবহার বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছিল।
আফগানিস্তানের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগে দলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। আলাদা করে জ়াদরানের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁকে কিছু পরামর্শ দেন। তার পরেই সেই ম্যাচে শতরান করেন জ়াদরান। ১৪৩ বলে ১২৯ রান করেছিলেন। এক পায়ে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অবিশ্বাস্য ২০১ রানে ভর করে কোনওমতে সেই ম্যাচ অস্ট্রেলিয়া জিতলেও, জ়াদরানের ইনিংস পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায়নি।
সেই ম্যাচের পর জ়াদরান বলেছিলেন, “সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে অনেক কথা বলেছিলাম। নিজের ক্রিকেটজীবনের কথা শুনিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নামার আগে দলের সবাইকে বলেছিলাম, আজ সচিনের মতো ব্যাট করব। সেটাই করেছি।” জ়াদরানের কথা শুনে খোদ সচিনই মুগ্ধ হয়ে গিয়ে তাঁকে আলাদা করে বার্তা দিয়েছিলেন।
ডানহাতি ব্যাটার জ়াদরান পরিচিত আগ্রাসী ক্রিকেটের জন্য। সামনের পায়ে খেলার ক্ষমতা এবং শটের বৈচিত্রের কারণে আধুনিক সময়ের অনেক ক্রিকেটারকেই টেক্কা দিতে পারেন। তাঁর দর্শনীয় কভার ড্রাইভ, পুল বাকি বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের থেকে কোনও অংশে কম নয়। পাশাপাশি, যে কোনও পরিস্থিতির সঙ্গে অনায়াসে মানিয়ে নিতে পারেন তিনি। কোনও প্রতিপক্ষকেই ভয় পান না। সে কারণেই মাত্র ২৩ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শতরান রয়েছে তাঁর।
আরও পড়ুন:
বুধবার ইংরেজ ক্রিকেটারেরা বিশ্বাসও করতে পারেননি এই আফগান ওপেনার এতটা বিধ্বংসী খেলবেন। আফগানিস্তান ৩৭ রানে তিন উইকেট হারানোর পর গ্যালারিতে থাকা ইংরেজ সমর্থকেরা হাসিতে ফেটে পড়ছিলেন। সেখান থেকে ম্যাচের মোড় একার হাতে ঘুরিয়েছেন জ়াদরান। বুঝিয়েছেন, লড়াই তাঁর রক্তে। এর থেকেও কঠিন লড়াই তাঁকে মাঠের বাইরে করতে হয়েছে যে!